পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক অবশ্যই জরুরি

শিল্পী জলি: অভিনেত্রী অপি করিমের বিয়ে হতেই উইমেন চ্যাপ্টারে এক লেখিকা লিখেছিলেন, তিনি কেন আবারও বিয়ে করলেন! আমার খট্কা লেগেছিল–
মন্তব্য করেছিলাম, কেন তিনি বিয়ে করবেন না?
তাহলে তিনি কি লিভ টুগেদার করবেন?
নাকি তিনি শারীরিকভাবেই অক্ষম যে, বিয়েরই দরকার নেই?
আর যাই কোথায়, সরাসরিই আক্রমণ– সম্ভবত আমাদের তিনজনকে।
সাথে সাথেই উইমেন চ্যাপ্টারে লিখলাম আমার প্রশ্নকে আক্রমণ করা হয়েছে, আমার জবাব ছাপাতে হবে। সম্পাদক বললেন, অবশ্যই।
আরও কিছুদিন পর দেখলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আকতার জাহান জলির মৃত্যুতে দেশের নামকরা একজন সাংবাদিক তাঁর প্রাক্তন বরের গুণকীর্তন গাইছেন, এবং যাবতীয় দায় চাপাচ্ছেন জলির উপর। বিরোধিতা করলাম। আমাদের অনেকেই তখন লিখেছিলেন। দেশের বাইরে থাকলে এই এক সুবিধা, নিরপেক্ষ থেকে লেখা যায়।

Shilpi Jolley 2সম্প্রতি বিশ্বাস তীর্থ নামে একজন উইমেন চ্যাপ্টারে ‘নারী বিরোধী’ একটি লেখা লিখেছেন। লেখাটির প্রথম অংশ চমৎকার হলেও শেষের অংশ পুরোপুরি নারী বিরোধী এবং কাঁচা। শেষ অংশ পড়েই বোঝা যায় ওই লেখকের অভিজ্ঞতা কম, বয়স কম, গতানুগতিক চিন্তাধারার মানুষ। মেয়েদের বেশভূষা, পজিশন, ভোটাধিকার দেখেই তিনি তাদের জীবন এবং সুখটি সজ্ঞায়িত করেন, ভেতরের খবরটি জানেনও না, বোঝেনও না। আমাদের সমাজেরই পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি তিনি তুলে ধরেছেন।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, উইমেন চ্যাপ্টার কেন এমন লেখা ছাপবে!
আমি বলি, কেন ছাপবে না, অবশ্যই এমন লেখা ছাপবে। ছাপলেই বরং সবাই বুঝতে পারবে ওদের ভাবনা-চিন্তার ধারা-প্রকৃতি। অতঃপর সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে।

আগেও উইমেন চ্যাপ্টারে এমন নারীবিরোধী লেখা ছাপা হয়েছিল আর আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলাম লেখাগুলোকে, লেখিকা/লেখককে, পত্রিকাকে নয়। গুলতেকিন আহমেদ তার জীবনের কথা প্রকাশ করতেই অনেক বিখ্যাত সাংবাদিক অন্য পত্রিকাতে তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন, তখনও আমরা কথা বলেছি।

তীর্থ সাহেব প্রশ্ন তুলেছেন, তসলিমা নাসরিন বা অন্য নারীবাদীরা নারীর জন্যে কী করেছেন? শুধু বিখ্যাত হতেই যত হৈচৈ।
এতেই বোঝা যায় তাঁর পরিপক্কতা/উদারতা/জীবনবোধ কতোটুকু ! নারীকে হাতে ধরে ধরে খাইয়ে দেয়া বা পথ চলানো কোন সহযোগিতা নয়। তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে উদ্বুদ্ধ করাই প্রকৃত সহায়তা। সারাবিশ্বেই নারী কম/বেশী শোষিত। তাই পরিবর্তন দরকার চিন্তাধারায়ই।

taslima-3তসলিমা নাসরিনের ভাষা এবং যৌন সুড়সুড়িতেও তিনি বিরক্ত। বিরক্ত আমরাও যে তাঁকে ওইভাবে লিখতে হয়, এখনও মারের বদলে মার দিয়ে বোঝাতে পারেন না কতটা ব্যথা হয়। অথবা দেশছাড়া হলে কেমন লাগে!
যে সমাজের জন্যে তিনি লিখেন তাঁরা কোমল ভাষায় লিখলে তো পাত্তাই দেবে না, পরিবর্তন তো অনেক দূরের।
বুয়েটের হলের পাশে কিছুদিন থাকার সুযোগ হয়েছিল। তখন শুনেছি বিদ্যুৎ গেলে ছেলেরা কোন ভাষায় গালিগালাজ করে– ঐ ভাষা শুনলে মৃত ব্যক্তিও বেঁচে উঠবে।

