বনাঙ্কুর বা মেলানিয়া-কেউই নন অশ্রদ্ধার কিংবা ঘৃণার

নাস্তিকের ধর্মকথা: ফেসবুক ওয়ালে সুপ্রীতি ধরের শেয়ার করা বনাঙ্কুর মুস্তাফার বললেই অজগর ধরে নেবেন না প্লিজ! (https://womenchapter.com/views/17183) লেখাটি ভেসে আসায় ঢুঁ দিলাম। সময় সুযোগ থাকলে উইমেন চ্যাপ্টারের লেখাগুলোর উপরে চোখ বুলাই, অনেক লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়িও। এই লেখাটিও পড়লাম, যদিও পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিলো- একটা আলোচনার মাঝখানে এসে যেন যুক্ত হলাম- অর্থাৎ কোথাও কেউ কিছু বলেছেন- লেখক সেসবের জবাব দিচ্ছেন বা জবাব দেয়ার দরকার মনে করছেন না- এভাবেই বিষয়গুলো এগিয়েছে … তার মধ্যেও দু’একটা জায়গায় খটকার মতো লাগলো … যাহোক, লেখার শেষে আগের লেখাটির লিংক পাওয়ায় সেখানেও ঢুঁ মেরে আসলাম … মিডিয়ার মেয়ে আর পুরুষতান্ত্রিক নোংরামি! (https://womenchapter.com/views/16788), এই লেখাটি-বেশ তুলনামূলক পরিপূর্ণ একটি লেখা মনে হলো, ফলে একটানেই পড়লাম।

bona-2
বনাঙ্কুর মুস্তাফা

মোটামুটি সব ঠিকই ছিল- কিন্তু একটা জায়গায় এসে আবারো হোঁচট খেলাম … বহু কুপ্রস্তাব পেয়েছি বাংলাদেশে থাকাকালীন। তার একটাও যদি আমি গ্রহণ করতাম, তাহলে বনাঙ্কুর আর আজকের বনাঙ্কুর হয়ে উঠতো না; হয়তো কোন এক মেলানিয়া ট্রাম্প হতো! – লাইনটা কয়েকবার পড়লাম … তার সাথে মিলিয়ে অন্য প্রবন্ধটাও পড়লাম … এবারে আগের খটকার জায়গাটি পরিস্কার হলো … দুঃখের সাথে বলতেই হচ্ছে, লেখক – বাস্তবে যাদের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে এতো বড় দুটো লেখা লেখলেন, তাদের সাথে বস্তুত চিন্তাগত জায়গায় খুব বেশি দূরত্বে অবস্থান করছেন বলে মনে হলো না … বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বড় আপু শরীর বিলিয়ে টপ রেজাল্ট করেছে- কিংবা মিডিয়ায় যেসব মেয়েরা শরীর দেয় বা দিতে বাধ্য হয়- তাদের প্রতি সমাজে প্রচলিত ঘৃণা আলোচ্য প্রবন্ধ দুটোর লেখক বনাঙ্কুর মুস্তাফা নিজেও ধারণ করেন কিনা, সেই প্রশ্নই মাথায় এলো … কেননা, তার লেখার ভারকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে- তার প্রেক্ষিতে এটা ধরে নেয়া অন্যায় যে, আমরা সবাই সেই প্রতিকূল পরিস্থিতির কাছে হার মেনে আত্মসমর্পণ করছি … অর্থাৎ ঐ সব বাজারি, নোংরা মেয়েরাই যে সবাই নয় – তাদের বিপরীতেও একজন বা একাধিক বনাঙ্কুর আছেন- এবং এরকম বনাঙ্কুররা নীতিতে অটল থেকে দারুণ সংগ্রাম করে যাচ্ছেন- লেখক সেটাকেই প্রধান করে তুলেছেন …।

