ঈশ্বর নাকি নশ্বর-১

মাকসুদা আজীজ: আমি যখন এগ্রিবিজনেসে গ্রাজুয়েশনে ভর্তি হলাম আমাদের প্রথম সেমিস্টারে একটা কোর্স ছিল Animal Husbandry. এই শব্দটা শোনার আগে আমি কখনও ভেবে দেখিনি Husband শব্দের অর্থ কী। হাসবেন্ড অর্থ প্রতিপালক আর হাসবেন্ডারি অর্থ প্রতিপালন করা।

বাংলা স্বামী শব্দটা কোথা থেকে এসেছে আমি ঠিক জানি না তবে এর অর্থও নাকি প্রভু। পতি অর্থও প্রভু। এইসব কথা শুনেও যাবা বুঝতে পারবেন না প্রভু কী এবং তাকে কীভাবে আরাধনা করতে হয় সেজন্য আছে বাংলা সিনেমার নায়িকা শাবানা। তিনি প্রায় এক যুগ ধরে বঙ্গনারীকে অক্লান্তভাবে পতি ধর্ম শিখিয়েছেন। সুখের কথা হল তিনি চলে যাওয়ার পরেও ধর্মগুরুর অভাব হয়নি, শুধু যুগের সাথে তারা তাল মিলিয়েছেন। হালের জনপ্রিয় নাটক Mr & Mrs এ তাহসানের বৌ মিথিলাও সেটা খুব ভালোভাবে দেখিয়েছেন।

Maksuda Aziz
মাকসুদা আজীজ

এখন কথা হলো স্বামী ঈশ্বর হলে আমার কিসে বাঁধে? আসলে স্বামী ঈশ্বর হলে আমার কিছুতে বাধা উচিৎ না। বরং আমার স্বামী এতো সুপ্রিম পাওয়ার পেয়ে গেলে আমারই সুবিধা। সুপার পাওয়ারের সাথে দোস্তি করতে কে না চায়!

কিন্তু সমস্যা হলো বিবাহ নামক বন্ধনে সমাজ যাকে আমার স্বামীর স্বীকৃতি দিয়েছেন, তিনি ঈশ্বর নন। তিনি সাধারণ একজন মানুষ। সকালে মনে না করিয়ে দিলে ওষুধ খেতে ভুলে যান, তার দুইটা ভয়ানক এবং সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়ে মাস্টার্স আছে, তবুও তিনি সরিষা ইলিশ রান্না করতে পারেন না। নিজের জামা কাপড় যদিও বা গুছিয়ে রাখতে পারেন, তবু প্রায়ই ভুলে যান মোজা-জোড়া গিঁট দিয়ে এক জায়গায় রাখতে হবে।

মানুষের মতো তারও জ্বর আসে, পেট খারাপ হয়, রাগ উঠে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার উপস্থিতি বা অবদানকে যদি আলোচনায় না আনা হয়, নিজের কাজ করার তার জন্য বুয়া, ড্রাইভার, লন্ড্রি-ম্যান, কৃষক, ময়লাওয়ালা সবাইকে লাগে। এদের মধ্যে একদিনও যদি একজন মানুষও কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তিনি বিরাট বিপদে পড়ে যান। আমি জানি রক্ত মাংসের নারীদের সাথে যে কয়জন রক্ত মাংসের পুরুষের বিবাহ হয়েছে তারা প্রত্যেকেই কম বেশি এমন। তারা মানুষ। অতি সাধারণ মানুষ। শুধু এটা স্বীকার করতে তাদের পৌরুষে খুব লাগে।

সুখের কথা হল আমার সঙ্গী জানেন তিনি যে ঈশ্বর নন। তিনি মানুষ এবং তিনি নশ্বর। আমার কোনো বিপদ আসলে তিনি আশা করেন না, আমি বিপদ থেকে উত্তরণের পথ না খুঁজে তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ব। অথবা চলার পথে তার অনুগ্রহ প্রার্থী হব। উল্টো চলার পথে আমরা একে অপরের সহায়তা নেই। পরস্পর সেটা স্বীকারও করি।

