মোনা এলতাহাওয়ি একজন পুরস্কার জয়ী মিশরীয়-আমেরিকান সাংবাদিক এবং আরব বিশ্ব, মুসলিম ইস্যু এবং বৈশ্বিক ফেমিনিজম বিষয়ে একজন বিশ্লেষক। তার জন্ম হয় ১৯৬৭ সালে মিশরের পোর্ট সাঈদে। সাত বছর বয়সে চিকিৎসক বাবা-মায়ের সাথে যুক্তরাজ্যে এবং ১৫ বছর বয়সে সৌদি আরবে চলে যান। ২০১১ সালের নভেম্বরে মিশরে প্রতিবাদ চলাকালে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দাঙ্গা পুলিশের হাতে মারাত্মক রকমের লাঞ্ছিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হোন। একই বছরে মুসলিম বিশ্বের নারীবিদ্বেষ নিয়ে তার একটি লেখা “Why Do They Hate Us?” ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তিতে এই লেখাটিকেই তিনি বইয়ে রূপ দেন, Headscarves and Hymens: Why the Middle East Needs a Sexual Revolution। একই সাথে তিনি কায়রো এবং নিউইয়র্কে থাকছেন বর্তমানে।
মূল সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন এলিজাবেথ ডে, দ্য গার্ডিয়ান
ভাষান্তর: উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক
আপনার বইটি মূলত কিছুটা ইশতেহার টাইপ, কিছুটা স্মৃতিচারণ, এবং মুসলিম নারীদের জীবনভর যে ধরনের নির্যাতন সয়ে যেতে হয় তার বর্ণনা। আপনি মেয়েদের খৎনা এবং ধর্ষণ বিষয়গুলোও উল্লেখ করেছেন। এগুলো লিখতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে আপনার?
মোনা এলতাহাওয়ি: অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন। অনেক সময় আমি ল্যাপটপ থেকে জাস্ট উঠে চলে গেছি। এটা ছিল আমার জন্য ভয়াবহ মানসিক চাপের একটি বিষয়। বিশেষ করে যখন আমি যৌন হয়রানির কথা লিখেছি, নিজেও যেহেতু একইরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, তাই এটা কেবলই নারীবিদ্বেষ নয়, অন্যরকম এক অনুভূতি। এটা মোটেও কোন সহজ বই না লেখার জন্য।
আপনি লিখেছেন যে আপনি কিশোরী বয়সে ফেমিনিজম বিষয়ে ট্রমাটাইজড ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
মোনা এলতাহাওয়ি: দেখুন, আমার ১৫ বছর বয়সে গ্লাসগো থেকে আমার পরিবার সৌদি আরবে চলে আসে। একজন ১৫ বছরের কিশোরী মেয়ের জন্য খুবই কঠিন সময় সেটা, এক হলো হরমোনাল পরিবর্তন, আবার সৌদি আরবের মতোন দেশে একজন কিশোরীর বেড়ে উঠা। সব মিলিয়েই মনে হচ্ছিল যে আমার মাথার ওপর থেকে কেউ যেন সমস্ত আলো সরিয়ে নিয়েছে। আমি মানতেই পারতাম না কীভাবে সেখানে নারীদের প্রতি আচরণ করা হয়। যুক্তরাজ্যে থাকতে আমার মাকে আমি কাজ করতে দেখেছি বাবার পাশাপাশি। কিন্তু সৌদিতে এসে মা যেন পঙ্গু হয়ে গেল। সে গাড়ি চালাতে পারতো, সবকিছুর জন্য বাবার ওপর নির্ভর করতো। আর ধর্মীয় বিদ্বেষ বা ঈর্ষাটা ছিল দমবন্ধ করার মতোন। আমি মুসলিম হিসেবেই একটি মুসলিম পরিবারে বড় হচ্ছিলাম, কিন্তু এটাও ছিল সেখানে ঈর্ষার বিষয়। সৌদিতে একজন নারী হিসেবে তোমার সামনে মাত্র দুটি বিকল্প, হয় তুমি সব মেনে নেবে, যা প্রথমদিকে আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল, এবং যে কারণে আমি গভীর হতাশায় ডুবে গেছিলাম, আর নয়তো তুমি একজন ফেমিনিস্ট হিসেবে গড়ে উঠবে।
মুসলিম কমিউনিটিতে নারী বিদ্বেষ নিয়ে খোলামেলা কথা বলে কারও কারও বিরাগভাজন হতে পারেন, এমন ভয় কি ছিল আপনার?
মোনা এলতাহাওয়ি: অনেক ঘৃণা পেয়েছি মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু আমি যে এসব মানুষকে রাগাতে পেরেছি তাতেই আনন্দিত। একজন নারীর যখন মতামত থাকে, তখন তাকে এসবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে, এটাই স্বাভাবিক।
সব ধর্মই কি নারী বিদ্বেষী?
মোনা এলতাহাওয়ি: অবশ্যই। কোন না কোনদিক দিয়ে তো অবশ্যই। সব ধর্মই নারীর সেক্সুয়ালিটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সব ধর্মই আমার যৌনাঙ্গ নিয়ে খুবই অবসেসড। আমি তখন বলি, ‘তোমরা আমার যৌনাঙ্গ থেকে দূরে থাকো, নইলে আমি কিন্তু সেখানে ভরে দেবো’।
আপনি ডাবল রেভ্যুলশান এর কথা বলেছেন। এর মানে কী?
মোনা এলতাহাওয়ি: ২০১০ সালে যা তিউনিসিয়ায় হয়েছে সেটা ছিল রাজনৈতিক বিপ্লব, যা কিনা হয়েছিল তখনই, যখন রাষ্ট্র সবার ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় পরবর্তিতে নারীরা বুঝতে পারলো যে রাষ্ট্র, রাস্তা, এমনকি বাড়ি এসবই নারীকে নিপীড়ন করা অব্যাহত রেখেছে। কাজেই একটি সামাজিক ও লিঙ্গীয় বিপ্লব ছাড়া কোন রাজনৈতিক বিপ্লবই সম্পূর্ণ হয় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যর্থই হয়।
১৫ বছর বয়সে আপনি হিজাব পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেন?
মোনা এলতাহাওয়ি: আমি ওটা পরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাবা-মা বললো যে আমার বয়স কম। কিন্তু ১৬তে গিয়ে আমি হিজাব পরি, এবং দ্রুতই বুঝতে পারি যে এটা আমার জন্য নয়। আমার চুলে বাতাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি খাবার খেতে গিয়েও ওই হিজাব আমাকে ডিস্টার্ব করছিল।
২০১১তে আপনার ওপরে মিশরে দাঙ্গা পুলিশের নির্যাতনের কথা আপনি লিখেছেন। যখন ঘটনাটা ঘটলো, আপনি কি ভয় পেয়েছিলেন?
মোনা এলতাহাওয়ি: প্রথমত আমার মনে হয়েছিল যে ওরা কিছু করবে না। আমি একজন নারী, চারজন দাঙ্গা পুলিশ কী করবে আমার সাথে? এক পর্যায়ে ওরা যখন আমাকে নো-মেন্স ল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন করলো, এবং আমি মাটিতে পড়ে গেলাম, আমার ভিতরের কেউ যেন বলে উঠলো, ‘তুমি যদি এখনই না উঠো, তবে মরে যাবে’। কোনরকমে উঠে দাঁড়ালাম আমি দুই ভাঙা হাত নিয়ে।
এরপরই কি আপনি চুলে রং করলেন আর হাত দুটিতে ট্যাটু করালেন?
মোনা এলতাহাওয়ি: দুটো হাতেই আমার তিন মাস ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। একজন লেখক হিসেবে এটা ছিল চরম হতাশার সময়। আগে আমার লেখনী, আমার শব্দ ছিল লড়াইয়ের অস্ত্র, কিন্তু তখন কেবলমাত্র একটা আঙ্গুল আমি ব্যবহার করতে পারতাম টাচপ্যাডে। ওই সময়টাতে আমি মূলত টুইটারেই পড়ে থাকতাম সবসময়। তখন আমি বলতাম লোকজনকে যে, যখন আমার হাত দুটি ঠিক হয়ে যাবে, তখন আমার সাথে যা হয়েছে তা স্মরণীয় করতেই কিছু একটা করবো আমি। আমার মনে হচ্ছিল, শব্দের বদলে আমি আমার শরীরের মাধ্যমেও বার্তা দিতে পারি। আমি ট্যাটু সম্পর্কে পড়া শুরু করলাম। এবং দেখলাম যে যৌন হয়রানির শিকার বহু মানুষ তাদের শরীরে ট্যাটু করিয়েছে। আমি আমার ডান হাতে প্রাচীন মিশরীয় দেবী শেখমেত এর ছবি আঁকালাম, যে কিনা প্রতিশোধ এবং সেক্সের প্রতীক। যেভাবে এটা আঁকালাম যেন দেখে মনে হবে যে সে তোমার পশ্চাৎদ্বেশে লাথি কষাচ্ছে এবং তোমার ব্রেইনকে জাস্ট ধর্ষণ করে দিচ্ছে। এই দেবীর মাথা হচ্ছে সিংহীর, আর শরীরটা নারীর। আর বাঁ হাতে এরাবিক ক্যালিগ্রাফি, আর সেই রাস্তাটার নাম যেখানে আমার ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। কারণ ওই রাস্তাটি এখন বিপ্লবের আইকনে পরিণত হয়েছে। আর এর নিচেই আরবীতে লেখা ‘ফ্রিডম’।
নিউজউইকে আপনাকে ২০১২ সালের ‘মোস্ট ফিয়ারলেস ১৫০ জন নারীর একজন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আপনি কি সত্যিই নিজেকে ‘ফিয়ারলেস’ ভাবেন?
মোনা এলতাহাওয়ি: তুমি জানো আমি কখনই ভাবিনি যে ভীতিহীনতা, সাহস এসব বিষয় নিয়ে। আমি যা করি, এটা এমনিতেই হয়ে গেছে। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি মিশরে নিরাপদ বোধ করো?’ আমি উত্তর দিই, কেউ নিরাপদ না মিশরে। যারাই এখানে ভিন্ন মতাবলম্বী, সবাই নিজেকে কোন না কোনভাবে বাঁচিয়েই বেঁচে থাকে।