আমি আসলেই জানতে ও বুঝতে চাই- আজকের বনাঙ্কুর, বনাঙ্কুর না হয়ে মেলানিয়া ট্রাম্প হলে তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? যারা নীতিতে অটল থাকার সংগ্রামটা করতে পেরেছেন, পারছেন- তাদের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা, স্যালুট … কিন্তু যারা মেলানিয়া ট্রাম্প হচ্ছেন, তাদের প্রতি ঘৃণাটা কি আমাদের মানায়? যে সিস্টেম- যে পুরুষতন্ত্র মেলানিয়া ট্রাম্প বানাতে বাধ্য করছে- আবার যে পুরুষতন্ত্র এই মেলানিয়া ট্রাম্পকে ঘৃণাও করতে বলছে- তাদের বিরুদ্ধেই কী সংগ্রামের মূল ফোকাস রাখা উচিৎ নয়? কেননা লেখকের অভিজ্ঞতাতেও উঠে এসেছে- এই পুরুষতন্ত্রই অন্যদেরও মেলানিয়া ট্রাম্প বানানোর চেষ্টা করেছিল বা করে।

দুই

melania-3
মেলানিয়া ট্রাম্প

উপরের আলোচনাটুকু সুপ্রীতি ধরের শেয়ার দেয়া পোস্টের নিচেই করেছিলাম। বনাঙ্কুর মুস্তাফা আমার মন্তব্যের জবাবে গঠনমূলক সমালোচনার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, আমার সমালোচনার প্রথম অংশের সাথে তিনি একমত নন। তার লেখায় কোথাও এরকম নীতিতে অটল থাকতে না পারা মেয়েদের তিনি বাজারি, নোংরা বলেননি; যেটা আমি তার লেখাকে ভুলভাবে বুঝে তার কাঁধে চাপিয়েছি। এছাড়া তিনি মেলানিয়া ট্রাম্প সম্পর্কেও বলেছেন, সে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কনট্রোলড ডল এবং মেয়ে সকলের যে নিজস্ব ভয়েস থাকা উচিৎ- সেই জায়গা থেকেই মেলানিয়া ট্রাম্পের প্রসঙ্গ এনেছেন।

ধন্যবাদ আসলে বনাঙ্কুরকেও দেই, এমন একটি বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করার জন্যে। হ্যাঁ, আমি জানি – এইসব মেয়েরা যারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত নীতিতে অটল থাকতে পারেনি- তাদের তিনি বাজারি বা নোংরা বলেননি। আমার কমেন্টে আমি বলিওনি যে- এমনটা তিনি বলেছেন। (কেননা, তার লেখাতেও আছে: এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। এই মেয়েটাকে কি আমরা খারাপ মেয়ে বলে উপাখ্যান দেব?)! আমি তাদের ব্যাপারে এই “বাজারি” ও “নোংরা” শব্দ দুটো এনেছি- আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন সেটা দেখাতে। এদেরকে এভাবেই দেখতে অভ্যস্ত আমাদের সমাজ, অর্থাৎ আমাদের সমাজের চোখে- এইসব মেয়েরা বাজারি, নোংরা, নষ্টা, ভ্রষ্টা … আলোচ্য লেখার ব্যাপারে আমার সমালোচনার জায়গাটি তাহলে কোন জায়গায়?

সমালোচনার জায়গাটা ওখানেই- কিছু জায়গায় লেখক যদিও বলেছেন- এরা খারাপ না, তার ওভারঅল লেখায়- পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গির শক্ত কাউন্টার বা এই মেয়েদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ানোর চাইতে- সেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ আমি পেয়েছি। হয়তো সচেতনভাবে লেখক এমনটা করেননি, কিন্তু একটু ভালো করে পুনঃপাঠ করলেই হয়তো লেখকের পক্ষেও সেই প্রকাশভঙ্গিটি ধরা সম্ভব হবে। আমি সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ের উপরে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি:

প্রথমত– মিডিয়ার মেয়েরা খারাপ- এরা বসদের বা মালিকদের সাথে বিছানায় যায়, এইরকম সমালোচনার জবাবে কেউ যখন সব মিডিয়ার মেয়েই এমন নয়- বা ভার্সিটির অন্যপথে টপ স্টুডেন্ট হওয়া মেয়েদের অভিযোগের বিপরীতে “তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি আমিও; তবে সে কারণে থেমে যাইনি বা অন্যপথে পা-ও বাড়াইনি এবং আমার মতই আরো শতশত মেয়েকে দেখেছি যারা ঠিকই তাদের নীতিকে দুহাতে দৃঢ়চিত্তে আঁকড়ে ধরে রেখেছে”- কে মূল আলোচ্য করে- তখন বাস্তবে, ঐ সব মেয়েদের প্রতি সমাজের ঘৃণাকে একরকম অনুমোদন দেয়া হয় বলে মনে করি।

