লীনা পারভীন: আমার গতকালের একটা লেখা নিয়ে পরিচিতজনদের মধ্যে কিছু ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, আবার অনেকেই কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে আমার অবস্থানটি ব্যাখ্যা করাটা আমার দায়িত্ব বলেই মনে করছি।
১) দর্শন, রাজনীতি ও জীবনবোধ: আমার পছন্দের বিষয় রাজনীতি ও ইতিহাস। আমার কাছে যা কিছু শিক্ষা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের রাজনীতি। তাই রাজনীতিটা পরিষ্কার না থাকলে সবকিছুতেই গণ্ডগোল আসবেই। আপনি কোন রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাস করেন সেটাই নির্ধারণ করে দিবে আপনার জীবনবোধ, দর্শন এবং করণীয়।

যেমন ধরেন, আপনি যদি সমাজতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাস করে থাকেন তবে আপনার মধ্যে গড়ে উঠবে মানবিক চেতনা। আপনি জীবনের প্রতিটা বিষয়কে সাম্যের দৃষ্টিতে দেখতে চাইবেন। আপনি যদি মনে করেন, আপনি কোনো রাজনীতির ধার ধারেন না, তাহলে কী হবে? আপনি কী এর বাইরে থাকতে পারবেন? না পারবেন না।
স্বাভাবিকভাবেই সমাজের প্রচলিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি আপনাকে গ্রাস করবে। আপনি তখন হয়ে যাবেন একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ, যে সবকিছুকেই নিজের মত করে পরিচালিত করতে পছন্দ করবে। ঠিক তেমনি, নারীবাদেও আপনার যদি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দর্শন না থাকে, তবে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন একজন স্বতন্ত্র এক্টিভিটিস্ট। তসলিমা নাসরীনের অনেক অনুসারী আছেন আমাদের দেশে। আমিও তার একজন ভক্ত। কিন্তু আমরা কী কখনো ভেবে দেখেছি কেন তিনি সমাজে স্ট্যান্ড করতে পারলেন না? তিনি তো কোনো খারাপ কিছু বলেননি। বরং আমাদের সমাজের আজকের নারীদের যে চিন্তাধারার পরিবর্তন সেখানে উনার রয়েছে বিরাট ভূমিকা।
২) মানবতাবাদ বনাম নারীবাদ: আমি কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে বাদ’কে বিবেচনা করি না। বরং বাদ’কে দিয়ে ব্যক্তিকে বিবেচনা করলে সেখানে একটি পরিষ্কার ধারণা গড়ে উঠে। অনেকেই বলেন, আগে নারীবাদকে বুঝতে হবে তাইলেই মানবতাবাদকে বোঝা যাবে। আমার মতে, বিষয়টা আসলে উলটা। নারীবাদ মানবতাবাদেরই অংশ। আপনি যদি মানুষকে ভালো না বাসতে পারেন, মানুষের অধিকার নিয়ে সচেতন না হোন, সোচ্চার না হয়ে উঠেন তবে নারীর অধিকারের বিষয়টি খণ্ডিতভাবে বোঝা যাবে। নারীর অধিকার নিহিত আছে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। তাই আগে সমাজকে বুঝতে হবে, সমাজের নিপীড়িত মানুষকে বুঝতে হবে এবং সেই নিপীড়ন থেকে মুক্তির উপায়টাও বুঝতে হবে পরিষ্কারভাবে। এখানেও সেই রাজনীতিই চলে আসছে।
এককভাবে নারীমুক্তি কখনো আসবে না। তাই আপনি কোন মতবাদের বিশ্বাসী লোক সেটা দিয়ে বোঝা যাবে, আপনি আমার সহযোগী না অন্যকিছু?
৩) বই পড়া, জ্ঞানী হওয়া এবং জীবনদর্শন: কেউ কেউ বলে থাকেন অনেক অনেক বই না পড়লে নাকি জ্ঞানী হওয়া যায় না। সমাজে কোনো মতামত দেয়ার আগে নিজেকে ইতিহাস, ঐতিহ্য, বড় বড় মানুষদের জীবনবোধ নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা না করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় না। সামান্য দ্বি-মত করি এর সাথে। অনেক অনেক বই পড়লেই কেউ মতামত দেয়ার জায়গায় চলে যায়, এটা সবসময় ঠিক নাও হতে পারে। আবার কিছুই না পড়েও একজন লোক তার নিজস্ব মতামত গঠন করতে পারে। আমি মনে করি, জীবনের বাস্তব শিক্ষাই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। জীবনের প্রতিটা স্তরে কেউ যদি বিশ্লেষণ করতে পারে, কী, কেন এবং কীভাবে নিয়ে ভাবে, তাহলেই সে মতামত দেয়ার মতো জায়গায় যেতে পারে। আরজ আলী মাতুব্বর কিন্তু কোন বই পরে দর্শন তৈরি করেননি। পুরোটাই তার জীবন থেকে শেখা। আমি বলছি না বই পড়ার কোন মূল্য নেই, কিন্তু বই না পড়লে কেউ অন্ধ থাকে সেটাও ১০০ ভাগ সঠিক নয়। বই পড়াটা জরুরি, কিন্তু একমাত্র উপায় নয়।
