আমার ছেলে কি ধর্ষক হতে পারে?

জেসমিন চৌধুরী: ধর্ষকরা কি গাছে ধরে, নাকি বৃষ্টির সাথে পড়ে? পথে-ঘাটে-বাসে যারা মেয়েদের সাথে অশোভন আচরণ করে তারা কই থেকে আসে? তারা কি ভিন্ন কোন প্রজাতি, নাকি আমাদেরই মত মানুষ, কারো ভাই, ছেলে, চাচা অথবা বাবা?

স্কুলজীবনে আমরা মেয়েরা নিজেদের মধ্যে এসব বিশ্রী অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করার সময় আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম আমাদের ভাইরা এতো ভাল, তাহলে অন্য ছেলেগুলো এত খারাপ কেন? তখনো বুঝিনি, আমার সাথে যে খারাপ আচরণ করে সে যেমন আরো কারো ভাই ঠিক তেমনি আমার ভাই আরো কোন মেয়ের সাথে অশালীন আচরণ করাটাও বিচিত্র কিছু নয়।

কিন্তু এরচেয়েও অনেক বেশি কঠোর, অনেক বেশি মর্মান্তিক একটা সত্য জেনেছি কর্মজীবনে শিশু যৌন নির্যাতনের উপর প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে, এবং তার বাস্তব উদাহরণ দেখেছি দোভাষী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে।

jesmin-3
জেসমিন চৌধুরী

একটা ঘটনার কথা বলি।

একটা স্কুলের লাইব্রেরীতে কনফারেন্স হচ্ছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, স্কুল নার্স, ফ্যামিলি সাপোর্ট ওয়ার্কার, সোশাল ওয়ার্কার, একজন মা যার তিনটা বাচ্চা ঐ স্কুলে পড়ে এবং দোভাষী হিসেবে উপস্থিত আছি আমি। এর আগে এই পরিবারের জন্য কাজ করিনি তাই ঘটনা কী কিছুই জানিনা।

কনফারেন্স শুরু হলো। গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে ক্লায়েন্টকে আশ্বস্ত করার পর ভাষান্তরের কাজ শুরু করলাম। একটু একটু করে করে ঘটনা উন্মোচিত হতে শুরু করলে আমার শরীরের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠল। সোশাল ওয়ার্কার তার রিপোর্ট পড়ে শোনালেন, আমি তা সিলেটী ভাষায় মাকে বুঝিয়ে বললাম। যদিও সবই আগে থেকে জানেন তবু শুনতে শুনতে ভদ্রমহিলার চোখ পানিতে ভরে গেলো।

ঘটনাটা এরকম, ওই নারীর বড় ছেলেটি ধর্ষণের দায়ে জেলে আছে কিন্তু তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তার ছেলে এরকম একটা কাজ করতে পারে। ছেলেটি আগে ঐ স্কুলেই পড়তো,  কয়েক বছর আগে জিসিএসই শেষ করে বেরিয়েছে। ধর্ষিতা মেয়েটিও একই স্কুলের ছাত্রী, কাজেই স্কুলের বেশির ভাগ বাচ্চারাই ঘটনাটা জানে, এবং মহিলার ছোট বাচ্চাগুলোকে এ নিয়ে তারা এতোটাই উত্যক্ত করছে যে বাচ্চাগুলো আর স্কুলে যেতে চায় না।

স্কুল কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়েছে কারণ তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে পরিস্থিতি সামলাবে। বাচ্চাগুলোর মানসিক অবস্থা নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন। ঘটনাটা নিয়ে কী ভাবছে ছোট শিশুগুলো, তাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা এবং বৃদ্ধির উপর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করবে ব্যাপারটা, এসব নিয়ে কনসার্নড স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সকলে। কীভাবে বাচ্চাগুলোকে সাহায্য করা যায়? নিঃসন্দেহে তাদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন, কিন্তু তাদের মা’ই যদি বিষয়টাকে মেনে নিতে না পারেন তাহলে এ নিয়ে কোন পরিকল্পনা করা কীভাবে সম্ভব?   

কনফারেন্স শেষ হলে সোশাল ওয়ার্কার আমাকে একটা কোণায় ডেকে নিয়ে বলল, তোমার কাছ থেকে আমার সাহায্য প্রয়োজন। আমি জানি ভদ্রমহিলার উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝঞ্ঝাট গেছে, তিনি মর্মাহত, কিন্তু তাকে যতদূর সম্ভব কম কষ্ট দিয়ে কিছু কঠোর কথা বলতে হবে। তুমি যদি তোমার নিজের ভাষাজ্ঞান ব্যবহার করে মূল বিষয়গুলো তাকে একটু হালকাভাবে বুঝিয়ে বলো, আমি খুব খুশি হবো। তারপর সে আমাদেরকে একটা আলাদা কামরায় নিয়ে গেল।

এরপরের আধঘন্টা ছিল আমার কর্মজীবনের কঠিনতম তিরিশটি মিনিট। দুদিকের কথা অনুবাদ করতে গিয়ে পাওয়া নতুন সব পীড়াদায়ক তথ্য, ছেলের অপরাধ মেনে নিতে মায়ের জেদপূর্ণ অস্বীকৃতি, তদুপরি এইসব কথার ভেতর দিয়ে জেগে উঠা একটা মেয়ে বা নারী হিসেবে পুরুষের হাতে বিভিন্ন বয়সে আমার  নিজের অপমানিত হবার নানা কষ্টকর স্মৃতি আমাকে বিপর্যস্ত করে তুললো।

সোশাল ওয়ার্কারের বিবরণ থেকে জানতে পারলাম ওই নারীর একমাত্র মেয়েটিকে, যার বয়স মাত্র বারো বছর, তার মায়ের বাসা থেকে একবছর আগে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মেয়েটি পালক মা-বাবার সাথে থাকে।

মেয়েটি তার আপন বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনলে মা তা শুধু সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাসই করেননি, বরং স্কুলের শিক্ষকদেরকে এসব কথা জানানোর মাধ্যমে তাদের পারিবারিক জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য মেয়েটিকে দোষারোপ এবং গালমন্দ করতে থাকেন। শিশুরক্ষা আইনের আওতায় সোশাল ওয়ার্কারদের উপদেশ অনুযায়ী তিনি ছেলেকে বাসা থেকে বের করে দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা রাতারাতি মেয়েটিকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়।

কী বিচ্ছিরি পরিস্থিতি ভেবে দেখুন! একটা মেয়েকে নিজের বাসা ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি পরিবারের সাথে থাকতে হচ্ছে, কারণ তার নিজের বড় ভাই তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে এবং তার মা তা বিশ্বাস করেননি। এবং তার এক বছরের মধ্যে ছেলেটা আরেকটা মেয়েকে ধর্ষণ করে জেলে গেছে, তবু ছেলের প্রতি মায়ের অগাধ বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। ছোট দু’টো ছেলে সবকিছুই জানে এবং এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা স্কুলে অন্যান্য বাচ্চাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদেরকে কেউ সঠিক সাহায্য দিতে পারছে না কারণ তাদের মাকে আগে বুঝতে হবে প্রতিটি ধর্ষকই কোনো না কোনো নারীর গর্ভ থেকে জন্মায়, কোনো না কোনো নারী তার হতভাগ্য মা।

অনেক বোঝানোর পর ওই মা আবার কাঁদতে শুরু করলেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘আফনারো তো ফুয়া-ফুড়ি আছে, কইনচাই আফা নিজোর মায় নিজোর ফুয়ারে চিনে না নি? বিশ্বাস করউক্কা আফা আমার ফুয়ায় ইলান একটা কাম করতোউ ফারে না।’

আমার কাছে এই মহিলার অবিশ্বাসকে অকৃত্রিম বলেই মনে হয়েছে, তাই আমি তার উপর রেগে যেতে পারিনি। এজন্যই হয়তো গল্পটা বলতে গিয়ে আমার ভাষা বা অভিব্যক্তি কোনটাই খুব  একটা তীব্র হচ্ছে না। এই মা’টিকে চাইলে দোষারোপ করতে পারি আমরা, ছেলের প্রতি তার অন্ধবিশ্বাসের সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন কেন নিজে একজন নারী হয়েও নিজের মেয়ের প্রতি অবিচার এবং ছেলের প্রতি অন্ধবিশ্বাস প্রদর্শন করেছেন এই মা।

তিনি শুধু একজন নারী বা মা-ই নন, তিনি এই সমাজের একজন রক্ষক এবং মুখপাত্রী। তিনি তা’ই করছেন যা করার জন্য তাকে আশৈশব প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বামী পরিত্যক্তা, অশিক্ষিত, পরনির্ভর সবদিক দিয়ে দুর্বল এই নারীর সামাজিক সম্মান, তার ভবিষ্যত, তার বৃদ্ধ বয়সের সেবা শুশ্রুষার নিশ্চয়তা নির্ভর করে তার বড় ছেলেটির উপর, তাই অবচেতন মনে তিনি জানেন, যে কোন মূল্যে ছেলেটির সুনাম রক্ষা করতেই হবে তাকে, নিজের মেয়ের জীবন ধ্বংস করে হলেও। এর চেয়ে ভাল কিছু শেখার সৌভাগ্য এই নারীর হয়নি। মানুষ মাত্রই স্বার্থপর, নিজের অজান্তে হলেও সে নিজের ভালমন্দটাই আগে দেখে।

এই পরিবারের কাহিনী শুনে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল আমার ছেলের বড় হবার সময়টাতে তার সাথে আমার একটা কথোপকথনের কথা।

ছেলের কন্ঠস্বর যখন প্রথম ভাঙ্গতে শুরু করলো, ওষ্ঠের উপর হালকা গোঁফের রেখা দেখা দিল, একদিন তাকে কাছে ডেকে বলেছিলাম, ‘তুমি বড় হচ্ছ, এখন নানান রকম অনুভূতি কাজ করবে তোমার মধ্যে। মেয়েদেরকে নিয়ে নানান রকম ভাবনা, ইচ্ছা, বাসনা দেখা দেবে। অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করবে, যার সবটা হয়তো মেয়েদের জন্য সম্মানজনক নয়।

একটা কথা মনে রেখো, তোমার মাও একদিন একটা ছোট মেয়ে ছিল এবং তার আশেপাশের অনেক পুরুষ তার সাথে অশোভন আচরণ করেছে, নানান ভাবে তাকে অপমান করেছে, কষ্ট দিয়েছে। তুমি যেন কখনো কোন মেয়ের সাথে এমন কোন আচরণ না করো যাতে তার ক্ষতি হয়, কষ্ট হয় বা অপমান হয়। নিজের মধ্যে খারাপ কোন ইচ্ছা টের পেলে সবসময় তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে’।

অস্বীকার করবোনা, এই কথোপকথন খুব একটা আনন্দের ছিল না। কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার কন্ঠস্বর বারবার কেঁপে যাচ্ছিল। আমার ছেলে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘মা, তুমি কি আমাকে খারাপ ছেলে ভাবো?’ কিন্তু আমি জানি, আমার ছেলে কোনো মেয়েকে নিপীড়ন করার আগে একবার আমার কথা ভাববে।

আমি জানি না কয়জন বাংগালি মা তার উঠতি বয়সের ছেলের সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু আমার মনে হয় যদি প্রতিটি মা তার নিজের ছেলেকে ছোট থেকে এসব বিষয়ে সাবধান করে দিতেন, শারিরীক আকর্ষণের স্বাভাবিকতার কথা বুঝিয়ে বলতেন, এবং কখন ও কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, তা আলোচনা করতেন, তাহলে সম্ভবত ছেলেদের মধ্যে এই প্রবৃত্তি কিছুটা কম কাজ করতো। একটা মেয়ের গায়ে হাত দিতে গিয়ে তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়তো।

তেরো বছর বয়সে প্রথম মাসিক ঋতুস্রাব হবার পর আমার মা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ছেলেদের থেকে যেন দূরে থাকি। এই সাবধানতার প্রয়োজনের কারণগুলো তিনি আমাকে বুঝিয়ে বলেননি, কিন্তু আমি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলাম, বড় হচ্ছি কাজেই ছেলেদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে।

মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের অনেক ভাবনা, অনেক সতর্কতা। একটা মেয়ে একটু বড় হবার পর থেকেই তাকে ওড়না পরতে শেখাই আমরা এই ভেবে যে বুকের উপর একফালি কাপড় তাকে পুরুষের কামদৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখবে। রাত বিরাতে একা একা তার বাইরে যাবার প্রশ্নই উঠেনা, যদি কিছু ঘটে যায়। পুরুষদের সাথে তার মেলামেশা করা বারণ, কারণ তাতেও সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

প্রতিটা বাংগালি মেয়েকেই তার বাবামা পুরুষের হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য হাজারটা উপদেশ আর নিষেধাজ্ঞা দেন, কিন্তু নিজেদের ছেলেদেরকে কি তারা কখনো বলেন, ‘বাবারা, নিজেদের কামচিন্তা একটু চেক দিয়ে রাখিস?’

আপনারা যারা এই লেখাটি পড়ছেন, আপনারা যারা নারী, আপনাদের যাদের ছেলে সন্তান আছে, তাদেরকে অনুরোধ করব এই মহিলার উপর রেগে গিয়ে সময় নষ্ট না করে আসুন তার জীবন থেকে কিছু শিখি আমরা। এই বোধটুকু অর্জন করি যে আমার ছেলে, আমার বাবা, আমার ভাই, আমার স্বামী কেউই নারীর প্রতি অপরাধের উর্ধ্বে নয়। আমার সাথে সম্পৃক্ততা বা আত্মীয়তা একটা পুরুষের চারিত্রিক গুণাবলীর সনদ হতে পারে না।

নিজের মেয়েকে সাবধান থাকার উপদেশ দেবেন, সেটা ভালো কথা, কিন্তু একই সাথে নিজের ছেলেটিকেও মেয়েদেরকে সম্মান করার উপদেশ দিন। হরিণকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে হরিণকেই শেকল দিয়ে বাঁধবেন, সেটা কেমন কথা? তার চেয়ে বাঘকেই খাঁচাবন্দী করা উচিৎ নয়  কি?

শেয়ার করুন: