বিথী হক: আসলে আমাদের কোন দোষ নেই। মিডিয়া আমাদের চিন্তা-ভাবনার লাগাম ধরে কোথায় কতদূর ভাবতে হবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে। আর নাটক-সিনেমা তো আমরা দেখিই শেখার জন্য। যে লোক কোনদিন দুই পাতা পড়াশোনা পর্যন্তও করেনি, সে পর্যন্ত সিনেমা দেখে চোখ কচলাতে কচলাতে বলে ‘এই সিনেমায় কিছু শিখার নাই’।
তো এই যখন অবস্থা তখন শিক্ষা-ব্যবস্থারও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচার ফুরসত মিলে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নামে আস্ত একটা মন্ত্রণালয় না রেখে “চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিক্ষা” প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটালেও মানুষ যে তখন ঠিকঠাক শিখবে তারই বা গ্যারান্টি দেয় কে!

সেদিন খবর দেখতে রিমোট চাপতে চাপতে একটা বাংলা সিনেমায় চোখ আটকে গেল। ডায়লগগুলো এরকম- “বাস্টার্ড কোথাকার, তুমি আমার গায়ে ধাক্কা দিয়েছো কেন?”
নায়ক ভয়াবহ রকমের মাইন্ড খেয়েছে, খাওয়ারই কথা অবশ্য! অপরিচিত কেউ একজন “বাস্টার্ড” বললে তো গায়ে লাগবার কথা। তো, নায়ক বাহাদুর নায়িকা সুন্দরীকে কিছু না বলে কাঁধে তুলে খড়ের গাদা সজ্জিত একটা ঘরের ভেতর এনে ফেললো। তারপর নায়িকার আঁচল ধরে টেনে কয়েক পাকে শাড়ি খুলে ফেললো এবং গলা খাঁকিয়ে বললো, “আমাকে বাস্টার্ড বলেছিস তুই! আজ আমি তোকে শেখাবো বাস্টার্ড এর জন্ম কিভাবে হয়!” নায়িকা নায়কের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে তার প্রেমে পড়ে গেল। আমি মনে মনে ‘ইন্নালিল্লাহ্’ পড়ে চ্যানেল চেইঞ্জ করে ফেললাম।
বিশ্বাস করা, না করার বিষয়ে কথা বলা অবান্তর। সিনেমা সম্পর্কে ধারণা সবারই মোটামুটি আছে।
প্রায় প্রত্যেকটা সিনেমাতেই নায়কের অপরিহার্য ছ্যাঁচড়ামি দেখতে দেখতে ছেলেদেরও এখন বদ্ধমূল ধারণা, মেয়ের বাসার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ইতং বিতং করলে কিংবা মেয়ের স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই মেয়ের মন গলে যাবে। কয়েকবার “না” বলার পরেও তাদের মনে হয় আরো কয়দিন পেছনে পেছনে ঘুরলেই ঠিক কিছু একটা হয়ে যাবে। যদি না হয় তো একদিন জোর করে তুলে আনতে হবে। রাস্তায় যেতে যেতে, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশ্চয়ই প্রেম হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
কস্মিনকালেও মেয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী রাজি হবে না এমন হলে তো আরো উত্তম পন্থা অবশিষ্ট রয়েই গেছে। তুলে নিয়ে গিয়ে রেইপ করলে “আয় বাপ, আমার মেয়েটারে বিয়া কইরা আমার সম্মানের সতের খণ্ডের মলাট বাধ” বলে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন।
