বনাঙ্কুর মুস্তাফা: কিছুদিন আগে এক মেলায় উপস্থাপনা করতে গিয়েছি। সেখানে জনৈক(অ)ভদ্র লোক এসে ইনিয়ে বিনিয়ে আলাপ শুরু করলেন, ‘আপা’ সম্বোধন করে বললেন যে আমার উপস্থাপনা তার খুব পছন্দ, ভবিষ্যতে তিনিও এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চান, আমি যেন সহযোগিতা করি।
এই অ-ভদ্রলোকটি ক্যানাডার সিটিজেন হলেও থাকেন বাংলাদেশে এবং তিনি নাকি ‘হাসিনা ম্যাডাম এর আন্ডারে’ কাজ করেন(!)। ঠিক পরের দিন তিনি আমাকে ফোনটা দিলেন। বুঝলাম, এই টরন্টো শহরে আমার কন্ট্যাক্ট ইনফরমেশন যোগাড় করা কোন ব্যাপার না। তিনি জানতে চাইলেন ‘ভাই’ কোথায়, মানে আমার হাজবেন্ড কোথায়।
আমি বললাম, “ভাই দেশে গেছেন কাজে” (আমার ম্যারিটাল স্ট্যাটাস তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি আমি। তার ভাষ্য, “আপা তো দেশে মিডিয়াতে কাজ করতেন, আপনার খবর তো দেখেছি, খুব ভাল লাগতো। তো, এখানে কি নিজের বাসায় থাকেন নাকি ভাড়া বাসা? ও… আমার তো নিজের বাড়ি, বিশাল বড়, কেউ থাকে না। আসেন না একদিন বাড়িটা দেখাই!” এর উত্তরে আমি যা বলেছি তা এখানে না লেখাই ভাল!
এমন প্রস্তাব অহরহ মেয়েদের শুনতে হয়, যত্রতত্র। এইসব পুরুষরা মনে করে, একটা মেয়ের শরীর এতোই সস্তা যে তাকে আলিশান বাড়ির গল্প শোনানো, রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়া, দামী দামী উপহার দেয়া বা নিজের প্রতাপের গল্প শোনালেই সেই শরীর পাওয়া যায়। আর আমাদের বাবা-মা, পরিবার-পরিজনদের ধারণা, মেয়েকে বিয়ে দিলেই বুঝি সে সবরকমের নিরাপত্তা পেয়ে গেলো; পুরুষ জাতির লোলুপ দৃষ্টি থেকে সে রেহাই পাবে এবার।
কথাটা যে সত্যি না তার একশোটা উদাহরণ আমি দিতে পারবো এখানে। তার দরকার নাই। উপরের উদাহরণ থেকেই আপনারা বুঝতে পারছেন যে আমাদের চারপাশে মুখোশধারী লম্পট পুরুষদের অভাব নাই যারা ‘আপা আপা’ বলে মেয়েদের বিছানায় নিয়ে যেতে তৎপরতা চালায়, তাদের বৈবাহিক স্ট্যাটাস এই পুরুষদের কাছে দুধভাত!

আরেকটি বিষয়, “মিডিয়ার মেয়েরা খারাপ” বলে আমাদের দেশে একটা কথা খুব প্রচলিত! আমি নিজে মিডিয়াতে এতো বছর কাজ করার পরও আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে এই কথা অনেকবার শুনতে হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছা ছিল মডেলিং/অভিনয় বা উপস্থাপনায় ক্যারিয়ার গড়ে তোলার। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হয়ে ওঠেনি, কারণ আমার নিজের স্বপ্নের চেয়ে তখন মায়ের অশ্রুসিক্ত চোখের ভাষা বোঝা বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। “এমন কোরো না মা, সমাজের মানুষ অনেক কথা শোনাবে!” আমার অবুঝ মা তখন জানতেন না যে সমাজরক্ষক ওই মানুষগুলো তার মেয়েকে নিয়ে কথা বলতে ছাড়বে না এমনিতেও! কারণ আমার অবাধ-স্বাধীন চলাফেরা, আমার স্বনির্ভরতা তাদের চক্ষুশূ্ল।
যাই হোক, যেমনটি বলছিলাম, খুব প্রচলিত একটা ধারণা হচ্ছে, ‘মিডিয়াতে’ কাজ করা মেয়েরা দেহ ব্যবসা করে, তারা শরীরের বিনিময়ে সুনাম কেনে, নামকরা অভিনেত্রী হতে গেলে প্রডিউসার/ডিরেক্টর এর সাথে ঘুমাতে হয়, প্রসিদ্ধ খবর-পাঠিকা হতে গেলে চ্যানেল এর মালিক বা নিউজ এডিটর এর সাথে ঘুমাতে হয়, ইত্যাদি!
সত্যি কথা বলতে গেলে, আমরা প্রতিনিয়তই মিডিয়াতে এবং অন্য যেকোনো কর্মক্ষেত্রে ভারবালি অথবা ফিজিক্যালি সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট এর শিকার হয়ে থাকি। তবে তার প্রেক্ষিতে এটা ধরে নেয়া অন্যায় যে, আমরা সবাই সেই প্রতিকূল পরিস্থিতির কাছে হার মেনে আত্মসমর্পণ করছি।
বহু কুপ্রস্তাব পেয়েছি বাংলাদেশে থাকাকালীন। তার একটাও যদি আমি গ্রহণ করতাম, তাহলে বনাঙ্কুর আর আজকের বনাঙ্কুর হয়ে উঠতো না; হয়তো কোন এক মেলানিয়া ট্রাম্প হতো! কিন্তু মত প্রকাশের জন্য সাজানো স্ক্রিপ্ট আর কোন ঘৃণ্য মেল শভিনিস্টের ক্ষমতার দরকার নাই আমার।
খুব হাস্যকর লাগে মানুষের হিপোক্রেসি দেখলে! ধরুন, আমার প্রিয় অভিনয় শিল্পী ‘ক’। যেহেতু তার অভিনয় আমার ভাল লাগে, তার পারফরমেন্স নিয়ে আমি বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু কী দরকার আছে তার পারসোনাল লাইফ, সে কার সাথে ঘুমালো বা লিভ টুগেদার করলো বা কোথায় গেল – এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর বা মশলাদার গসিপ তৈরি করার!
কিন্তু না, সেটা না করলে আমাদের পেটের ভাত হজম হবে কি করে? আমরা তো মানুষ! আর তা না করলে গসিপ ম্যাগাজিনগুলোর পাতাই বা ভর্তি হবে কিভাবে? আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, এই তুমি তো অমুককে কাছ থেকে দেখসো। উনি নাকি ‘ইত্যাদি ইত্যাদি’ করেন, ঘটনা সত্য নাকি?!?
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমাকে দয়া করে এইসব অবান্তর প্রশ্ন করবেন না। আপনাদের জীবনে বিনোদনের অনেক অভাব থেকে থাকতে পারে কিন্তু আল্লাহর দয়ায় আমার সে অভাব নাই সুতরাং অন্যের গতিবিধি বিশ্লেষণের এতো আজাইড়া সময়ও আমার নাই!
এইসবকিছুর মাঝখানে ভুক্তভোগী কিন্তু আবার সেই মেয়েরাই! আমি খুব কম শুনেছি যে মিডিয়ার পুরুষরা খারাপ। মেয়েদের ক্ষেত্রে যেমনভাবে সাধারণীকরণ করা হয়, অন্তত সেভাবে বলা হয় না ছেলেদের ক্ষেত্রে। এমনও বলতে শুনেছি,“ও অমুক সাহেব, ওনার তো অনেক পয়সা, সামনে পেছনে আট-দশটা মেয়ে নিয়ে ঘোরা তো ওনার জন্য কোনোই ব্যাপার না!”
ভাবখানা এমন যে এটাই তো স্বাভাবিক; পুরুষ মাত্রই দশটা মেয়ের সাথে ঘুমাবে; কিন্তু একটা মেয়ের জীবনে একের অধিক পুরুষ আসলেই তার জীবন কালিমাময়! একজন ছেলে একাধিক প্রেম করলে সে ‘প্লেবয়’ (বেশ ফ্যান্সি একটা শব্দ, এমনকি এই নামে তো বিশ্বখ্যাত একটি ম্যাগাজিনও আছে!), আর একজন মেয়ে তা করলে সে চরিত্রহীন, “কোন ভাল ছেলে তো এই মেয়েকে বিয়ে করবে না”!!! (কেউ কি খেয়াল করেছেন, ছেলেদের ক্ষেত্রে বাবা-মা বলে থাকেন, বিয়ে ‘করালাম’, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বলেন, বিয়ে ‘দিলাম’?!?)
