শাশ্বতী বিপ্লব: আমার এক নিকট আত্মীয়ার “এইম ইন লাইফ” ই ছিলো একজন ভালো গৃহবধু হওয়া। মজার মজার রান্না করবে, সন্তান পালবে, আর বরের সাথে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াবে। একজন প্রতিষ্ঠিত বর তার সারা জীবনের স্বপ্ন।
ছোটবেলা থেকে সুন্দরী হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম। পদে পদে বিয়ের প্রস্তাব পায়। সে এক এলাহী ব্যাপার! কোথাও নিয়ে যাওয়ার জো নেই। কারো ভাইয়ের জন্য, কারো বন্ধুর জন্য, কারো দেবরের জন্য বা কারো ছেলের জন্য ঠিক সম্বন্ধ এসে যেতো। ভাববেন না সুন্দরী বলে সে সারাদিন শুধু রূপচর্চা করতো। বরং একজন সফল গৃহবধু হওয়ার আশায় মাস্টার্স এর পরীক্ষার পর নানা রকম রান্না শিখলো খুব মন দিয়ে। আমরা নিশ্চিত জানতাম ও অনেক সুখী হবে। রুপবতী, গুণবতী, চাকরি-বাকরি করার ধান্ধা নেই, একদম সংসারী লক্ষীমন্ত মেয়ে। সবাই যেমনটা চায়।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। অনেক বেছে-বুঝে তাকে বিয়ে দেয়া হলো। এবং সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে সেই বর ওর এই শুধু গৃহবধু হতে চাওয়ার ইচ্ছাটাকেই সবচেয়ে অপছন্দ করে বসলো।
অফিস থেকে ফিরে মজার মজার খাবার সাজানো টেবিল এবং বরকে সেবা করার ব্যস্ততায় বর সাংঘাতিক বিরক্ত হয়ে উঠলো। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বললো, সারাদিন ঘরে বসে থাকো কেন? খবরদার আমার জন্য সারাদিন রান্নাবান্না করবে না। লেখাপড়া শিখেছো কী শুধু রান্না করার জন্য, যত্তসব!
আত্মীয় স্বজনের তো চক্ষু চড়কগাছ! বলে কী লোকটা!
এদিকে মেয়েরও ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা। আমার সাথে দেখা হলেই চাকরির খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে। আমার কী অনেক কষ্ট হয় নাকি জানতে চায়, বুঝতে চায়। চাকরির কষ্টে তার দারুণ ভয়।
এদিকে অশান্তি ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলো। মেয়েটি সাজলেও প্রশংসা তো দূরে থাক, তাকিয়েও দেখে না সেই বর। তার একটাই কথা, ঘরে বসে থাকা চলবে না। আয়মূলক না হোক, কিছু একটা তাকে করতে হবে। সারাদিন ঘরে বসে হাড়ি ঠেলা আর সাজুগুজু তার অপছন্দ। অশান্তি এমন চরমে উঠলো যে সংসার ভাঙ্গে ভাঙ্গে অবস্থা।
অগত্যা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম মেয়েটার জন্য একটি চাকরি জোগাড় করতে। চেষ্টা তদবির করে মোটামুটি একটা কাজ জোটানো গেলো। সংসারের অশান্তিও অনেকটা কমে এলো। আমরা ভাবলাম, কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য! এমনও হয় নাকি!!
এই ঘটনাটা ব্যতিক্রম, সচরাচর ঘটে না। কিন্তু আমার সেই আত্মীয়া একা নয়, অনেক মেয়েরই একমাত্র লক্ষ্য থাকে গৃহবধু হওয়া। একটা-দুইটা ডিগ্রী নিয়ে নিজেকে বিয়ের বাজারে উপযুক্ত করে তোলা। তারপর একটি ভালো (!) বর দেখে, ভালো দেনমোহর ধরে বিয়ে করে ফেলা। ভালো বর মানে ভালো ক্যারিয়ার, ভালো ইনকাম, বাড়ি, গাড়ি, এই আরকি। ব্যস, জীবনের লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেলো।
তো? হলোই বা গৃহবধু, তাতে সমস্যা কী?
সমস্যা তেমন হতো না। কিন্তু গোল বাঁধে যখন আমরা এই জায়গায় এসে সমঅধিকারের, সমমর্যাদার দাবি জানাই।
একটি ছেলে ছোটবেলা থেকে জানে তার অনেক দায়িত্ব। তাকে ভালো আয় করতে হবে। প্রথমতঃ বাবা-মায়ের, পরে নিজের সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। সে বিয়ে করবে, তার নিজের সংসার হবে, সেই সংসারে তার বউ থাকবে, সন্তান থাকবে, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তার। এসবই তার জীবনের পরিকল্পনা, তার সম্পত্তি, তার অর্জন।
অন্যদিকে মেয়েটি ছোটবেলা থেকে শেখে তাকে আরেকজনের সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, দেবর, অনেকের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সে পালন করবে ভরণপোষণের বিনিময়ে। শুনতে খারাপ লাগলেও, এটাই সত্যি। সে কোনো আয় না করলেও সমস্যা নেই। তার ভরণপোষণের দায়িত্ব তার বরের।

নিজের বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেয়ার কথা খুব কম মেয়েই ভাবে। বাবা-মায়েরাও মেয়ের কাছে সেটা আশা করেন না। আশা করেন না বলেই মেয়েকে “বিয়ে দিয়ে পর করে দেয়া”-র মতো ধারণা ও বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত। দিতে পারার সক্ষমতার সাথে আপন পরের সংজ্ঞাও ওঠানামা করে। বিয়ের বাজারে “মেয়ের বেকারত্ব” নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামিয়েছে বলে শুনিনি।
এই যখন পরিস্থিতি, সংসারে একজন যখন দাতা এবং অন্যজন গ্রহিতার ভূমিকায়, তখন সমঅধিকার বলি বা সমমর্যাদা, এগুলো চেয়ে চেয়েই নিতে হবে বৈকি। মায়াকান্না কাঁদতে হবে। কথা দিয়ে, তত্ত্ব দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে মেয়েরাও মানুষ। মেয়েরা মায়ের জাত। সে তোমার সংসারের কত কাজ করে। তোমার বাচ্চাদের লালন-পালন করে। এগুলোরও অর্থমূল্য আছে, সেটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। আরও বোঝাতে হবে কেন তার দেনমোহর প্রাপ্য, কেন তার ভরণপোষন প্রাপ্য।
মেয়েরা বন্ধুমহলে বা আত্মীয় স্বজনের কাছে যতই সুখী সুখী মুখ করে বেড়াক, ঘরে সে কখনই সমান হতে পারবে না। মুখে যতই চাপাবাজি করুক, মনে মনে সে অধঃস্তন। বেশি কিছু বলার বা করার ক্ষমতা তার নেই। সংসারে যে কামাই করে, তার কথাই শিরোধার্য। তার ইচ্ছাই নিয়ম।
“আমি কষ্ট করে কামাই করে আনি, আর তোমরা বসে বসে খাও” – এই বাণী যতদিন এই সমাজ বিশ্বাস করবে ও মেনে চলবে, ততদিন শত গবেষণা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, নীতিমালা আর সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজে আর যাই হোক, সমান দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে না। হোক সে সন্তানের কাস্টডি কিংবা সম্পত্তির উত্তরাধিকার। “কামাই” ই যেখানে মাপকাঠি, সেখানে “কামাই” কে উহ্য রেখে সমমর্যাদার আশা দুরাশাই বটে।
আর হ্যাঁ, নারীর আয়মূলক কাজে যারা বাঁধা দেন, তাদেরও ভয়টা ওখানেই। শুধু ঘরে নয়, ঘর ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজে, ধর্মে, সব জায়গাতেই নারীর অধঃস্তনতার মূল রহস্য লুকিয়ে আছে নারীর শরীরে নয়, তার অর্থনৈতিক সক্ষমতার ভিতর। নারীরা যত বেশি নিজেকে আয়মূলক কাজে সম্পৃক্ত করবে, তত বেশি সে মুক্তির দিকে এগিয়ে যাবে। নারীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কোন জীবন বেছে নেবে।