একবার দেশের বিখ্যাত দুই কলিগের গল্প শোনার সুযোগ হয়েছিল। একজন আরেকজনকে বলছিলেন, “মশাই অত কথা বলেন না, কী এমন কাজ করেন তাতো জানিই–অফিসে গিয়ে তো দশটা পর্যন্ত অণ্ডকোষই নাড়াচাড়া করেন, অতঃপর যদি কোনো কাজ করে থাকেন, হে হে হে।”
তাদের গল্পের বিষয় এবং শুনে অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, সহকর্মীরা কখনও এ ভাষায় কথা বলে! দেশের শিক্ষিত সমাজই যদি এ ভাষায় কথা বলে, তাহলে পুরো সমাজ পরিবর্তনে তসলিমা নাসরিনের ভাষা তো অতি কোমল।

আর যৌনতা জীবনেরই একটি অঙ্গ। ওটাকে লেখাতে বা বাস্তবে দূরে রাখার পাঁয়তারা করা হয় শুধু মেয়েদের যৌন জীবনকে কন্ট্রোল করতেই। তাই কোনো মেয়ে ওসব কথা মুখে আনলেই পুরুষ সমাজের মাথা গরম হয়ে যায়। কেননা মেয়েরা যত মিষ্টি ভাষায় কথা বলে তাদের কন্ট্রোল ততো সহজে করা যায়। আমাদের এলাকায় মাবু নামে এক মেয়ে ছিল, যার ভাষার দাপটের কারণে তার সামনে কেউ দাঁড়াতেই সাহস করতো না, শোষণ করা তো অনেক দূরের বিষয়। তসলিমা নাসরিন একজন সমাজ সংস্কারক। তাঁর মতো খুব কম লোকই পৃথিবীতে জন্মেছেন এবং জন্মাবে।

মানুষের স্বাধীনতায় কথা, পোষাক, মতামত, ভাষা, সেক্স জীবন, কর্মজীবন সব কিছুরই স্বাধীনতা জরুরি এবং এগুলো লিঙ্গভিত্তিক নয়।
দেশে, সম্প্রতি ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ রেখে মেয়েদের বিয়ের বিষয়ে চুনা লাগানো হলো, অথচ ছেলেরা মোটেই উচ্চবাচ্য করলো না। জমিজমা ভাগাভাগিতেও সমতা নেই। নারীরা প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলীয় নেত্রী যা’ই হোক, পুরুষরাই এখনও সব কলকাঠি নাড়ায়। আর নারীদের বুঝেও না বোঝার ভান করতে হয়– নইলে আমও যাবে, ছালাও। তাই উপর উপর দেখে নারীরা ভালো না খারাপ আছে তা বলা না জায়েজ।
সমাজ একদিনে পরিবর্তন হয় না। তীর্থ বিশ্বাসের লেখার জবাব জান্নাতুন নাঈম প্রীতি খুব চমৎকার করে দিয়েছেন, মিষ্টি ভাষাতেই।

আগেও উইমেন চ্যাপ্টারে নারীস্বার্থ বিরোধী লেখা এসেছে, যা নানা বিষয় উথ্থাপন এবং আলোচনার প্লাটফর্ম তৈরি করেছে। মোট কথা, কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে পক্ষ-বিপক্ষ সবারই সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
পত্রিকা তথ্য আদানপ্রদানের একটি বাহকমাত্র। নারীদের নিরাপদ জীবনের জন্যে আমাদের গণ্ডি শুধু উইমেন চ্যাপ্টারের লেখাকেই নজরদারি করা নয়, বরং পয়েন্ট করে করে জনগণকে বুঝতে সহযোগিতা করা যে, কোথায় অন্যায় হচ্ছে এবং আমাদের মুক্তি কোথায়।

আমার মতে, তীর্থ বিশ্বাস সে সুযোগই করে দিয়েছেন। আশা করছি সবাই এর প্রতিবাদ লেখার মাধ্যমেই করবেন। উইমেন চ্যাপ্টার এতো দুর্বল নয় যে এমন দু’একটি লেখাতেই সে ঘায়েল হয়ে যাবে, বরং এমন লেখা এলেই পরিবর্তনের পথ সুগম হবে। নইলে ছেলেরা আজীবনই মনে এক কথা, আর মুখে অন্য কথা বলে বেড়াবে আর দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথায় ঘায়েল হবে নারী জাতি। অতঃপর প্রেমেরই নাম বেদনা….।

শেয়ার করুন: