শান্তা মারিয়া: একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনা হবে সেটি লেখকের জন্য ইতিবাচক বলেই আমি মনে করি। কারণ তাহলে লেখাটির প্রধান যে উদ্দেশ্য পাঠকের কাছে পৌঁছানো, সেই উদ্দেশ্য সফল হয়।
লেখাটি পড়ে অনেকেই সাধুবাদ ও সমর্থন জানিয়েছেন। প্রথমেই তাদের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। যারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাদেরও ধন্যবাদ। কারণ তারা লেখাটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন ও পড়েছেন। অনেকে অনেক রকম প্রশ্ন করেছেন। আমি তাদের কারও কারও প্রশ্নের জবাব ইনবক্সে, কারওটা কমেন্টের মাধ্যমে দিয়েছি। কিন্তু প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে জবাব দিতে গেলে গুরুদেবের ভাষায় ‘অপরাধের চেয়ে শাস্তি বড় হয়ে ওঠে’।
তাই উইমেন চ্যাপ্টারেই আমি সবগুলো জবাব একত্রে দিতে চাই।
প্রথম অভিযোগ প্রথমে খণ্ডন করছি।
প্রথম অভিযোগ লেসবিয়ান ও নারীবাদ প্রসঙ্গে। আমি বলতে চাই লেসবিয়ান বা গে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে হতে পারে না। এটা তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য। পুরোটাই বায়োলজিক্যাল। প্রকৃতির বৈচিত্র্য। এর সঙ্গে নারীবাদ বা পুরুষবাদের কোনো রিলেশন নেই। এই তথ্যটি আমি জানি না একথা যারা মনে করছেন তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আজ থেকে বহু বছর আগে আমি এ বিষয়ে অনেক পত্রিকায় অনেক লেখা লিখেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যে সময় লিখেছি তখন ফেসবুক ছিল না, ব্লগও ছিল না। যারা মন্তব্য করেছেন তারাও তখন নিতান্ত শিশু। ফলে আমার লেখাগুলো তাদের পড়ার সুযোগ ঘটেনি।
একজন লেসবিয়ান চরম পুরুষতান্ত্রিক হতে পারেন, আবার একজন গে হতে পারেন প্রচণ্ড নারীবাদী। আবার তারা উভয়েই যেকোনো মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কথাগুলো উঠলো কেন? এইখানে আমার জবাব হলো, যখন কেউ আমাকে বলেন ‘আপনি নারীবাদী নন, কারণ আপনি লেসবিয়ান নন’। এবং একজন যখন অহংকার করে মন্তব্য করেন, তিনি নারীবাদী, তাই তিনি লেসবিয়ান। তখন আমার তাকে বলতে হয় যে সমকামিতার সঙ্গে নারীবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কে সমকামী, কে অসমকামী সেটা তার জৈবিক জন্মগত বিষয়। কারও ব্যক্তিগত যৌন আচরণ নিয়ে আমার কোনো অ্যালার্জি বা প্রীতি কোনোটাই নেই। ক্লিয়ার?
দ্বিতীয় অভিযোগ চুল ছোট বড় রাখা নিয়ে। এটি পুরোপুরি ফ্যাশন চেতনার বিষয়। কে প্রিন্সেস ডায়নার হেয়ার কাট দিবে, কে বিয়োন্সের, কে লেডি গাগা আর কে মাথা পুরো ন্যাড়া করবে সেটা তার এবং তার বিউটিশিয়ানের মাথাব্যথা। আমার নয়। তাহলে কেন কথা উঠলো চুলের মতো একটি সিলি ম্যাটার নিয়ে? কারণ নারীবাদীদের বিপক্ষে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা নাকি ছোট চুল রাখেন। আমার লেখাতেও এগুলো সমালোচনা হিসেবেই উল্লেখ ছিল। আমি বলতে চাই, একজন ছোট চুলের নারী যেমন হতে পারেন নারীবাদী অথবা পুরুষবাদী, আবার বড় চুলের নারীও হতে পারেন নারীবাদী বা পুরুষবাদী। অথবা কোনো মতামতের সমর্থকও না হতে পারেন।
এবার আসি লেখাপড়া প্রসঙ্গে। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, পাঠের কোনো বিকল্প নেই। পড়তে হবে, জানতে হবে। অধিকার চাইলে, অধিকারের পক্ষে লড়তে গেলে পড়তে হবে।
যাদের বই পড়া প্রসঙ্গে কথা হয়েছে সেখানে তসলিমা নাসরিনের নাম বাদ গেছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। সেটি অনিচ্ছাকৃত। হ্যাঁ, তসলিমা নাসরিনের লেখাও অবশ্যই পড়তে হবে। পড়তে হবে আরও অনেকের লেখা, যাদের নাম আমি ওই প্রবন্ধে উল্লেখ করিনি। কারণ আমি বিবলিওগ্রাফি বা রেফারেন্স বইয়ের তালিকা করতে বসিনি। আমি তো আনোয়ারা সৈয়দ হকের নামও উল্লেখ করিনি। তাই বলে কি তার লেখা পড়বেন না? বস্তুত সত্তর দশকের আগে যারা লিখেছেন মূলত তাদের নামই বলা হয়েছে। তবে সত্তর, আশি, নব্বই, শূন্য সব দশকের উল্লেখযোগ্য লেখাই পড়তে হবে। না পড়লে আপনি কিভাবে জানবেন চিন্তাধারা কোনদিক থেকে শুরু হয়ে কোথায় প্রবাহিত হচ্ছে?
প্রশ্ন উঠেছে, যিনি সুযোগের অভাবে পড়তে পারছেন না, বা একজন তৃণমূল পর্যায়ের নারী, তিনি যদি নিজের অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাহলে কি তিনি নারীবাদী হতে পারবেন না? তিনি পড়েননি বলে কি তিনি অচ্ছুৎ? অবশ্যই তা নয়। তবে একসময় আমরা স্টাডি সার্কেল গঠন করে সেখানে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। যিনি ট্রেড ইউনিয়ন করতেন বা একেবারে ছিন্নমূল সদস্য ছিলেন, তিনিও কিন্তু সেই স্টাডি সার্কেল থেকে উপকৃত হতেন। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা সকলেই খুব শিক্ষিত ছিলেন না। খুব সত্যি কথা। কারণ সেটি ছিল জনযুদ্ধ। একজন অক্ষরজ্ঞানহীন মুক্তিযোদ্ধাও বীর হতে পারেন। কিন্তু তিনিও তো একথাটি জানতেন যে, আমার শত্রু কে! তার কাছে চেতনার আলো যিনি পৌঁছে দিয়েছেন, তারও তো কিছু ভূমিকা রয়েছে। আর চূড়ান্ত বীরও অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ করেছেন। অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ করা যায় না। ট্রেনিং ছাড়া যুদ্ধ করা যায় না।
পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হলে, জনযুদ্ধ চালাতে হলে অস্ত্র চালনার শিক্ষা তো আপনার লাগবেই। মানবমুক্তির বেসিক পাঠগুলো আপনাকে সেই অস্ত্র ও ট্রেনিং দিবে।
এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আসি। একজন প্রশ্ন করেছেন, তাহলে নারীর মুক্তি কোনপথে? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে আমি পুরো পাঠকগোষ্ঠির কাছে জানতে চাই, আমি বা আমরা এই বিশ্বের নাগরিক হিসেবে কী চাই! আমি কী চাই সেটা আগে বলি। তাহলে মিলিয়ে নিতে পারবেন আপনারও সেটি চান কীনা।
আমি এমন এক বিশ্ব চাই যেখানে আমি বেঁচে থাকতে পারবো। আমাকে জন্মের আগে ভ্রুণ থাকতেই মেরে ফেলা হবে না। জন্ম নিতে পারবো নিরাপদে। আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মায়ের মৃত্যু হবে না। তিনি ও আমি সবরকম স্বাস্থ্যসেবা পাবো জন্মের আগে ও পরে। আমি এমন বিশ্ব চাই যা হবে সকল শিশুর জন্য নিরাপদ। সেখানে রাজন, তোফামনি কাউকেই জীবন দিতে হবে না। কোনো শিশু, কোনো পূর্ণবয়স্ক মানুষ, এমনকি কোনো প্রাণীও যৌন নির্যাতনের শিকার হবে না। শুধু যৌন নির্যাতন নয়, কোনো ধরনের নির্যাতনেরই শিকার হবে না।
সকলে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার পাবে। লিঙ্গ, ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি, বর্ণ কোনো কারণেই কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত হবে। প্রত্যেকেই পাবে নিজের প্রতিভা বিকাশের অধিকার। শারীরিক, মানসিক কোনো রকম প্রতিবন্ধিতা অথবা ভিন্নতার জন্য কাউকে কোনো রকম সুযোগ থেকে বিরত রাখা হবে না।
মানুষ ক্ষুধাতাড়িত হয়ে কাজ করবে না, কাজ করবে মহত্তর প্রয়োজনে। শিক্ষা শেষে প্রত্যেকের কাজের অধিকার নিশ্চিত হবে। নিশ্চিত হবে বিশ্রামের অধিকারও। ডাইভারসিটি থাকবে, ডিসক্রিমিনেশন নয়। নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ প্রত্যেকেই বৈষম্যহীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে সকলের। আর সেইসঙ্গে পরিবেশ দূষণও বন্ধ হবে।
এমন একটি বিশ্বই চাই। আপনারও চান কীনা চিন্তা করুন।
এখন প্রশ্নটির উত্তর দিচ্ছি। এমন বিশ্ব গড়তে হলে কোন পথ অবলম্বন করতে হবে? আমি বিশ্বাস করি সাম্যবাদই একমাত্র পারে এমন বিশ্ব গড়তে। নারী-পুরুষ সকল মানুষের মুক্তি যদি আপনি সত্যিই চান, শোষণমুক্ত সমাজ যদি চান, তাহলে সাম্যবাদ ছাড়া পথ নেই। খুব পুরনো কথা? পুরনো চালই ভাতে বাড়ে। মার্ক্সবাদী দর্শন না পড়লে জীবন সম্পর্কে দেখার ও বোঝার সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে বলে আমি মনে করি না। খণ্ডিত জীবন দর্শন নিয়ে বেশিদূর এগোনো যায় না। সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ কোনোটাই আপনাকে মুক্তি দিতে পারবে না।
এখন যদি আমাকে সমাজবাদী, মার্ক্সবাদী বলে গালি দেন তাহলে সেটাকে আমি প্রশংসা বলেই মেনে নিব।
সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পথ বিষয়ে লেখার জায়গা এটা নয়। সেসব নিয়ে অন্য কখনও অন্য কোথাও আবার কথা হবে।