এ আমার গর্ব, এ নয় অহংকার

নাঈমা চৌধুরী: যখন দেশে ছিলাম আমার প্রবাসী আত্মীয় বন্ধুদের বলতে শুনতাম বিদেশে থাকলে দেশের জন্য টান বা ভালোবাসা কতটা তা টের পাওয়া যায়। তখন ঐ অর্থে অনুভব করতে পারিনি তাদের কথা। কখনও বিদেশে বেড়াতে গেলে ফিরে এয়ারপোর্টে নেমেই সব নেতিবাচক দিকগুলো চোখে পড়ে মেজাজ খিঁচড়ে যেত, মনে হতো কবে বদলাবে দেশের অবস্থা?

কিন্তু তখনও যদি বাইরের কেউ আমার দেশের বদনাম করত আমার সামনে, তাকে ছেড়ে কথা বলতাম না। তবে এখন প্রবাসী হয়ে বুঝি নিজের দেশ যেমনই হোক তা সে নিজেরই। হয়তো অনেক বছর এখানে থাকার পর এই দেশটাকেও আপন ভাবতেই শিখবো, তবু দেশের কোনো ভালো খবরে গর্বে যেমন বুক ভরে যায় তেমন কি হবে কখনও? জানি না।

আমার এক প্রাক্তন বন্ধু একবার আমাকে বলেছিল, “Pride is a racket feeling.” এটা জানার পর সে নাকি আর কোনোকিছু নিয়ে খুশি হলেও গর্ব অনুভব করে না। আমি জানি, এটা নিয়ে তর্ক করতে গেলে সে নানা থিওরি দিয়ে আমাকে ভুল প্রমাণিত করার চেষ্টা করতো, তাই আর তর্কে যাইনি।

নানা মুনির নানা মত যেমন আছে, তাতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার পূর্ণ স্বাধীনতাও মানুষের আছে বলে আমি মানি। তাই নিজের অবস্থান থেকে তার প্রতি এবং উপরোক্ত মতবাদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে তাকে শুধু বলতে ইচ্ছা করেছে, একবার বিদেশে এসে থেকে দেখ, বাংলাদেশের নাম শুনে যখন কোনো বিদেশী বলে ওঠে, “ওহ্ বাংলাদেশ! তোমরা তো খুব ভালো ক্রিকেট খেল!” তখন যেটা অনুভব করিস, সেটা গর্ব নাকি অন্যকিছু?

কোনো মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখিস, যার সন্তান প্রথম হাঁটতে শিখেছে বা আধো আধো বোলে ছড়া বলতে শিখেছে, আর তিনি এমনভাবে সবার দিকে তাকাচ্ছেন যেন পৃথিবীর আর কোনো শিশু এমনটা করেনি। অথবা সেই মায়ের দিকে যার অটিস্টিক কিশোর সন্তান ছবি তোলা শিখেছে, আর তিনি প্রচণ্ড গর্ব নিয়ে তা পোস্ট করেন ফেইসবুকে। কিংবা সেই প্রিয়া, প্রিয় মানুষটির ছোট ছোট সাফল্যেও যে গর্বিত হয়ে বারংবার চোখের কোল মুছে, তারপর কেউ দেখে ফেললো কীনা ভেবে শংকিত হয়ে তাকায় আশেপাশে। জিজ্ঞেস করো সেই প্রৌঢ়া স্ত্রীকে যিনি সারাজীবন সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছেন অভাবে অনটনে কিন্তু শেষবেলায় এসে যার স্বামী সততার জন্য পেয়েছেন বিশেষ সম্মান তখন কী অনুভূতি হয়েছিল তার। তাদের এই অনুভূতির মতো খাঁটি আর কিছু হতে পারে না।

প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে গর্বিত হবার মতো। নিজের সীমিত জ্ঞানে যতটুকু জানি Authentic (খাঁটি) এবং hubristic pride (ঔদ্ধত্যমূলক গর্ব)এর মধ্যে তফাৎটা বিস্তর। Hubristic pride মানুষকে arrogant egoistic করে তোলে। সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কোনো এক সন্ধ্যায়, বাসের জন্য অপেক্ষমান অবস্থায় হঠাৎ যদি একগাদা ইংরেজী লেখার ভিড়ে চোখে পড়ে যায় সামান্য কিছু বাংলা লেখা, আর মনে পড়ে যায় ভাষার জন্য এমন আত্মত্যাগের ইতিহাস পৃথিবীতে আর কোথাও নেই, তখন যা অনুভূত হয় তা গর্বই।

আমার এই গর্ব বা অনুভূতি সাময়িক বা ঋতুকেন্দ্রিক ব্যাপার নয় – তা চিরন্তন, তা সত্য এবং খাঁটি । আর তাই এই প্রবাসেও বাংলাদেশকে আমি ধারণ করি হৃদয়ে, বাংলা ভাষা ও বাঙালীয়ানাকে লালন করি নিজের জীবনে। বিশেষ বিশেষ দিনে আমি বাংলাদেশী হয়ে উঠি না, আমি সারা বছর বাংলাদেশী। বাংলা ভাষার জন্য আমার আবেগ, ভালোবাসা শুধু ফেব্রুয়ারি এলে উথলে ওঠে না।

আমি সেই দলভুক্ত নই যারা একুশে ফেব্রুয়ারিতে বা স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস এলে বিশেষ রঙের পোশাক পরে, ফুল হাতে দেশপ্রেমিক, ভাষাপ্রেমিক সেজে তথাকথিত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান এবং সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারকে অবলীলায় বানিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ।

আমার এই ভালোবাসা পোশাকী বা ফেইসবুককেন্দ্রিক নয়। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা আমার সুসময়ের বন্ধু নয়, সবসময়ের বন্ধু – এ আমাকে ছেড়ে যায় না কখনও। এ আমার অহংকার নয়, আমার গর্ব। একজন বাঙালী হিসাবে এই গর্বে আমি গর্বিত হব বারংবার। আর তা এই ছবির বাংলা লেখার মতোই লুকানো থাকবে “বুকের ভেতরে, খুব অভ্যন্তরে, গভীরে কোথাও।”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.