দ্বিতীয়ত– লেখক নিজে “বাজারি” “নোংরা”- শব্দগুলো উল্লেখ না করলেও- তার লেখাতেও পরিস্কার যে- এরা নীতিতে অটল নয়- তার কমেন্টের ব্যাখ্যাতেও পরিস্কার যে- এরা মেলানিয়া ট্রাম্প বা কনট্রোলড ডল! ভার্সিটির আপুর গল্পের পাশে ভাইয়ার আলাপ যেভাবে আনা হয়েছে- সেটাও খুব চোখে লাগে … ভাইয়ার শিক্ষকের বাজার করে দেয়া আর আপুর সব বিলিয়ে দেয়া এক নয়- বাজারে পাঠাতে শিক্ষক বাধ্য করে না, কিন্তু একজন মেয়ের শরীরের জন্যে পুরুষরূপী শিক্ষক- নোট দিতে চাওয়া বড় ভাই এমন অনেকেই লোলুপ হয়ে থাকে … কিন্তু দুটোকেই যখন এক কাতারে একইভাবে বলা হয়- তখন সমাজে যেভাবে প্রচলিত- এরা বাজারি, ভালো নাম্বারের জন্যে, ভালো চাকুরির জন্যে, ভালো সুযোগ-সুবিধার জন্যে- এইসব মেয়েরা নিজের শরীর তুলে দেয়- যেন বা ঐ বাজার করা, তেল দেওয়া ভাইয়ার মতোই … সেটাকেই হাওয়া দেয়া হয়।

হ্যাঁ, এইরকম পাশাপাশি লেখক নিজে আনেননি- তার ভার্সিটির বন্ধুরা এনেছিল- যেটায় ঐ সময়ে সায় দেয়ার জন্যে তিনি লজ্জিতও- কিন্তু লজ্জিত হয়েছেন কেন? কারণ তিনি জানাচ্ছেন- আমি তো নিজ চোখে কিছুই দেখিনি, তাহলে কেন (হাসাহাসিতে) অংশ নিলাম! (যদিবা জানতেন কারোর ব্যাপারে- বা নিজের চোখে দেখতেন তারা আসলেই এমন- তাহলে কি হাসাহাসিতে অংশ নেয়া ঠিক হতো?) … আবার ঠিক পরের বাক্যেই তিনি বলেছেন- তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি আমিও; তবে সে কারণে থেমে যাইনি বা অন্যপথে পা-ও বাড়াইনি … এই যে পরক্ষণেই নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলা এবং অন্য পথে পা-ও না বাড়ানোর কথা গর্বভরে জানান দেয়া হলো- সেটার মাধ্যমে বাস্তবে, ঐ আপুদের এরকম অন্য পথে পা বাড়ানোর ঘটনার ব্যাপারে একরকম সায় দেয়া হলো, যেটা আর নিজের চোখে দেখা না দেখার উপর নির্ভরশীল থাকলো না।

melania-2তৃতীয়ত: মেলানিয়া ট্রাম্প আমার আলোচনার বিষয় নয়- তাই মেলানিয়া ট্রাম্পকে লেখক কিভাবে উপস্থাপন করেছেন- সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। আলোচ্য প্রবন্ধে তিনি যখন জানান, কুপ্রস্তাবগুলোর একটাও গ্রহণ করলে তিনি বনাঙ্কুর হতেন না, মেলানিয়া ট্রাম্প হতেন- তখনই ধারণা করেছিলাম, মেলানিয়া ট্রাম্পকে একজন নেগেটিভ ক্যারেক্টার হিসাবেই তিনি এনেছেন। সেটাই পরবর্তী কমেন্টে তিনি পরিস্কার করেছেন। মেলানিয়া ট্রাম্পের মত ঘৃণিত ক্যারেকটার (লেখকের চোখে) তিনি টেনেছেন কাদের বা কোন প্রসঙ্গে? যারা কুপ্রস্তাব গ্রহণ করে- তাদের প্রসঙ্গে নয় কি? ফলে- এইসব মেয়েদের আক্ষরিক অর্থে “বাজারি”, “নোংরা” না বলেও- কনট্রোলড ডল বলা, মেলানিয়া ট্রাম্প বলার (লেখকের চোখে যিনি মোটামুটি ঘৃণিত) মাধ্যমে তাদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ কি লেখক ঘটালেন না?

তিন

আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উৎপাদনশীল, কর্মক্ষম, ঘরের বাইরে আসা নারীদের নিয়ে কিচ্ছাকাহিনীর শেষ নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, নারীকে বশে রাখতে তার চিরন্তন অস্ত্র- নারীর চরিত্রে (সতীত্বে) কলংক লেপন করা- নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মূলত আমাদের রক্ষণশীল মিডল ক্লাস- যাদের কাছে এই সতীত্বপনা, তথা চরিত্রকে পুত পবিত্র দেখানো মহা গুরুত্বপূর্ণ, তারা এইরকম অভিযোগকে খণ্ডন করে এভাবে- অনেক মেয়ে এইরকম করলেও- সব মেয়ে কিন্তু এমন না। ভালো মন্দ দুইই আছে। এটা দিয়ে শুরু করলেও- আসল কথা শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়- আমি আসলে এমন না, আমার মেয়েটা এমন না, আমার মা’টা এমন না

আমার চারদিকে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যেই এই আলাপ প্রচুর শুনতে শুনতে বড় হইছি। অমুক-তমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা, হলে থাকা মেয়েরা খারাপ- এর জবাবে এনারা বলন, ‘হ্যাঁ অনেকেই খারাপ, কিন্তু সবাই না’ বলার পর শুরু হয়, ‘আমার মেয়েটা কত ভালো, কত ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ক্লাস- লাইব্রেরি আর হল ছাড়া কোথাও যায় না’ … ইত্যাদি। অমুক পেশা- তমুক পেশার মেয়েরা খারাপ, এর জবাবে- ‘আমি যেই পেশায় আছি বা যে কাজ করি- সেইটা ভালো’, কিংবা ‘সব পুরুষ খারাপ না, আমার এই পুরুষ কলিগ আমাকে বড় বোনের মতই শ্রদ্ধা করে’ ইত্যাদি …। আমার মা চাকুরিজীবী ছিলেন (এখন রিটায়ার্ড), চাকুরিতে কত পুরুষের কত কুপ্রস্তাব মেনে নিতে হয়- এই অভিযোগের বিপরীতে আমাদেরও এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে হতো- আমাদের মা আলাদা, অন্য রকম …।

আলোচ্য প্রবন্ধ দুটোকেও একইরকম মনে হলো! একটু ক্রুডভাবে বললে বলা যায় (এমনটা হয়তো লেখক সচেতনভাবে করেননি) – যতো না ওভারঅল নারীদের নিয়ে লেখকের অবস্থান, তার চাইতেও তার নিজেকে সতী, নীতিবান হিসাবে প্রমাণ করাই যেন মূল লক্ষ এই লেখার! এভাবে আসলে কী অর্জন হয়, তা চিন্তা করা দরকার! সমাজের সেই পুত: পবিত্র সতীত্বের ধারণাকেই হাওয়া দিয়ে, অন্যের কাঁধে পা দিয়ে আদতে কি নিজের কথিত কলংক মোচন হয়?

(এই আলোচনাটি ফেসবুকের কমেন্টেই থাকতে পারতো- কিন্তু উইমেন চ্যাপ্টারের কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধে এটিকে উইমেন চ্যাপ্টারেও দিলাম। উইমেন চ্যাপ্টারের এই বিষয়টি আমি এনজয় করি- এখানে বিভিন্ন মতের চিন্তাকে আগ্রহভরে স্থান দেয়।)

শেয়ার করুন: