আব্বা আমারে বাঁচাইবানি…..

শাশ্বতী বিপ্লব: “আব্বা আমারে বাঁচাইবানি…” – দূর দেশ থেকে ভেসে আসে আত্মজার আর্তচিৎকার, “আমারে দেশে না নিলে ফাঁস দিয়া মরবো।”

বাঁচার আকুতি ভেসে আসে সৌদি আরব থেকে, ওমান থেকে, লেবানন থেকে, বাহরাইন থেকে, জর্ডান থেকে, কাতার থেকে, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। একমাত্র কর্মদক্ষতা “গৃহকর্ম” কে পুঁজি করে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে মেয়েটি, একটু সুখ, একটু স্বচ্ছলতা কিনবে বলে।

দেশে থাকতে এই কাজইতো সে করেছে। বাবার ঘরে, স্বামীর ঘরে। ঘরে নতুন টিনের চালা হবে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে। দু’বেলা পেট ভরে দু’মুঠো ভাত, দু’একটা শখের কাপড়, বড়জোর একটা টেলিভিশন। এইতো মাত্র চাওয়া। তার দাম বড্ড ভারী হয়ে ওঠে মেয়েটির সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। অসহায় পরিবারটি আরো অসহায়, আরো বিপন্ন হয়ে ওঠে।

রেকর্ড করে রাখা মেয়েটির আহাজারি শোনে স্বজন, “আম্মা, আম্মাগো, আমারে বাঁচাও। সেকুল আমারে দালালের কাছে বেচে দিয়েছে। দাম্মামে একটা ঘরে আটকে রাখে। একেকদিন একেকজনের বাড়ীতে পাঠায়।” নিস্ফল আক্রোশে ছটফট করে। তাদের ঘরে অভাব ছিলো বটে, কিন্তু এতো অসম্মান, এতো নিষ্ঠুরতাতো ছিলো না।

অসহায় বাবা মা এর ওর কাছে ধর্ণা দিয়ে ফেরে, “আমার টাকা পয়সার দরকার নাই। আমার মেয়েটা যেন আমার বুকে ফিরা আসে।শাক আর ডাল দিয়া ভাত খাবো, তবু শান্তিতে থাকবো।” অপেক্ষা করে নির্যাতিত, প্রায় নিঃস্ব মেয়েটি ফিরে আসার। অপেক্ষা করে থাকে অসহায় স্বামী, নিরুপায় সন্তান। তাদের জন্য ভাগ্য কিনতে গিয়েছিলো সেই দুর্ভাগা মেয়েটি।

কে শোনে কার কথা? যারা কোনমতে দেশে ফেলে যাওয়া স্বজনের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, তারা অন্যদের চাইতে ভাগ্যবান। তাদের কারো কারো ঠাঁই হয় দূতাবাসের শেল্টার হোমে। অপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসার। কেউ কেউ ফিরেও আসে। আর যারা ব্যর্থ হয়, কোনোভাবেই পৌঁছাতে পারে না ফোনের অপর প্রান্ত পর্যন্ত, তাদের উপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। কেড়ে নেয়া হয় যোগাযোগের সামান্য উপায়টুকুও। নির্যাতন আর অপমানের গ্লানি সইতে না পেরে তারা হয় ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে, নয় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে মুক্তি খোঁজে। অথবা নির্যাতিত হতে হতে জীবন্মৃতের মতো বেঁচে থাকে বা মরে যায়।

আইন আছে। আছে নীতিমালাও। আছে Standard Employment Contract. প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এর ওয়েব সাইটে গেলে থরে থরে সাজানো পাওয়া যায় তাদের। আছে valid sending organization এর তালিকা। সেখানে সব আছে, শুধু নেই “গৃহকর্মী”দের নিরাপত্তার কথা, নেই যৌন নির্যাতন নিয়ে কোনো আলোচনা। নেই এর থেকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো কৌশল নিয়ে আলোকপাত।

আরো আছে, প্রবাসীদের জন্য কল সেন্টার, ওয়েব মেইল, অনলাইন অভিযোগ করার ব্যবস্থা। আছে বিদেশস্থ মিশনে শ্রম উইং, যাদের দায়িত্ব শ্রমিকদের খোঁজ নেয়া, তাদের কর্মস্থল ভিজিট করা। কিন্তু এসবের কোনটাই কাজে আসে না এই হতভাগ্য মেয়েগুলোর। কর্মস্থল ভিজিটের দায়িত্ব যে কতোটুকু তারা পালন করেন সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কোন দৈবগুণে কেউ যদি সেই কর্মকর্তাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছেও যায়, সেখানেও নেই কোনো নারী কর্মকর্তা। চাইলেও যৌন হয়রানির কথা বলা হয় না অনেকের।

নিজেদের মেয়েদের এই আর্তচিৎকার ঠিকই পৌঁছে গেছে ভারত, শ্রীলংকা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া সরকারের কানে। তারা বন্ধ করে দিয়েছে ওইসব দেশে গৃহকর্মী হিসেবে নিজেদের মেয়েদের পাঠানো। কিন্তু বন্ধ করেনি এই পোড়া দেশ। বরং বাজার এখন আরো বেশি রমরমা। চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। সেইসব দেশের গৃহকর্মীদের শূন্যস্থান পূরণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই দেশের পাচারকারী দালালেরা। অকাতরে প্রতিদিন বেঁচে দিচ্ছে, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের অসহায়, দরিদ্র মেয়েদের।

শাশ্বতী বিপ্লব

মানুষের একটু ভালো থাকতে চাওয়ার আকুতিকে পুঁজি করে, তাদের জীবন বেচে দিয়ে, নিজের সন্তানদের জন্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কিনছে এই দালালেরা। তাদের বিবেক জাগ্রত হওয়ার আশা করা বৃথা। কিন্তু সরকারও কী চোখ বন্ধ করে থাকবে?

কদর্য যৌন লালসায় ছিন্নভিন্ন হওয়া এই নারীদের রক্ত মাংস মিশিয়ে সন্তানের মুখে গ্রাস তুলে দিচ্ছে, দিক এই দালাল চক্র। কিন্তু সরকার এদের বাঁচানোর উদ্যোগ নিক। বন্ধ হোক গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশী কর্মসংস্থান। আর কী কোনো কাজ নেই? গৃহকর্মীই কেন হতে হবে তাদের!!!

আমাদের মেয়েরা বিদেশ যাক ভিন্ন কর্মদক্ষতা নিয়ে, গৃহকর্মী হিসেবে নয়। ভাতের থালা সামনে নিয়ে আমার কানে আর না বাজুক, “আব্বা আমারে বাঁচাইবানি…..”

তথ্যসূত্র:

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/01/24/455618

http://www.sylhettoday24.com/news/details/Sylhet/37748?utm_campaign=shareaholic&utm_medium=facebook&utm_source=socialnetwork

http://probashi.gov.bd

শেয়ার করুন: