বিথী হক: নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে, লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বেশিবার আমার কানে আসা শব্দটি হচ্ছে, “নারীরা কি এখন আর নির্যাতিত? পরাধীন নাকি! পুরুষরাই নির্যাতিত। এখন নির্যাতিত নারীর তুলনায় নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যাই বেশি, সে খবর আপনি রাখেন?”
আমি লজ্জা পেয়ে যাই। আমার চারপাশের সকল নারীরাই তো কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, সে গল্প করেন। তাহলে কী শুধু আমার পরিচিত নারীরাই এমন, বাকি সব নারী পুরুষদেরই নির্যাতন করেন?

ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে বসে থাকা নির্যাতনকারী বউদের নিয়ে গল্প করা এমন কয়েকজন পুরুষকে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, বউরা কীভাবে নির্যাতন করেন? রান্না খারাপ হলে খাবার-দাবার ডাস্টবিনে ফেলে দেন? কথায় কথায় চড়-থাপ্পড় মারেন? বাপের বাড়ি যেতে চাইলে দেন না? আপনার অমতে জোর করে আপনাকে তার সাথে বিছানায় যেতে বাধ্য করেন? উত্তরে প্রত্যেকজন পুরুষই বললেন, “না। নির্যাতন তো শুধু গায়ে হাত তুললেই হয় না আপা, আরো অনেকভাবেই করা যায়!”
তো এই হলো ব্যাপার। পুরুষরা মনে করছেন, নির্যাতনের রকমফের রয়েছে। নারীরা পুরুষদের গায়ে হাত না তুললেও অনেকভাবেই অত্যাচার করেন, মেনে নিলাম। নারীরা তাদের স্বামীদের ওপর নজরদারি করেন, কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কত সময় থাকবেন, কার সাথে থাকবেন, কোথায় থাকবেন, সেসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে চান। নারীরা সবসময় শপিং করার জন্য টাকা চান, পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীর চেয়ে দামি শাড়ি-গয়না চান, এসব পুরুষদের ভালো লাগে না। জবাবদিহিতার কারণে তারা বউদের লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে সময় কাটান। নির্যাতন আরো আছে, বউরা আজকাল ফেইসবুক চালান, অপরিচিত মানুষের সাথে চ্যাটও করেন।
এখন তাহলে বলেন, নারীরা কি আদৌ নির্যাতিত হচ্ছেন? এতোকিছুর পরও কি বলবেন না পুরুষরা নির্যাতিত হচ্ছেন না? জ্বী হচ্ছেন, অনেক নির্যাতিত হচ্ছেন। এবার আপনাদের বউয়ের কথা বলি।
আপনার বউকে সারাদিনে কয়বার ফোন করেন? না, না বাচ্চাদের খোঁজখবর নিতে নয়, বউয়ের খোঁজ নিতে। কয়বার? পুরুষরা এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করেন না। যেসব নারী সারাজীবন ঘরের ভেতর রান্না-বান্না, শাড়ি-গয়না, সাজ-গোজ আর বাচ্চা নিয়ে পড়ে থাকেন, যার জীবনে আপনি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের অস্তিত্ব নেই, যার কাছে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর অপশন নেই তার আসলে সারাদিন কি করে সময় কাটে একবারও ভেবেছেন?
আপনার কাছে তার সিরিয়াল দেখাও বিরক্তিকর, তার ফোন কলও বিরক্তিকর। আপনি যখন তাকে ঘরের মানুষ বানিয়ে ঘরে রেখে বাইরে এসে বন্ধুদের সাথে সিগারেট ফুঁকেন, তখন মনে থাকে বউ কোথায় আছে, কী করছে? সে সময়টা সে যদি ফেইসবুক চালায়, তাতে দোষের কী?
আপনি পরিচিত আপনজন হয়েও যখন সময় দেন না, তখন অপরিচিত জনদের সাথে চ্যাট করলে এতো কথার কী আছে? বাইরের পৃথিবীর সাথে যার কোনো যোগাযোগ নেই, বিশ্ব-রাজনীতি বিষয়ে যার জ্ঞান নেই, বাইরের মানুষজন সারাদিন বাইরে থেকে কী করে, সেসবের স্বাদ যে পায় না, তার তো মানসিক হাসপাতালে থাকার কথা।
সন্দেহ কারা করে জানেন? যারা নিজেরা হীনমন্যতায় ভূগেন, নিজেকে কোনকিছুর যোগ্য মনে করেন না, তারা। আপনার বউ যে আপনাকে সন্দেহ করে, এটা তো আপনারই অবদান। বিয়ের পর যদি বিশ্বাস করে বলতেন, কোনো অন্যায় না করে তার জীবনটা সে নিজের মতো করে যাপন করুক। বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সময় কাটাক, যখন খুশি বাবা-মায়ের কাছে যাক। সবচেয়ে বেশি যেটা করা প্রয়োজন, তাকে উপার্জন করার মানসিকতা তৈরি করে দেবার। এগুলোর কোনটিই যখন আপনি তাকে করেননি, তখন আপনার তাকে আপদমস্তক নির্যাতনকারী বলে মনে হলেও, তার দায় কিন্তু আপনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। এবং এই কথিত নির্যাতনটাই আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি পরিবারের গল্প।
আপনার কাছে তার উপস্থিতি অস্বস্তিকর, তার কথা বলা, জবাবদিহিতা চাওয়াটা নির্যাতন। নারী নির্যাতন অন্য বিষয়, আপনার পুরুষ শরীর ও মন দিয়ে আপনার পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব নয় বলে কয়েকটা মানসিক অমিলকে আপনার নির্যাতন মনে হয়। সে বিষয়ে কখনো আলাদা করে লিখবো, এখন নয়।
দেখলাম এক ভদ্রমহিলা মাছ কেনা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। দুইজন মহিলা কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে নিজেরা মাছ কিনলেন, অপরদিকে দুইজন ভদ্রলোক ফোন কানে রেখে কিছুক্ষণ পর দু:খ-দু:খ চেহারায় পকেটে টাকা থাকার পরেও অনুমতি না মেলায় মাছ কিনতে পারলেন না। লেখিকা ভদ্রমহিলার মনে হলো আহারে পুরুষরাও কত পরাধীন!
এখন আমার প্রশ্ন, আপনি মাছ কিনবেন কীনা সেটা আপনার জামাইকে কেন জিজ্ঞেস করেননি? করেননি, কারণ আপনার মাছ কেনা আপনার জামাইয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। বাসায় গৃহকর্মী না থাকলেও আঁশ তোলা, কাটাকুটির কাজটা আপনিই করে ফেলবেন। আপনার সহানুভূতি পাওয়া ভদ্রলোকদ্বয়ের টাকা থাকলেও এসব কাজকে তারা নারীর কাজ মনে করেন। আপনার আঁশ তোলা, কাটাকুটির কাজটা তারা নিজেরা করবেন, এমন কথা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। বুঝতে পারছেন, আপনি এবং আপনার সহানুভূতি পাওয়া ভদ্রলোক দু’জন কী ভয়াবহ পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক?
ভদ্রলোক দু’জন যদি অনুমতি ছাড়াই মাছটা কিনে নিজেরা পরিষ্কার করে, কেটে, রান্না করে ডাইনিং এ রেখে বউকে খেতে ডাকতেন, তাহলে বউদের মনটা কতখানি কৃতজ্ঞতায়, ভালবাসায় ছলছল করতো, ভাবতে পারছেন?
নিজেদের হয়তো কাজ আছে বা মাছ কাটাকুটি করবার মুড ছিল না, তাই কিনতে না করেছে। কিন্তু জামাই সে কাজটা নিজেই করে ফেললে কী বউটা খুব মাইন্ড করতেন? উত্তর সবারই জানা।
সুতরাং নারী নির্যাতন যেমন পুরুষ কর্তৃক হয়, পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রেও পুরুষরাই পরোক্ষভাবে দায়ী, সে কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। এর জন্য দরকার নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ।
ছোটবেলা থেকেই পুরুষকে যেভাবে ঘরের বাইরের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, নারীকেও একইভাবে সেই সুযোগ দেওয়া হোক। পুরুষ যেমন পৃথিবী ভ্রমণ করেন, পাহাড়ে ওঠেন, বিদেশে পড়াশোনা করতে যেতে পারেন, নিজে উপার্জন করেন; নারীকেও পুরুষের মতোই নিজের পায়ে হাঁটতে শেখান, দৌড়ানো শেখান। নারীকে যেমন সংসার করতে, রান্না করতে, কাপড় কাঁচতে শেখান; পুরুষকেও একই কাজ করতে শেখান।
পুরুষ দেখুক নারীকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া জগতে নারীরা কেমন থাকে, কী করে বাঁচে, আর নারীকে দেখানো হোক পুরুষরা কীভাবে বাঁচে, কী কাজ করে! দু’জন দু’জনের জগৎ দেখলেই কমে আসবে বৈষম্য, কমে আসবে নির্যাতন আর তৈরি হবে নারী-পুরুষের বোঝাপড়ায় নির্যাতনহীন স্বাধীন একটা পৃথিবী। এখন কে, কেমন পৃথিবী চান তার ওপরেই নির্ভর করবে যার যার নিজের পৃথিবীর ধরন।