আমার স্বামী স্বীকৃত নশ্বর হওয়ার পরেও আশেপাশের নারীদের ঈশ্বররা মতান্তরে তাদের স্বামীরা আমাকে খুব পীড়া দেন। তারা তাদের কথা শুনে মনে হয় যেন বিয়ে করে একজন নারীকে তারা উদ্ধার করেছেন। এখন সেই নারীর দায়িত্বই হচ্ছে তার অনুগত থাকা। তিনি খেতে বললে খাবেন তিনি না বললে খাবেনও না। সোশ্যাল গ্যাদারিং এ এসেও এমন ভাব করবেন যেন বৌ তার কেনা গোলাম।

দুঃখের কথা হচ্ছে এইসব বৌয়েরাও স্বামীর বশ্যতা স্বীকার করে। একজনকে তো চিনি যাকে স্বামী তো স্বামী স্বামীর বন্ধুরাও যা-তা বলে যান। তবু তিনি তারই অনুগ্রহ গেয়ে বেড়ান।  সোশ্যাল গ্যাদারিং এ এসে গলা বাড়িয়ে বলেন, আপনার ভাইয়া তো আমাকে কাজই করতে দেয় না। আমার কষ্ট হবে তাই। তারপর আলাপচারিতায় বের হয় কাজ মানে হলো বাইরের কাজ, যেই কাজ করলে টাকা আসে, পরিচয় তৈরি হয়। এমনিতে ঘরের কাজ তিনি দিব্যি করেন। ঘরের কাজ যেন নির্বিঘ্নে করতে পারেন তা দেখার জন্য বাড়িতে লোকও আছে। এভাবে যুগে যুগে তাদের প্রভুর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ণ থাকে। আর তারা শাবানা ধর্ম পালন করে যান।

গোল বাঁধে এরা যখন আমাদের সাথে মিশতে আসেন। কারণ আমার সঙ্গী প্রভু না। সে সহচরী, প্রেমিক, বন্ধু, সহযোগী। কিছু জায়গায় আমি নেতৃত্ব নেই সে তখন অনুগত সহচর। কখনও সে নেতৃত্ব নেয় তখন আমি অনুগত সহচর। এ নিয়ে আমাদের বেশি গোল নেই। এরা এসে গোল পাকায়। একবার এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ালেও বিবি সাহেবেরা ১০০ বার করে বলেন, “আল্লাহ ভাইয়া এত কাজ পারেন?”  “ভাইয়া তোমার সব কথা শোনে!” “ভাইয়া কত ভালো!” সাহেবেরা মুখে নিমের তেতো নিয়ে বলেন, “ভালো বৌ নিয়া আসছিলাম বৌটা বুঝি আমার নষ্টই হইয়া গেল” অথবা এই ভেরুয়ার মতো আমার হইতে হইব নাকি? আমি হইলাম পুরুষ সিংহ, সর্বশ্রেষ্ঠ।”

এভাবে মেলামেশার ফলে যার যার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। প্রভুদের অনুগত ভক্তরা হঠাৎ সঙ্গী হতে চায়। আমার প্রাণের সঙ্গীর মাথায় তখন মাথা চাড়া দেয় প্রভু হয়ে উঠার প্রত্যয়। শুরু হয় যার যার দাম্পত্যে কলহ এবং তা শেষ হয় ক্রস কালচারে না মেশার আত্মপ্রত্যয় নিয়ে।

তবে সেই যে প্রমথ চৌধুরী বলে গেছেন, ব্যাধিই সংক্রামক স্বাস্থ্য নয়। তাই খুব কম সময়ই প্রভু ভাবেন যে আরে আমিও তো বন্ধু হতে পারি, প্রেমিক হতে পারি, সহচর হতে পারি।

অনুগত ভক্তকুল মনে দুঃখ চেপে বলে বেড়ান, “ঐ আপুর যা স্বভাব, বাপ রে বাপ জামাইরে তো আঙ্গুলের ডগায় নাচায়।” ব্যাধি এমনই সংক্রামক বস্তু যে আমিও মাঝে মাঝে ভাবতে বসে যাই কী আছে জীবনে, ভক্ত হয়েই জীবন কাটিয়ে দেই। আর যাই হোক ভাত কাপড়ের চিন্তা থেকে তো মুক্তি পাবো!       

শেয়ার করুন: