পোশাকের স্বাধীনতা, না ‘পোশাকি’ স্বাধীনতা?

গিয়াস উদ্দিন:
মেয়েরা কী পরবেন, সেটা তারাই ঠিক করবেন। এর ওপর নিশ্চয়ই কোনও কথা চলতে পারে না। অন্তত একটা আধুনিক, গণতান্ত্রিক দেশে। বিশেষ করে এ দেশে রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা ঘটলেই যেভাবে এক শ্রেণির মানুষ তাদের পোশাককে এজন্য দায়ী করতে শুরু করেন, তাতে এই স্বাধীনতার কথাটা বিশেষভাবে বলা দরকার।
কিন্তু এই সূত্রেই একটা অন্য প্রশ্ন তোলা যায়। তোলা দরকার। মেয়েরা যা পরেন, যেভাবে পরেন, তা কি তাদের নিজস্ব রুচিপছন্দ অনুসারেই? না কি, তাদের বেলায় পোশাক মানে সত্যিই পররুচির খেলা?
নারীর কাছে ‘পররুচি’-র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পরিধান নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাকের স্বাধীনতার বা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরে, পরতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, আজও তা সুকৌশলে আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়। এ খেলা নতুন নয়, অতি প্রাচীন। খোলা মনে একটু তলিয়ে ভেবে দেখুন।
দেবী সরস্বতীকে ‘কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে’ করে গড়ে তুলেছিল যে প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তার দৃষ্টির সবটাই কি সত্য-শোভন-সুন্দর ছিল? না কি, তার পিছনে ছিল কিছু অবচেতন, অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষাও? কালিদাসের নায়িকারাও তো কেউ আকাশ থেকে পড়েননি। সেকালের নারীসমাজও কিন্তু সেই নায়িকাদের দেবীর আসনে বসিয়ে, তাদের ‘আইডল’ হিসেবে গ্রহণ করে নিজেদেরও সাজিয়ে তুলেছিল সেই রকমই আবরণ আর আভরণসমূহে।
নারীর সেই ‘স্বর্গীয় রূপ’-এর নির্মাতারা আজও বর্তমান। এবং তারা আজও সেই পুরুষশাসিত সমাজেরই প্রতিনিধি। তারাই নির্ধারণ করে চলেছেন নারীর পোশাকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা, আজও। তাদের নিবিড় ইচ্ছাগুলোই আজকের দুনিয়ায় ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে শোভা পায় নারীর দেহে।
পশ্চিম হোক বা পূর্ব, ভোগবাদ হোক বা রক্ষণশীলতা, বোরখা হোক বা মিনি স্কার্ট, পুরুষচক্ষুই আজও নিয়ন্ত্রণ করে নারীর পোশাকের স্বাধীনতাকে। এবং ‘স্বেচ্ছাচারিতা’কেও। নারীকে দেহোপজীবিনী বানিয়েছে পুরুষই। আর যখন কোনও ধর্ষণের শিকার নারীকে দেহোপজীবিনী হিসেবে চিহ্নিত করেন কোনো রাজনীতিবিদ, তখন তার গলা থেকে আসলে সেই পুরুষতন্ত্রেরই বজ্রনির্ঘোষ শোনা যায়। এই ছদ্ম-পুরুষতন্ত্রের জাল ছড়ানো ভুবনময়। এখনও।
এবং এই স্বরচিত যৌনতার ফাঁদ থেকে পুরুষেরও মুক্তি নেই। তারাই এক সময় তাদের নিজে হাতে গড়া মানসপ্রতিমার ধর্ষক হয়ে ওঠে। লোভী থেকে ভোগী এবং ভোগী থেকে হিংস্র সম্ভোগী হয়ে ওঠার এই সরল পথে নারী আজও এক উপচার মাত্র। প্রতিমা নির্মাণ, তাঁকে আপন ইচ্ছা অনুযায়ী বস্ত্র-প্রদান আর শেষমেশ সেই বস্ত্র-লুণ্ঠনান্তে তাঁকে বিসর্জনের মধ্যবর্তী সময়টুকুই আজও তাঁকে পুরুষ দেয় নিজস্ব স্বাধীনতা উদযাপনের জন্য। নারীকে সে-ই গড়ে তোলে যৌন-উদ্দীপনাময়ী হিসেবে, সে-ই দেয় বস্ত্র, আবার সে-ই কেড়ে নেয়।
তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, পুরুষ নারীকে যৌন উত্তেজক পোশাক পরায় এবং সেই কারণেই তাঁকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। গল্পটা অত সরল নয়। মাঝরাতে উড়ালপুলের নীচে ধর্ষণের শিকার হোন যে বস্তিবাসী রমণীটি, তিনি কোনও যৌন-উত্তেজক পোশাক পরে ছিলেন না। তবু তো তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। যেমন কতবার কত নারীকে ধর্ষণ করা হয়।
এর কারণও নিহিত আছে সেই উন্মত্ত ভোগতৃষ্ণায়, যা প্রতিনিয়ত অজস্র আইটেম সং, বিলবোর্ড, টেলি ডান্স ধামাকা আর পেজ থ্রি বাহিত হয়ে আমাদের মগজে প্রবেশ করছে এবং ক্রমাগত আমাদের এই রিরংসায় বিপন্ন করে তুলছে যে, ওরা যা পাচ্ছে, আমরা তা পাবো না কেন? সেই রিরংসার মাত্রা ছাড়ালে তা দুধের বদলে পিটুলি গোলা পেলেও তাকে নিঃশেষে সাবাড় করে দেয়। স্ব-নির্মিত স্বপ্নের মাদকতা আর বাস্তবের অপ্রাপ্তিজনিত রুক্ষতার মাঝখানে পড়ে এ ভাবেই বার বার সমস্ত সংযম হারায় পুরুষ। হারায় শুভবুদ্ধিও। হিংস্রতার কারণটাকে চেনা দরকার, ভাষাটাকে বোঝা দরকার।
গিয়াস উদ্দিন

ক্ষমতাবান, সমাজ-অধিপতি পুরুষ নারীকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিতে পারেনি, যাতে বাহ্যিক নয়, অন্তরের সৌন্দর্যই হয়ে ওঠে মর্যাদার মাপকাঠি। অতি প্রাচীন পুরুষ-শাসিত সমাজের পথ বেয়ে আজও সমাজের অধিকাংশ নারীকেই শৈশব থেকে কোনও আত্মপরিচয় গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় না চিত্রাঙ্গদার মতো কোনও আত্মানুসন্ধানের ব্রতের ঠিকানা। তারা জেনে-বুঝে বসে থাকে যে, তারা নারীই। তাই পুরুষ-চক্ষুকে বিদ্ধ করতেই তাদের নিবিড় সাধনা স্বচ্ছ বা স্বল্পবাসে আর তীব্র রূপটানে। যাঁরা সেই লোভটাকে জয় করতে পেরেছেন, তাঁরা স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। কিন্তু তাঁরা আজও ব্যতিক্রমী।

সেইসব বুভুক্ষপীড়িত বা তাড়িত পুরুষকে চিহ্নিত করা যাবে কীভাবে, ক’জন পুরুষকে ধরে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবে আমার রাষ্ট্র?
শেয়ার করুন: