সুমনা, কেন হারিয়ে গেলে তুমি!

ফারহানা আনন্দময়ী:

সুমনা মেহেরুন, কবিতামনষ্ক দীপ্ত এক নারী তুমি। তোমার কবিতার মায়ায় জড়িয়েই হয়েছিল তোমার সাথে বন্ধুতা। ২০০৮/০৯ সালের কথা, আমি তখন খানিকটা লিখি, তুমি অনেকটা। সাহস হয়ে, অনুপ্রেরণা হয়ে সামনে সামনেই হাঁটছিলে…হঠাৎ তুমি নেই। হারিয়ে ফেললাম তোমায়, এক জন্মের মতো হারিয়ে গেলে জীবন থেকে। পৃথিবীর ঠিকানা বদল করে চলে গেলে অন্য গ্রহে।

সুমনা মেহেরুন

কিন্তু কথা কি এমন ছিল ? আমাদের আরো বেশি ভালবাসবার কথা ছিল, আমাদের আরো বেশি কবিতা লেখার কথা ছিল, কথা ছিল অনেকটা পথ একসাথে হেঁটে যাবার। অর্ধেকটা প্রতিশ্রুতি পূরণ করে শুধু ভালবাসতেই ভালবাসলে, জীবনকে ভালবাসলে না একটুও।

আমাদের ভেতর একজন বোকা নারীর যে অন্য একটা সত্ত্বা বাস করে, সে-ই সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিলো তোমায়। নিজের কর্মের চাইতে, নিজের সৃষ্টির চাইতে, সর্বোপরি নিজের জীবনের চাইতে বেশি মূল্যবান করে তুললে মূল্যহীন ভালবাসাকে। আর ঠিক যেই মুহূর্তে ভালবাসা তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, পরমুহূর্তেই তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে জীবন থেকে।

চলে গেলে, লড়াই না করে, লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে… প্রতিপক্ষকে বিনা জবাবদিহিতায় জিতিয়ে দিয়ে গেলে! তাই তারা সেই সুযোগে আবারো জিতে যায়, বারে বারে জিতে যায় অন্য কোনও সুমনার সাথে প্রবঞ্চনার করুণ কাটাকুটি খেলায়। হোমপেইজে ভেসে আসে নতুন অনুরাগির সঙ্গে সেলিব্রিটির সেলফি। মানুষ তার মুখোশটা দ্যাখে, আমি এক চকিতে দেখে ফেলি তার ভেতরের কুৎসিত মুখটা।

বন্ধু, মাঝে মাঝেই মনে পড়ে আমাদের শেষ দেখাশোনা। তোমায় শেষ দেখেছিলাম ১৪১৬ এর পয়লা ফাল্গুন। ঝুমকো-লতায় শেষ দেখা তোমায়, রাধাচূঁড়ায় হলুদ তুমি…প্রাণোচ্ছল, জীবনময়, যেটুকু বাইরে থেকে দেখা। বুঝতে দাওনি, ভেতরে তখন চলছে সব হিসেব ওলট-পালট করে দেয়া কালবৈশাখি ঝড়। কিছুতেই মেলাতে পারছিলে না বোধহয় জীবনের হিসেব…হিসেবগুলো এতোটাই এলোমেলো হয়ে উঠেছিল যে ক্লান্ত হয়ে এক্কেবারে বন্ধই করে দিলে হিসাবের খাতা।

শাস্তি যার প্রাপ্য ছিল তাকে এক প্রকার পুরষ্কৃত করে শাস্তি দিলে নিজেকে, শাস্তি দিয়ে গেলে প্রাণপ্রিয় দুটো অবুঝ শিশুকে। যার কঠিন ভার তাঁদের বয়ে যেতে হবে এক জীবন। ঠিক এখানে এসেই ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি আমি তোমার প্রতি। আমার রাগের ধ্বনি আর কষ্টের প্রতিধ্বনি তখন একাকার হয়ে যায়।

সুমনা, আবার দেখা হলে আমাদের প্রথম ঝগড়া হবে এটা নিয়েই। ভাবছো, যে স্মৃতির ওপরে বিস্মৃতির ধুলো জমে গিয়েছে এতোদিনে, সেই স্মৃতি নিয়ে কেন হঠাৎ নাড়াচাড়া করছি আজ? কারণ তবুও কৃষ্ণচূঁড়া লাল হয়ে ফোটে, কবিরা মরে না।

সেদিন রাতে তুমি এসেছিলে আমার স্বপ্নে, এসেছিল কবি সুমনা মেহেরুন। জানতে চাইলে কেমন আছি, কেমন কাটলো বছর। বললাম, কবিতাময়…। কী ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তোমার মুখ, জড়িয়ে ধরলে আমায়… আমি পেলাম কবির গায়ে কবিতার গন্ধ…কতোদিন পর !

কেমন কেমন ক’রে সাতটা বছর পেরিয়ে গেল!

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.