দুঃখের বিষয় হল এই সাধারণীকরণের চর্চায় মেয়েরাই আবার বেশি জড়িত। কর্মক্ষেত্রে একজন মেয়ে যখন উন্নতি করতে থাকে, তাকে নামানোর জন্য অনেকেই বেশ তৎপর হয়ে ওঠে যাদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী – উভয় জাতিই রয়েছে! বেশ ক’বছর আগে আমি একবার গেলাম মালয়েশিয়া বেড়াতে। কার/কাদের সাথে গিয়েছি তা এখানে উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন দেখছি না। ফিরে এসে শুনলাম, আমি নাকি আমাদের এক সহকর্মীর সাথে (আমাদের রিপোর্টিং সুপারভাইজার) গিয়েছিলাম যার সাথে কিনা আমার বেশ দা-কুড়াল সম্পর্ক ছিল সেসময়! তিনিও ওই সময় তার পরিবার নিয়ে কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলেন।
এমন বহু গল্পই আমার মত অনেককে নিয়ে ছড়ানো হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। সত্যি বলতে কি, যে মানুষগুলো এইসব নোংরামি ছড়ায়, তাদের প্রতি আমার কোনই রাগ নাই। করুণা হয় আমার এদের প্রতি এই ভেবে যে এদের আত্ববিশ্বাসের এতোই অভাব, অন্যের কুৎসা রটিয়ে এরা নিজেদের বড়ত্ব জাহির করতে চায়!!! আর তাদের এই ন্যক্কারজনক আচরণে আমার সামনে এগিয়ে চলার দৃঢ়তা আরো বৃ্দ্ধি পায়।
আমার আগের লেখা পড়ে অনেকেই কমেন্ট করেছেন, মেয়েরাই মেয়েদের আঘাত করে বেশি। আগেও বলেছি, এই গোত্রীয় নারীরা নিজেও জানেন না যে তারা পুরুষতান্ত্রিকতাকে কিভাবে ধারণ এবং পালন করে চলেছেন! মুখে বড় বড় বুলি কপচান, নারীর স্বাধীনতা আর সমান অধিকারের। কিন্তু আত্ববিশ্বাস, আত্মসম্মানবোধ আর উদারতার অভাবে তৈরী হওয়া নীতিহীনতার বশবর্তী হয়ে এরাই স্বজাতীয়দের জীবন বৈরী করে তুলতে ব্যস্ত হন।
আমার খুব প্রিয় একজন কিংবদন্তী, প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার একটি সাক্ষাৎকারের কথা শেয়ার করতে ইচ্ছা করছে এখানে। তিনি বলেছেন যে পৃথিবীর প্রতিটি নারীই উন্নতির পথে এমন কঠিন বৈরীতার শিকার হন। তার শক্তিই এর মূল কারণ যা মানুষের মাঝে ভয় আর দ্বিধা তৈরী করে। তারা ভাবে, মেয়েটি এই দুর্নিবার শক্তি কোথা থেকে পেল, কতদূ্র যাবে সে এই শক্তিকে ভর করে! ডায়ানা কিন্তু শেষ অবধি তাঁর তীব্র আত্মসম্মানবোধ আর মানবিকতার শক্তিকে ক্ষমতার রোষানলে চাপা পড়া থেকে রক্ষা করেছেন পুরাদস্তুর দৃঢ়তা দিয়ে।
কিছুদিন আগে আমার ফেসবুকের আদারবক্সে ম্যাসেজ আসলো,“এই মেয়ে, তুমি এমন ছবি কেন দাও? তুমি কি একেকটা দেশে একেকজন পুরুষ সংগী নিয়ে যাও? মিডিয়ার মেয়েরা তো এইগুলাই করে!” কী লিখা উচিত এর উত্তরে? লিখলাম,“আফা, শরীরটা আমার, ছবিগুলা আমার, ফেসবুক আমার, যারে নিয়া বেড়াতে গেসি সেই সঙ্গীও আমার, আপনার এতো চুলকানি কিসের? আপনার খুব একলা লাগলে গুগল-এ সার্চ মাইরা দেখেন, অনেক হেল্প পাবেন”। তারপর ম্যাসেজ আসা বন্ধ!
রুম্পা লিখেছে আমাকে, “আপু, আমার মনে হয় একটা পরিবারে বাচ্চাদের সবচেয়ে আগে শিক্ষা দেয়া উচিত নিজেকে সম্মান করার”। ওর কথার সাথে আমি যারপরনাই একমত। আসলেই, একজন মানুষ যখন নিজেকে সম্মান করতে জানবে, তখনই সে বুঝবে অপরকে কিভাবে সম্মান করতে হয়।
আর আমাদের কি উচিত, এই ‘আজ আছি-কাল নাই’ জীবনটার এক একটা মূল্যবান মুহুর্ত পরচর্চা করে আর মানুষের চলার পথে কাঁটা দিয়ে পার করার?
এখনো যেখানে আমাদের মেয়েরা-বউরা-বোনেরা দিনে-রাতে ধর্ষিত হচ্ছে, সেখানে অন্যের জীবন দুর্বিষহ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত না থেকে, চলুন আমরা আমাদের বুদ্ধি, কন্ঠস্বর আর সময়ের সঠিক ব্যবহার করি। আর কতদিন নারীর ভ্যাজাইনাকে শস্যক্ষেত্র বানিয়ে পুরুষরা তাদের রাজত্ব – তাদের পুরুষত্ব ঘোষণা করবে আর আমরা চুপচাপ বসে থাকবো?