কামরুন নাহার রুমা:
কিছুদিন আগের কথা। আমার এক বান্ধবীর সাথে গল্প করছিলাম। ও একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে। ওর তখন সেপারেশন চলছিল। কোনো সন্তান নেই। অপ্রয়োজনীয় তাও বলে রাখি ও দেখতে সুন্দরী, মেধাবী আর বয়স কম হওয়াতে সেপারেশন ট্যাগটা ওর জন্য ছিল একটা আতঙ্ক। ও আমায় বলছিল, “তুমি ভাল আছো, বিয়ে থা করোনি, আমার তো ঝামেলার শেষ নেই”।
আমি জানতে চেয়েছিলাম যে, কেন এমন বলছে ও। তখন ও যে ঘটনা শোনালো তাতে আমি অবাক হইনি মোটেও, কারণ ও সেপারেশনে যাওয়ার পর যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে আমি অবিবাহিতা হয়ে তার চেয়ে বেশি হচ্ছি।

আর একটা ঘটনা বলি। আমার এক দূর সম্পর্কের বোনের সাথে গল্প করছিলাম ফোনে। ও ঢাকার বাইরে থাকে। ডিভোর্স হয়ে গেছে কদিন আগে। ও নিজেই ডিভোর্স দিয়েছে স্বামীর নানান চারিত্রিক সমস্যার কারণে। ও একটা ছোটখাটো সরকারি চাকরি করে। আমার ওই বান্ধবী আমায় যে সমস্যার কথা বলছিল একই সমস্যার কথা আমার এই বোনও বললো।
আমার এক বিধবা আত্মীয়াও একই গল্প বলছিলেন আমায় এবং আমি কোনো বারই অবাক হইনি। আসলে এই সমস্যাটা অনেক বিবাহিতা নারীর বেলায়ও হয়।
অবিবাহিতা, ডিভোর্সি, বিধবা বা আলাদা থাকা নারী মানেই আমরা ‘ফর গ্যারান্টেড’ ধরেই নেই “শি ইজ অ্যাভেইলেবল টু স্লিপ উইথ এনিওয়ান”। অনেকটা এমন যে আলগা গরু – সুতরাং নিজের মনে করে যা খুশি আচরণ করাই যায়।
উপরের যে তিনটা উদাহরণের কথা বললাম সেটা আমাদের কর্মস্থলের স্বাভাবিক চিত্র – দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। মুশকিল হলো মান সম্মানের ভয়েই হোক, চাকরি হারানোর ভয়েই হোক বা ‘পুরুষ শাসিত সমাজে বিচার না পাবার’ আশঙ্কা থেকেই হোক, নারীরা মুখ বন্ধ রাখে। আর সে কারণেই এই সমস্যাটা আমাদের সামনে আসে না; আর তাতে করে দিনের পর দিন এই অপরাধটা করার প্রবণতা পুরুষের মধ্যে বাড়ছে।
এই সমস্যাটা শুধুই যে কর্মস্থলে বিরাজমান তা নয়। অবিবাহিতা, ডিভোর্সি, বিধবা বা আলাদা থাকা নারী এই সমস্যার সম্মুখীন হয় তার কর্মস্থলের বাইরে তার পরিচিত পরিমণ্ডলেও – যেখানে আছে তার বন্ধু, আত্মীয় এবং তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষীরাও। মুখোশধারী, ভদ্র সহকর্মী চা খেতে খেতে আপনার সাথে অফিসিয়াল কথাবার্তা বলার ছলেই ক্যাজুয়ালি জানতে চাইবে, আপনার দিন কিভাবে কাটে অথবা কোনো একজন কাছের বন্ধুর প্রয়োজন বোধ করেন কিনা, যার সাথে সব শেয়ার করা যায়।
অথবা কেউ হয়তো হাসতে হাসতেই বলে ফেললো, ‘আহা, আমাদের সুন্দরী মেয়েটিকে সোহাগ করার কেউ নেই’। সে আসলে চায় মেয়েটি তাকে ডাকুক, ফ্রিতে একটু আদর সোহাগ নিক। কখনও আপনার কোনো বন্ধু দেখা যায় সহানুভূতির তীব্রতায় দুষ্টামির ছলে আপনাকে বলেই বসে “তোর জামাই নাই, তো কী হয়েছে, আমাকে ডাক, আমি তো আছি”।
আমার সেই ডিভোর্সি আত্মীয়ার এক সহকর্মী তাকে দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছে একটা ছোট্ট কাজের জন্য। পরোক্ষভাবে মেয়েটি তার পুরুষ সহকর্মীর দেয়া বিছানায় যাবার প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে দেয়ায় তার কাজটি হচ্ছে না।
আর বিধবা মেয়েরা তো নিজ ঘরে নিজ আত্মীয় স্বজনের দ্বারাই নানান কুপ্রস্তাব পেয়ে অভ্যস্ত । দেখা যায় ভাইয়ের বন্ধুটি বা বেড়াতে আসা খালাতো-চাচাতো ভাইটি কিংবা শ্বশুরবাড়ির কোন দূর সম্পর্কের দেবর বা আত্মীয় বিধবা মেয়েটির কষ্ট সইতে না পেরে উপযাচক হয়ে আসে শারীরিক সুখ দেবার জন্য। রাজী না হলে নানানভাবে হয়রান করা হয় মেয়েটিকে, বিষিয়ে তোলা হয় তার জীবন।
মেয়েরা মান-সম্মানের ভয়ে দিনের পর দিন সেই কষ্ট বুকে চেপে রাখে, কাউকে বলে না। আসলে বলে কোনো লাভ হয় না –সবাই তাকে চুপ থাকতে বলে। আমাদের সমাজে নারী এতো সমস্যার আবর্তে জড়িয়ে আছে, এত বঞ্চনা-গঞ্জনা তার জীবনে যে যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা একেবারে শিকড়ের এই সমস্যাগুলোর কথা আমরা মাঝে মাঝে ভুলেই যাই।
অবিবাহিতা, ডিভোর্সি, বিধবা বা আলাদা থাকা নারী মানেই আলগা গরু নয়।
শারীরিক চাহিদা তার থাকবেই – কারণ সে মানুষ, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ইচ্ছা সে, যখন খুশি তখন তাকে বিছানায় যাবার প্রস্তাব দিয়ে বসবে। তার পেছনে কোথাও ট্যাগ লাগানো নেই “ আই এম অ্যালোন এন্ড অ্যাভেইলেবল টু স্লিপ উইথ ইউ”।
লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি