মন চায় লালন ফকির হয়ে যাই

শিল্পী জলি: 

সেবার ২০০৪ এ গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। প্রতিবেশী ধিলু আপা বললেন, শিল্পী আমার টিনুকে যেমন করেই পারো আমেরিকায় নিয়ে যাও !
বললাম, এসব কী বলেন আপা–একমাত্র ছেলেকে আমেরিকায় পাঠাবেন কোন দুঃখে? ওখানে কেউ যায় নাকি, কোনো জীবন আছে?

বললেন, কী যে বলো না তুমি….

বলি, টিভিতে যা দেখেন সবই চোখের ধাঁধা
ঐ যে রকমারি খাবার, বেশীরভাগই কাঁচা খায়– ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংশাক সবই। বেগুনও কাঁচা খায় কিনা– জানি না। তবে আলু খায় পুড়িয়ে। রান্নারও কালচার নেই তাদের….মশলার গন্ধহীন ঝকঝকে রান্নাঘর তাদের, তবে সচরাচর খায় বাইরে।

সময়ের সাথেও দৌঁড়াতে হয় ওখানে। টয়লেটে বসে বসেও দেখতে হয় পাঁচমিনিট হতে আর কয় মিনিট বাঁকী। একটি এক্সট্রা হাঁচিতে এক মিনিট গেলে টয়লেটের বরাদ্দ সময় থেকে বাদ যাবে সে সময়। কোষ্ঠকাঠিন্যেরতো উপায়ই নেই। জীবন বলতে শুধু কাজ আর কাজ–একজনকে দিয়ে পাঁচজনের।
আর সপ্তাহ শেষে বেতন থেকে আগেই ৪০% ট্যাক্স কেটে নেয়া। এটা কোন জীবন হলো ?

বলে, কি যে বলো…সবাই…

বলি, সবাই তো বলে না– দুঃখের কথা কে বলে, আর কোন শালা শুনতে চায়, বলেন ? আমরা তো আমরাই, আমেরিকার ক্লিনটনও টয়লেট ঘষে ঘষে বড় হয়েছে। ঘরমোছা-ঝাড়ু-রান্না ওসবতো জোলাপাতি ওখানে। ১০২ ডিগ্রী জ্বর নিয়েও নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। মিসক্যারেজেও গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটতে হয়–কোন আমেনার মা, রহিমার মা নেই এক গ্লাস পানি দেবে।

বলেন, তবুও যদি….

বলি ধিলু আপা, আমেরিকার বাড়িঘর যা দেখেন সবই লোনের বাড়ী। সকালে চাকরি আছে, বিকেলে চাকরি নেই। অসুখ হলে ইন্স্যুরেন্স ছাড়া ডাক্তারের কাছে যাবার উপায় নেই, ছেলেমেয়েকে দামকি দেবার পথ নেই…দিলে সোজা জেলের ভাত….দেশে ভালো থাকলে কী দরকার এতো ঝামেলার?

শিল্পী জলি

বলেন, নিবে না তাই বলো ….

মনে মনে বলি আমি নেবার কে? নেবেন তো উপরওয়ালে….হয়তো বড় জোর আমি হবো উছিলা ….হতাশায় মন আধ্যাত্মিক হয়।
বোঝাতে পারি না, আইনে না পড়লে আমি তো আমি, ক্লিনটন/ওবামাও নিতে পারবেন না।

বছর কয়েক আগে শ্বশুর বলেছিলেন, তোমার ভাইকে বলো আমেরিকায় না আসতে….দেশে কতো ভালো জব করছে….এই বয়সে সব ছেড়ে-ছুড়ে এসে নতুন করে আবার শুরু করা!

বলি, জী জী ….আচ্ছা…. অবশ্যই…কেন নয়?

কিছুই বলিনি, ভাইকে।

জগতের এমন কিছু বিষয় আছে যা মানুষ স্ব-চক্ষে না দেখলে বোঝে না।

আমেরিকায় এসে মাকে বলেছিলাম, যদি বলো চলে আসি দেশে….এখনও চাকরি আছে…কী দরকার এসবের ?
মা বললেন, যতসব উদ্ভট কথা তোর…..সব সময়ই এমন। ওখানে সবাই কতো সুখে থাকে…এমএস কর, পিএইচডি কর…

ভেবেছি, আর কতো?
এমএস, পিএইচডি দিয়ে আমার কী হবে?
এতো কেন ছুটোছুটি জীবনে?
জীবনের পঁয়ত্রিয়/চল্লিশ বছর যদি পড়ার পেছনেই গেলো, বাকি থাকলো কোন ছাতা? তাও বিদেশ-বিভূঁইয়ে, ইংরেজীতে?

ডুমুরগাছ থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া আমি যখন তখন তেঁতুলগাছের মাথায় চড়ে বসে থাকতাম, সেই আমাকে আজ দিনরাত বলতে হচ্ছে, হ্যালো/হাই, নাইস টু মিট ইউ…..।

বোন বলে, কেমন আছিস…?
বলি, ওই একই–বুড়া হলে দেশে চলে যাবো…..।

বলে, দেশে গিয়ে খাবি কি ?
বলি, চা বিক্রি করবো। দিনে চার কেটলি (ক্যাটল/ক্যাডল) চা। সাথে একটি মোয়া বা নাড়ু ফ্রী।

বোন বলে, বুড়া হবি কবে ?
খিল খিল করে হেসে উঠি ……
বলে, হাসিস কেন ?
কি বলবো আর দুঃখের কথা ?
আমার চেয়ে দশ/বার বছরের ছোট পোলাপানকেও দেখে আজকাল মনে হয় এ যে দেখতে একেবারে দাদার মত হয়ে গিয়েছে ….আমি যাই কই ?

জীবন যে কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। মন চায় সেই আগের মত রাজপুরের গ্রামে গিয়ে ফুপুর সাথে ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটি, ঈদে রিক্সা ভাড়া করে কোক হাতে ডাট দেখাই, অথবা….।

দেশ থেকে একবার শিকড় ছাড়া হলে সহসা আর দেশেও ফেরা যায় না। আজ আবার আতিক, বাফী, টার্বো, জেনারেল সিম্বা, টিনি, চটপটি-চিনি জড়িয়ে গিয়েছে জীবনের সাথে– সবাই বিদেশী। তাদেরই বা কী হবে ?

আমি তো আর আমি নেই, এতো আমার ছায়া…কায়া হয়ে হেঁটে বেড়ায়। জীবনে তিনবেলা খেতে কেন যে এত ঝড়ঝাপ্টা–বুঝি না !

মন চায়, লালন ফকির হয়ে যাই….হাঁটি পথে পথে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.