তাই নারীবাদ বা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলতে চাইলে বা লড়াই করতে চাইলেই কাউকে বিশাল বিশাল জ্ঞানের বই পড়ে কথা বলতে হবে, এর সাথে আমি একমত নই। যেমন ধরেন, আমার মা স্কুল পর্যন্ত পড়েছেন। এ নিয়ে তার নিজের মধ্যে কষ্ট ছিলো। সে তার জীবনে দেখেছে পড়াশোনা না করতে পারার কারণে সমস্ত জীবন কেটেছে স্বামীর আজ্ঞাবহ হয়ে বা অন্যের উপর নির্ভর করে। তাই সবসময় মা আমাদের তিন বোনকেই বলতেন, জীবনে পড়াশোনা ছাড়া কোন দাম নেই। এটা কিন্তু মা কোন বই পড়ে জানেননি। তিনি যেভাবেই পারতেন চাইতেন এখনো চান, তার মেয়েরা যেন স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠে এবং আমরা সে স্বাধীনতা মায়ের কাছে পেয়েছি।
তাই মনে করি, জীবন বাস্তবতা, সমাজ বা সামাজিক জ্ঞান থেকে গড়ে উঠে মানুষের তৃতীয় নয়ন আর বই সে দৃষ্টিকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
৪) স্বেচ্ছাচারিতা বনাম দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা: স্বেচ্ছাচারিতা কথার সাথে হয়তো অনেকেই দ্বি-মত পোষণ করতে পারেন। এখানে আমি স্বেচ্ছাচারিতা বলতে বুঝি কোনো প্রকার দায়িত্ববোধ বা জবাবদিহিতাবিহীন আচরণ করাকে। নারীবাদ কেন যে কোনো বাদ’কেই কায়েম করতে হলে আপনাকে সমাজ বাস্তবতাকে মেনে, তার ভিতরে আগে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করেই তারপর নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ করতে হবে।
আপনি যদি কেবল একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসাবে কিছু করতে চান, তাহলে মনে রাখতে হবে সেখানে আপনি কতোটা প্রভাব ফেলতে পারবেন। পুরুষরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে, তাই আমিও করতে পারি বা ধরেন, একজন ছেলে বড় চুল রাখে না, তাহলে মেয়ে বলেই আমি কেন রাখবো? ফাইন, এই চিন্তা আসতেই পারে। এখানে বিষয়টা কী এমন যে চুল ছোটো করলেই আমি নারী অধিকারের আইকন হয়ে গেলাম? আর যে বড় রেখে ছোট চুলের সুফল-কুফল বা এর পিছনে কারণ কী বা বড় চুল কীভাবে একজন নারীর গতিকে (পেইস) রুদ্ধ করে এসব নিয়ে কথা বলে, সে কোনো জাতেরই না?
আসলে বিষয়টা যদি আমরা শর্ট টার্ম এঙ্গেলে দেখে করে ফেলি তবেই তা স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে পড়ে। আপনাকে যেকোনো সমস্যার গভীরে ঢুকতে হবে, এর কার্যকারণ আবিষ্কার করতে হবে এবং পরিত্রাণের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। এভাবেই আসবে পরিবর্তন।
একটি কাজ আপনি কেন করছেন, কোথায় করছেন, তার পরিণাম কী এসব না ভেবে করার নামই স্বেচ্ছাচারিতা।
৫) ব্যক্তিগত সংস্কৃতি ও তার প্রভাব: ব্যক্তিগত সংস্কৃতির ভূমিকা আমরা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। আর সংস্কৃতি গড়ে উঠে রাজনৈতিক চেতনাবোধ থেকে। আপনি যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হোন তবে আপনার কাছে আপনি সেরা। ভিন্ন মতের মানুষজন সব অজ্ঞান, মূর্খ বা সঠিক নয় বলেই মনে হবে। যেকোনো মতবাদ নিয়ে লড়াই করতে গেলে আমাদেরকে আগে একটি উন্নত ও রুচিসম্পন্ন সংস্কৃতির ধারক হতে হবে। অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। ভুল হলেই কাউকে এক কথায় উড়িয়ে দেয়াটা ভুল। সেই ভুল কথাটা থেকেও শেখার অনেক কিছু আছে। অন্যের ভুল বলাটাকে সিরিয়াসলি নিলেই আমরা শিখতে পারি সঠিক মত গ্রহণ করাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ভিন্নমত গ্রহণের সংস্কৃতি না গড়ে উঠলে আপনি পদে পদে ধাক্কা খাবেন। সমাজ আপনার মত কেন গ্রহণ করবে? এ কথাটা আগে পরিষ্কার থাকতে হবে। নারী অধিকার কেন দরকার, হলে কী হবে, আর না হলে কী হবে, এ কথা কী আপনি আমি মুখে বললেই হয়ে যাবে? এতো সহজ মনে করাটাও বোকামী।
একবার মাঠে নামেন, দেখেন কত বাধা আসে। নারীরাই আপনাকে আক্রমণ করবে। তখন কেমন করে সামলাবেন? এক সময় হতাশ হয়ে বলবেন, নাহ!! এদের দিয়ে কিসসু হবে না। এখানে সব মূর্খের বাস।
সবশেষে আমি মনে করি নারীদের সচেতনতা আসছে এটা অনেক বড় পাওয়া। এই সচেতনতাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করাটাই হচ্ছে সময়ের দাবি। নারী, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি সর্বোপরি জীবনবোধ নিয়ে যে আলোচনা চলছে সেটা খুবই প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। বিশেষ করে যখন আমাদেরকে ক্রমেই বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে চারপাশ থেকে। বদ্ধ কুয়োর ব্যঙ হওয়ার চেয়ে একটি সচল স্রোতের পুঁটি মাছ হওয়াটাই কাম্য।