সমাজ যেহেতু তাদের সমুদয় সম্মান মেয়েদের যোনিস্থ করে রাখেন, সেহেতু পারিবারিক কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের স্ত্রী-কন্যার বিকল্প কিছু নেই। শত্রুর পরিবারের মেয়েদের হয়রানি করে বাহাদুরি দেখিয়ে নিজেদের পৌরুষ দেখিয়ে জাহির করেন কার কতোখানি ক্ষমতা।
এই যখন ঘটনা, তখন খুন হলো বলে গলা ফাটিয়ে লাভ নেই, শিশু ধর্ষণ নিয়ে গলা ফাটিয়ে লাভ নেই, ২০ বছর কোমায় থাকলেও ধর্ষিতার বিচার চেয়ে লাভ নেই। ছোটবেলা থেকে যখন ছেলে শিশুটাকে আদর করার সময় থেকেই সে যে বিশেষ যন্ত্রের অধিকারী বলে বুঝিয়ে আদর করেছেন, খুন তো তখনই হয়ে গেছে, ধর্ষণটা তখনই হয়ে গেছে। নিজের বাচ্চাটাকে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে না শিখিয়ে কোনটা ছেলের কাজ, কোনটা মেয়ের কাজ শিখিয়েছেন, তখনই ছেলেটা বুঝে যায় দুনিয়াটা তার পুরুষাঙ্গের তলে। সে যেটা যেভাবে খুশি, সেভাবে করার ক্ষমতা রাখে।
এবং এই পুরুষাঙ্গের সঠিক প্রয়োগ করতে ধর্ষণের জুড়ি নেই। আর নাটক সিনেমাতেও তো সে কথাই বলে। তাহলে এতো চিন্তার কী আছে! যৌন শিক্ষা বলে যে একটা টার্ম আছে সেটা তার যেমন জানার কথা না, সে বয়সে তার বাপও জানতো না। তাই তারা একসঙ্গে ভাবেন যৌন শিক্ষা অতিরঞ্জিত বিষয়, রেখে ঢেকে রাখার এই অতিরঞ্জন বিষয়কে ছেলেপুলের সামনে টেনে আনার দরকার কি! সে বয়সে তো তারাও এসব যৌন না মৌন শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞান লাভ করেন নি তো তাদের কি বাচ্চা-কাচ্চা হয় নি!
নাটক, সিনেমার কুরুচিপূর্ণ ভুলভাল ক্লিপের পাশাপাশি পর্ণোগ্রাফি দেখে আর চটি পড়ে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের জানতে হয় শারিরীক সম্পর্ক জিনিসটা আসলে কি, কিভাবে কি করতে হয়! নায়ক যেভাবে নায়িকার আঁচল টেনে শাড়ি খুলে ফেলল, সেটাই যদি তাদের মস্তিষ্কে স্থায়ী হয় তো আসলেই কি তারা দোসী? আর আপনি আমি দুধে ধোয়া তুলসী পাতা! ছেলেপুলেরা এসব দেখে দেখে পছন্দের নায়কের ভিলেন চরিত্রকে নিজের ভেতর ধারণ করে ডিপজলীয় কায়দায় সান্ডে মান্ডে কোলোজ করে যদি প্রেম করতে চায়, ধুম ৩ এর নায়কের মত চুরি করে বেড়ায় বা মেয়ের পেছনে পেছনে ঘুরতে ঘুরতে যদি তার জীবন তেজপাতাও বানিয়ে ফেলে, তো তার দায়টা কিন্তু তার একার না, সাথে আপনার এবং আমার আর তার সাথে সিনেমা নির্মাতাদেরও।
সুতরাং আজকের বদরুল, পরিমল, ওবায়দুলরা কিন্তু আজকে নতুন করে খুন করছে না, ধষর্ণও করছে না। তাদের মাথার মধ্যে প্রেম কি, যৌনতা কি, সম্মান কি সেসবের আলাদা কোন বর্ণনা নেই। তারা কিন্তু এসব শিখেছে সভ্যতার কাছ থেকে, সভ্য সংস্কৃতি থেকে। হাজার বছর ধরে ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান করে আসা মেয়েদের অসম্মান করে তৈরি করা সিনেমা, নাটক আর পারিবারিক শিক্ষা নিশ্চিত করে দেখেন তো শুধু আজ থেকে কয়েক বছর পরের চিত্রই তখন বলে দেবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল।
একটা বড় সমাধান হলো বিয়ে।