ফারজানা নীলা: দুটো ভিন্ন জীবন মেয়েদের পার করতে হয়। এক, বিয়ের আগে দুই, বিয়ের পর। জন্ম থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত যে জীবনে সে অভ্যস্ত সে জীবন ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন আলাদা জীবনে তাকে অভ্যস্ত হতে হয়।
হোক ভালোবাসার বিয়ে বা এরেঞ্জ। মেয়েকেই কিন্তু নিজ পরিবার বাবা-মা-ভাইবোন থেকে দূরত্ব নিয়ে স্বামীর বাসায় গিয়ে উঠতে হয়। এরপর শুরু হয় আমূল পরিবর্তন। হয়তো সে বাবার বাসায় যেমন-তেমন একটা কামিজ/টিশার্ট/পাজামা/ট্রাউজারেই কাটিয়ে দিতো, শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হবে টিপটপ পোশাকে, একটু রয়ে সয়ে, একটু লাজ লজ্জার ঘোমটা টেনে। যা সে বাবার বাসায় কোনদিন খায়নি, সেটি হয়তো শ্বশুরবাড়িতে খেতে হয়।
যে বারান্দায় সে বিকেল কাটাতো নিজের সাথে, সেখানে তাকে চায়ের ট্রে সাজাতে হয়। রাত জেগে যার বই পড়ার স্বভাব, সকালে হয়তো ছুটির দিনে দেরিতে উঠার অভ্যাস, সেখানে তাকে ঠিক সময়ে লাইট অফ করতে হয়, সকালে উঠতে হয় সকলের নাস্তা বানাতে, বা অন্তত নাস্তার টেবিলে থাকতে। বিকেলের বন্ধুদের সাথে আড্ডা তার থেমে যায়, যখন-তখন ঘুরে বেড়াতে তার সংকোচে লাগে।
অপরদিকে জামাই হিসেবে ছেলেদের অন্য বাড়িতে গিয়ে মেনে নেওয়ার পর্ব নেই। বরং তার মন জুগিয়ে চলার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যেহেতু সে জামাই। সবচেয়ে বড়, তাকে তার বাবা-মা ছেড়ে আসতে হয় না। তাকে কেউ বলে না, তুমি পরের আমানত, তোমার আসল ঠিকানা তোমার শ্বশুরবাড়ি। ছেলেদের জন্য শ্বশুরবাড়ি বেড়ানোর জায়গা, মেয়েদের জন্য আসল ঠিকানা।
একটি অযৌক্তিক এবং খুব অপমানজনক নিয়ম হলো মেয়েদের নাম পরিবর্তন। মিস থেকে মিসেস। অথচ পতিদেব কিন্তু মিস্টারই থাকে। কপালে পরতে হয় সিঁদুর, হাতে চুরি, নাকে নাকফুল, গলায় চেইন। যাতে মেয়েদের বিবাহিত লাগে। লাগতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে মেয়েটি কারোর সম্পত্তি।
সোজা বাংলায় মেয়েটি আর খালি নেই, সে এখন আরেকজনের অধীন। বিয়ের পর মেয়ে যদি ছেলের অধীনে যায় তাহলে ছেলেও তো একটি মেয়ের অধীনে চলে যাওয়ার কথা, তার ক্ষেত্রে কোনো অলংকার নেই কেন? স্বামীর মঙ্গলের জন্য মেয়েদের এসব পরতে হয়, তবে স্ত্রীর মঙ্গলের জন্য কিছু পরে না কেন স্বামীরা? হায়, স্ত্রীর মঙ্গল কি কেউ কামনা করে না?
এই সমাজের বিয়েতে স্বামীরা বউদের অধীনে যায় না, যায় না বলেই তাদের শরীরে বাড়তি কিছু নেই। বউরা স্বামীর অধীনে যায় বলেই তাঁকে পরিবার ছেড়ে উঠতে হয় স্বামীর বাড়িতে।
শুধু কী নিজের নাম! সন্তানের নামের সাথে যোগ করতে হয় স্বামীর নাম বা স্বামীর পরিবারের নাম। কী অদ্ভুত সমাজের নিয়ম! মাসের পর মাস নিজের শরীরে সন্তান বহন করে নারী, জন্মের সময় অকল্পনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে নারী, আর সন্তানের নামের সাথে মায়ের নামের কোনো অস্তিত্ব রাখে না কেউ।
বাবা-মায়ের চোখের মনি তো ছেলেমেয়ে সবাই। কিন্তু চোখের মনির একটি অংশ মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে অনুমতি নিয়ে বাপের বাড়ি আসতে হয়। আবার ঘন ঘন গেলে কথা উঠে মেয়ে তো বাপের বাড়িতেই পড়ে থাকে। অথচ কেউ মনে করিয়ে দেয় না, আপনাদের ছেলে কিন্তু আপনাদের সাথেই থাকে, সে যেমন আপনাদের সন্তান, তেমনি আপনাদের ঘরের বউটিও কিন্তু কারো সন্তান।
পরিবারের সকলের খেয়াল রাখার দায়িত্ব হুট করেই বাইরে থেকে আসা একজনের উপর অর্পিত হয়ে যায়। কারণ “বউয়ের কাজ সবাইকে দেখে রাখা”। নতুন জীবনে পা দিলে খুব স্বাভাবিকভাবেই কিছু ভুল-ভ্রান্তি হবে, সবকিছু জেনে বুঝে নিতে সময় লাগবে। কিন্তু এই সময় দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া আর চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে ফারাক আছে বিশাল। যে ছেলেটি আপানদের সাথে জন্ম থেকে বড় হয়েও সকলের দায়িত্ব নিতে হিমশিম খায়, সেখানে জীবনের অর্ধেক সময় থেকে এসে একজন বউ কীভাবে সকলের মন জুগিয়ে চলবে! একজনকে দেখতে গেলে অন্যজনের ভাগে কম পড়লে আশেপাশে হিসপিশ পড়ে যায়।
হাজারো পরিবর্তনের সাথে যাকে প্রতিনিয়ত মেনে চলতে হয়, তাঁর স্বাভাবিক ভুলের জন্য যখন তাকেই কাঠগড়ায় উঠতে হয় তখন মেয়েটি বড্ড একা হয়ে পড়ে।
আবার অনেকে বলে “শ্বশুরবাড়ি না থেকে স্বামী-স্ত্রী আলাদা সংসার করলেও তো মেয়েকে নতুন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়” তখন? হ্যাঁ, তখনও নতুন জীবন, অনেক পরিবর্তন। তবে সেটা দুজন মিলে নতুনভাবে সবকিছু গড়ে, সাজায়, বানায়। আপনি নিজে যা প্রথম থেকে গড়বেন, সেটার সাথে আগে থেকে গড়ার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য বিপুল।
জগতের সকল নিয়ম যেন মেয়েদের বিপক্ষেই বানানো। হোক সেটা শারীরিক বা সামাজিক। কেন রে ভাই, কেন একটাও সমান সমান নিয়ম বানানো হয়নি? দেখুন তো কেমন লাগে নিজ পরিবার ছেড়ে অন্য পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নিতে হলে, অন্যদের মন মতো চলতে ফিরতে কাজ করতে, না চলতে পারলে কথা শুনতে? পারবেন হে পুরুষমহোদয়গণ?