সন্তান লালন-পালনের ভার কি শুধুই মায়ের?

রাবেয়া জাহান আভা: আমি নারী, আমি মা। যেদিন থেকে আমার সন্তানটির অস্তিত্ব আমি ধারণ করতে শুরু করলাম আমার শরীরে, আমি অনুভব করতে চাইলাম ‘ও আমাদের সন্তান’। আমার একার না, আমাদের। সম্ভবত সব পুরুষই প্রথম সন্তানের বেলায় যে আনন্দ আর উচ্ছাসে ভরা থাকে, তা কি আদৌ থাকে সন্তানটি জন্মের পর? কিংবা দ্বিতীয়টি, তৃতীয়টি, বা পরের সন্তানগুলোর বেলায়? একটা ছোট মাংসপিণ্ড থেকে পূর্ণ মানুষে রূপান্তরিত হতে যে সময়টা যায়, একজন নারী প্রতি মূহুর্তে তার আগমনে আনন্দ, উদ্দীপনা, আশা, ভয় কিংবা আশঙ্কায় কাটাতে থাকে। আর শারীরিক যে অস্বস্তিগুলো তাকে প্রতি মূহুর্তে দুর্বল করে তোলে, তাকে সে মেনে নিতে চায় স্বাভাবিক হিসেবে, অনাগত সন্তানের অপেক্ষায়।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে আমি ছোটবেলা থেকে শারীরিকভাবে একটু বেশিই সুস্থ। সাধারণ জ্বরজারি ছাড়া তেমন কোন অসুস্থতা আমাকে ভোগায়নি। তাই প্রথম সন্তান জন্মের আগে আমি তেমন কোন অসুস্থ্যতা বোধ করিনি। বরং ঢাকা শহরে কাজের সাহায্যকারীর অভাব থাকায় ছয় মাস পর্যন্ত ঘর মোছা থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজ আমি নিজেই করতাম। আর অফিসের সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝেও সঙ্গীর যে অপরিসীম সাহায্য আর ভালোবাসা আমি পেয়েছি সেই সময়, তা অস্বীকার করাটা অকৃতজ্ঞতারই নামান্তর।

সন্তান জন্মের আগে যে সময়টা অতিক্রান্ত হয় তা একেকজন নারীর একেকরকম। শারীরিক অসুস্থতার ধরন ভিন্ন হলেও  সব নারীর মাতৃত্বকালীন অনুভূতি প্রায় একই। অথচ এই যে সন্তানটি জন্ম নেবে তার আনন্দ একজন মায়ের যেমন, তেমনি একজন বাবার, একটা পরিবারেরও। একটা সন্তানের আগমন যদি একটা পরিবারে আনন্দবার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তাকে ঘিরে উদ্বেগ, উৎকন্ঠাও তো পরিবারেরই হওয়া উচিত। সেই পরিবার যে পরিবারকে আমরা যৌথ পরিবার বলি। যে পরিবারে সন্তানটির শুধু মায়ের দিকের আত্মীয়দের উপরই সে দায়িত্ব বর্তাবে না, বরং তার আনন্দ অংশটুকুর সাথে তাকে ঘিরে সব দায়িত্বই বর্তাবে তার বাবার দিকের আত্মীয়দের উপরও। সন্তানের বাবাকে বাদ দিলে আর ক’জনই বা আছেন যে বৌয়ের জন্য ভাবেন, তাদের সন্তানটির জন্য ভাবেন।

আমার শ্বশুরবাড়ির পরিবার বলতে আমার শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ নেই। যদিও আতিথেয়তার প্রশ্নে অনেকেরই উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবু আমার এই চাকরিজীবী শাশুড়িও আমার চরম শারীরিক অসুস্থতায় আমার কাছে এসেছেন নিছক ছুটি কাটাতে। নিজেকে তার সন্তান বলে উপলব্ধি দিতে না পারাটাই হয়তো আমার অযোগ্যতা।

রাবেয়া জাহান আভা

আমার মতো গৃহিণী যারা তাদের না হয় একমাত্র কাজ সংসার আর সন্তান লালন পালন করা। কিন্তু যেসব কর্মজীবী মা আছেন তারা কি অফিসে স্বস্তিতে থাকতে পারেন ছোট্ট সন্তানটিকে বাসায় ফেলে এসে? দেশ এবং বিদেশ সব মিলিয়ে আমার দেখা যেসব নারী চাকরি বা পড়াশোনা করছেন তারা সন্তানটিকে রাখছেন হয় নিজের মায়ের কাছে কিংবা তার নিজের কাছে। এখানে আসার পরে আমার কেবলই মনে হচ্ছে সন্তান জন্মদান না হয় সৃষ্টিকর্তা একজন নারীর জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন, কিন্তু সন্তান লালন-পালন কি শুধুই একজন মায়ের? বাবাদের জন্যও নয়?

বাবারা যে পারে না, তা কিন্তু নয়। বরং তাদের ইচ্ছার অভাব। আমি মা হয়ে পেটে ধরেছি বলে আমার যে টান একটা সন্তানের জন্য তার সাথে কখনোই তুল্য নয় বাবার টান। তবে তাদেরটাও কম নয় কোন অংশে। বাবারা যে অপারগ সেটা মানতে নারাজ আমি। কয়েকটা উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হবে।

আমি দেশের বাইরে থাকি। এখানে যেসব বিবাহিত পুরুষ পড়তে আসেন তারা অধিকাংশই বউ-বাচ্চা নিয়ে আসেন। যারা নিয়ে আসেন না, দেশে তাদের সন্তানের দেখাশোনাও করেন কিন্তু একজন মা, চাকরি করুন আর নাই করুন। পরিবারের একসাথে থাকা ছাড়াও বাচ্চারা একটা ভালো স্কুলে পড়বে, এটা একটা বড় কারণ। আর বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে সন্তানটি পড়ার বয়স না হলেও তাকে মায়ের সাথেই থাকতে হয়। কারণ তাকে রাখার কেউ নেই।

কয়েকদিন আগে আমার অন্যদেশীয় এক প্রতিবেশীর স্বামী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এখানে সন্তান রাখার সুব্যবস্থা করতে না পারলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেশে ফেরত যেতে। অথচ তিনি পড়তে এসেছেন স্কলারশিপ নিয়ে আর দশটি পুরুষের সাথে মেধায় পাল্লা দিয়ে। অগত্যা বাচ্চাটির স্থান হয় পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডে-কেয়ারে। উনি যখন এখানে আসেন তখন প্রথম কয়েক মাস সন্তানটি ছিলো বাবার কাছে। বাচ্চাটিকে রাখতে আসা স্বামীটি এখানে আছেন গত একমাস যাবত, এবং আমি লক্ষ্য করেছি যখন উনি ক্লাসে যান বাচ্চাটিকে কী নিশ্চিন্তেই না রেখে যান তার বাবার কাছে। ঠিক যেমনটি একজন বাবা রেখে যান সন্তানটিকে তার মায়ের কাছে।

আমি যদি আমার দেশের ‍উদাহরণ দেই, এমন হাতে গোনা দু’একজন ছাড়া কোন পুরুষ কি আছেন যিনি তার সন্তানটিকে (দুধ খাওয়া সন্তান ছাড়া) তার স্ত্রীর পড়াশোনা বা চাকরির সাহায্যের জন্য নিজের কাছে রেখেছেন (যখন দুজনের পোস্টিং আলাদা)? দু’একজন থাকলেও থাকতে পারেন তবে আমার জানা মতে একজনও নেই আমার চেনা পরিসরে। আমি অধিকাংশ ‍স্ত্রীকে দেখেছি তাদের স্বামীর ক্যারিয়ার, পড়াশোনার জন্য সহায়তা করতে (আমিসহ) কিন্তু খুব কম স্বামীকেই দেখেছি তাদের স্ত্রীদের জন্য ভাবতে, বিশেষ করে সন্তানের প্রশ্নে। অথচ একটা সন্তানের কাছে তার বাবার গুরুত্বও কম নয়।

আমার ছেলের সঙ্গে একটা নেপালি মেয়ে পড়ে। মেয়েটির মা দেশে একটা এনজিও’তে চাকরি করে। এখানকার পিএইচডি’র ছাত্র বাবার সাথে থাকে মেয়েটি। একজন মা একা পড়াশোনা করে সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে যে দশা হয় মেয়েটির বাবার অবস্থা তার থেকেও করুণ মনে হয় আমার কাছে। বাবাটি সব সামলে হয়তো নিজেকে পরিপাটি করতে পারেন না, তবে মেয়েটির যে খুব যত্ন নেন তা তাকে দেখেই বোঝা যায়। অন্তত প্রতিটা ক্ষেত্রেই মায়ের ভূমিকায় ওর বাবাকে দেখি।

বলা যায়, মেয়ের ছায়া হয়ে থাকেন তিনি। আর কয়েকমাস পরপর যখন মেয়েটির মা এখানে আসে, আমি যে দু’একবার কথা বলেছি তার সাথে, কি কৃতজ্ঞতা নিয়েই যে বলেন স্বামীর এই ত্যাগের কথা, আমাদের দেশে একজন পুরুষকেও আমি আজ পর্যন্ত বলতে শুনিনি এভাবে। হয়তো তারা ধরেই নিয়েছেন সন্তান লালন-পালন নারীদের জন্যই নির্ধারিত।

আরেকজন শ্রীলংকান পুলিশ অফিসার যিনি পাঁচ বছরের জন্য কোনরকম বেতন ছাড়াই চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছেন স্ত্রীর পড়াশোনায় সাহায্যের জন্য। আমাদের দেশের একজন স্ত্রীর ভূমিকা পালন করছেন তিনি। তিনটি সন্তানের দেখাশোনা, স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসা সবই করেন তিনি। সেদেশে নাকি ছুটি নেয়ার এরকম সুযোগ আছে। আর আমাদের দেশে এরকম সুযোগ থাকলেও বেড়াতে আসা ছাড়া স্বামীরা এভাবে এসে নিরর্থক বসে থাকবেন না নিশ্চয়।  

আমার দেশ কিংবা পাশের দেশগুলোর উদাহরণ যদি দিই, শুধু সন্তানের জন্যই একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অনেক শিক্ষিত নারীই কিছু করতে পারেন না। যে কয়জন নারী পারেন সেটা তাদের নিজের পরিবারের সাপোর্ট পান বলেই পারেন। আর যারা পারেন না তারা সন্তানকে সময় ‍দিতে দিতে নিজের জন্য কিছু করার ইচ্ছাশক্তিটাও হারিয়ে ফেলেন।

আমার নিজের কথাই যদি বলি, ভালোবেসে বিয়ে করা বর সাংবাদিকতা অপছন্দ করতো বলেই তা ছেড়েছি স্বেচ্ছায়। সা্ংবাদিকতা আর পুলিশের চাকরি নাকি একই। অন্য কোন চাকরির চেষ্টায় বরের দেয়া উৎসাহেই এমবিএ করেছিলাম। আমার চাকরি করা প্রসঙ্গে বরাবরই আমার চাকরিজীবী শাশুড়ি তার ছেলেকে ‘বউ চাকরি করলে গরম ভাত খেতে পারবে না’ এই কথা বলে নিরুৎসাহিত করতেন। সাপোর্টিভ মেন্টালিটি থাকা বর ক্রমশ নিরুৎসাহ বোধ করতে থাকে আমার কিছু করার ব্যাপারে। এই নিরুৎসাহ আমাকেও গ্রাস করতে শুরু করে। আমিও হারিয়ে ফেলি ইচ্ছাশক্তি। সন্তান আর সংসারের চার দেয়ালে হয়তো বেঁচে থাকার ইচ্ছা শক্তিটাও হারিয়ে ফেলবো একদিন।    

অথচ একটু সদিচ্ছা আর নির্ভরতার ভালোবাসা থাকলে একজন পুরুষই পারে তার স্ত্রীর পড়াশোনা কিংবা ক্যারিয়ারের জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে উঠতে। আর এর মধ্য দিয়ে একজন নারীর চোখে সেই পুরুষটি কেবল একজন স্বামীই নন, বরং প্রিয় বন্ধুও হয়ে উঠতে পারেন।          

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.