নায়লা নাঈম, একটি বিজ্ঞাপন এবং আমাদের মানসিকতা

শিল্পী জলি: নায়লা নাঈমের ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কিত সচেতনতামূলক ভিডিওটি আলোচনার ঝড় তুলেছে। ঝড়ের বিষয়টি পড়ে এই প্রথম নায়লা নাঈমকে চিনলাম এবং তার ভিডিওটিও দেখলাম। ভাবছিলাম, হয়ত কোনো সাংঘাতিক ব্যাপারই ঘটিয়ে দিয়েছে সে, তাই এতো কট্টর সমালোচনায় পড়েছে।

ভিডিওটি দেখে অবাকই হলাম। সে শুধু গেঞ্জির উপরের শার্টটিই খুলেছে। অভিনয়, কাহিনী, কথার স্টাইল এবং নির্মাণ শৈলী সবই আজকালকার দেশীয় তরুণীদের মতোই–আলগা ভাব। অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার আধুনিকতা– বাংলা মুভির নায়িকাদের মতো উহ-আহ স্টাইল। যেসব দেখে আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের ভক্ত সমাজ অভ্যস্ত।

naila-2নায়লা নাঈম দ্বিতীয় গ্রেডের নায়িকা। তার বেশীরভাগ কাজে শরীর প্রদর্শনই মেইন এবং ওটাই তার রুজি রোজগারের মাধ্যম। তেমন কাজের মাধ্যমেই সে তার ক্লাসের ভক্তদের ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছেন। তাই তার উদ্যোগটিকে সাধুবাদ না জানাবার কোন কারণ নেই।

আমরা বাংলাদেশী মেয়েরা একদিকে নারী অধিকারের কথা বলি, অন্যদিকে অন্য কোনো নারী আমাদের মনের মতো করে না চললেই তার উপর চড়াও হই। অথচ প্রথমে একবার দেশীয় আইনটি মিলিয়ে দেখি না যে সে কোনো আইন ভঙ্গ করেছে কিনা।

নারী অধিকার মানেও আইনে থেকে মানুষ হিসেবে নিজের অধিকারটি নিজের পছন্দ মতো করে ভোগ করা– সাধু, সন্ন্যাসী, বা বৈরাগী হয়ে যাওয়া নয়, অথবা পুরুষ সঙ্গের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা নয়।

নায়লা নাঈমের যেমন করে ইচ্ছে হয়েছে তেমন করে সে তার শার্ট খুলেছে, এতে মাথা ঘামাবার কোন বিষয়ই নেই।

দেশীয় সমাজে ব্রেস্ট ঢাকতে ঢাকতে মেয়েদের মেরুদণ্ড বেঁকে যায়, তাও মনে হয় লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। ব্রেস্ট মানুষের অন্য অঙ্গের মতোই সাধারণ একটি অঙ্গ, তাই মোটামুটি ঢাকলেই বিষয়টিতে ওকে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তবে উক্ত বিষয়ে পুরুষ সমাজের অতি আগ্রহ এবং ভক্তি থাকায় নারী সমাজকে তার এক্সট্রা রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হতে হয়।

বিষয়টি হয়ত অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। সেটা হলো, দেশে নারী জাতির ব্রেস্টের গ্রহণযোগ্যতা এবং অধিকার নিয়ে আর কোনো সংগ্রামের দরকার নেই–এখন শুধু সংগ্রাম করতে হবে এই বিষয়ে মেয়েদের আরও কিছুটা ফ্রিডমের জন্যে। যেনো শার্টের একটি বোতাম খোলার ভাবেই সমাজে ছিঃ ছিঃ পড়ে না যায়। যেনো শার্টের নীচে গেঞ্জিও যে থাকে, সেটিও সমাজের মাথায় থাকে।

মানুষের মনে নিজের শরীর নিয়ে স্বাধীনতা না থাকলে তথ্য এবং তত্ত্বগত সচেতনতাতে তেমন কোনো লাভ হয় না। বরং সামাজিক ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দিনে দিনে গুটিয়ে যাবার কারণে আমাদের অনেকেই হাজার সুবিধা থাকলেও সেগুলো আর ভোগ করতে পারি না।

Shilpi Jolley 2ম্যামোগ্রাম, প্যাপ মেয়েদের নিত্য চেকআপের বিষয়। উন্নত বিশ্বে মেয়েরা এই সুবিধা নিয়মিত নেয়। কিন্তু আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ে এসবের ধারের কাছ দিয়েও যায় না। সামর্থ থাকলেও তারা লজ্জায় কুকড়ে থেকে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। কেননা সারা শরীরের মধ্যে দু’তিনটি অঙ্গকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখাবার কারণে বাল্যকালেই তাদের মনে ঝামেলা বাঁধিয়ে দেয়া হয়।

তাই অনেকেই ভুলে যায় মানুষের প্রতিটি অঙ্গের ফাংশন ভিন্ন হলেও শরীরের সব অঙ্গ শুধু টিম ওয়ার্কের মাধ্যমেই সচল থাকে। তাই মানুষের অঙ্গে অঙ্গে লজ্জা ঢেলে দেবার কারণ নেই এবং এটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত–এক কথায় ব্রেইন ওয়াশ এবং দমননীতি। একবার ঐ চক্করে পড়লে আর সহজে তার থেকে বেরিয়ে আসা যায় না।

আমার এক আত্মীয় গর্ভবতী হয়েও সাত মাস পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যায়নি , শুধু এই ভয়ে যদি ডাক্তার তার কাপড় সরিয়ে চেক করেন। আমেরিকাতে থেকে আমি নিয়মিত ইন্স্যুরেন্স পে করেও শুধু অস্বস্তির কারণে অনেক টেস্ট বছরের পর বছর ধরে ‘আজ করি কাল করি’ করি, কিন্তু সংঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারি না। সমস্যা ঐ একটিই–ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি এই ঢাকো, সেই ঢাকো এবং মেয়েদের অঙ্গে অঙ্গে লজ্জা।

মনে পড়ে একবার কোষ্ঠ্যকাঠিন্যে ভুগে এবং জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে ছোট ভাইকে রোগের বিবরণ বলে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছিলাম ঔষধ আনতে। ওকে বার বার করে বলে দিয়েছিলাম, খবরদার বলবি না যেন তোর বোন।

সে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ডাবল বুদ্ধি করে বলেছিল, ‘ডাক্তার সাহেব আমার ছোট ভাইয়ের কোষ্ঠ্যকাঠিন্যে দফা-রফা হয়ে গিয়েছে, ব্লিডিং হচ্ছে, যদি ঔষধ দেন তাহলে এ যাত্রায় কিছুটা হয়তো শান্তি পেতো।

রোগের বর্ণনা শুনে ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন, যাও…এখনই বাড়ি গিয়ে তোমার ছোট ভাইকে নিয়ে এসো–রোগী না দেখে এই রোগের ঔষধ দেয়া যায় না।

ভাই তো নাছোরবান্দা–রোগীকে নেবে না, কিন্তু ঔষধ আনবেই !

ওদিকে মা নেই বাড়িতে–

মানুষের শরীর লজ্জাবতী লতা নয়, একটি সিস্টেম। তাই তাকে অঙ্গে অঙ্গে বিভক্ত করে নানা বিধিনিষেধ না চাপিয়ে আপন গতিতে চলতে দিলেই উপকার বেশী এবং ওটাই সভ্যতা।

শেয়ার করুন: