সুপ্রীতি ধর: ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশে যেসব এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন হয়েছিল, তার মধ্যে বাগেরহাট ছিল অন্যতম। ওই নির্বাচনের পর একটা বিশাল জনগোষ্ঠী দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। যারা একেবারেই বিত্তহীন, কোথাও যাবার সামর্থ্য নেই, তাদেরই অধিকাংশ রয়ে গিয়েছিল প্রতিনিয়ত শংকা আর আতংক বুকে নিয়ে।

সেই সময়ের ‘রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিত’ এলাকাগুলোতে গত ১৬ বছরে কী পরিমাণ হয়রানি, নিপীড়ন, নির্যাতন হয়েছে, তার পরিসংখ্যান কোথাও নেই, পরিসংখ্যানের প্রয়োজনও কেউ অনুভব করেনি। কেউ তাদের খবর রাখেনি। বলা হয়, এই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, উচ্ছেদ হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
২০০১ সালের আগে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কতজন ছিল, এখন কতসংখ্যক আছে, এটা জানতে পারলেই নির্যাতন বা হয়রানির একটা তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যেত। কিন্তু করবেটা কে? সংখ্যালঘুদের খবর রাখে কে? একদিকে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, অন্যদিকে প্রতিদিন অসংখ্য ‘মানুষ’ কাঁটাতার পেরুচ্ছে, এটাই কঠিন সত্য। বিশ্বাস না হয়, আপনারা ওপার বাংলার জনপদগুলো একটু হেঁটে আসুন।
মূলধারার গণমাধ্যমে প্রতিদিন অনেক খবর, সেখানে সামান্য এই সংখ্যালঘু ইস্যু স্থান পায় না, আসলে এটা বাজারদরে বিকোয় না বলেই নিউজভেল্যু নেই। তাই হঠাৎ যখন বাগেরহাটের মোল্লাহাট থেকে এক সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ ও সঙ্গে আরো কিছু নির্যাতনের খবর পেলেও আমাদের মধ্যে ভাবান্তর ঘটে না। আমরা কতকিছু নিয়ে ব্যস্ত, তাই ‘দরিদ্র’ ‘সংখ্যালঘু’ নারীর ওপর বর্বর নির্যাতন আমাদের নাগরিক জীবনে ছন্দোপতন ঘটায় না।
অনেকেই তনু, আফসানা, রিশা, খাদিজা এসব নাম তুলে আনছে। আমি কোনোটার সাথেই কোনটাকে মেলাতে চাই না। তাতে করে বিচারে বিপত্তি ঘটতে পারে। একেক ইস্যুর একেকরকম রাজনৈতিক অবস্থান। কুমিল্লা সেনানিবাসের ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যে ধর্ষণের পর তনুকে হত্যা আর মোল্লাহাটের ওই দরিদ্র সংখ্যালঘু নারীকে দিনের পর দিন আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনা এক না। একটা ঘটনার সাথে সেনানিবাস জড়িত, অপরটির সাথে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাহীনতা জড়িত। তবে দুটোর মধ্যে একটা বিষয়ে মিল আছে, তাহলো দুটোই রাষ্ট্রীয়। তনুর ঘটনা তো মোটামুটি ধামাচাপা পড়েই গেছে, এখন দেখবো, মোল্লাহাটের ঘটনা কতদূর গড়ায়! আদৌ এটা হালে পানি পাবে কীনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে আমার।
মোল্লারহাটের ঘটনাটি কিছু পরে মিডিয়াতে এসেছে। বোঝাই যায়, ক্ষমতার জোর কোনদিকে। তাও আবার সব মিডিয়াতে না। মূলধারার পত্রিকায় তো নয়ই। বিভিন্ন বিশিষ্ট বিশিষ্ট জায়গায় কাজের সুবাদে জানি, এ ধরনের নিউজ, বিশেষ করে যখন সেখানে সংখ্যালঘু তকমা লাগানো থাকে, তখন তথাকথিত বড় নিউজম্যানরা তা এড়িয়ে যান বা যাবার চেষ্টা করেন। এটা এমন কোনো ঘটনাই না তাদের কাছে। প্রতিমা ভাঙাও একইরকম, উচ্ছেদ কার্যক্রমও তাই।
এদিকে আরেকটি বিষয় খোলাসা হওয়া উচিত, মোল্লারহাটের ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে বলতে দেখছি যে, কোথায় সেই কর্পোরেট নারীবাদীরা? কোথায় আজ তারা? তাদের প্রতিবাদ নেই কেন? এমনকি সেই ‘নারীবাদী’দের তারা তথাকথিত লিটনের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিতেও দ্বিধা করছে না। যদিও এরকম ফ্ল্যাটের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার সম্যক কোনো ধারণা নেই। তবে বিষয়টি যে মানহানিকর, তা বোঝা যায়। অবাক হচ্ছি এসব দেখে-শুনে। রুচিহীন লেগেছে বলেই এড়িয়ে গেছি। কারণ আন্দোলনের মাঠে নেমে অন্তত বন্ধু-অবন্ধু চেনার বিষয়টি এখন সহজ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এদেশে নারী আন্দোলন কি শুধুই নারীদের আন্দোলন? এখনও এই যুগেও যারা এরকম ধারণা পোষণ করেন, তাদের জন্য একরাশ করুণা করা ছাড়া আর তো কিছু নেই। তো, আপনারা প্রতিবাদ করছেন না কেন? আমরা চুনোপুঁটিরা কে কী বললাম, তাতে কী আসে যায়? আর সব কথা আমাদেরকেই কেন বলতে হবে? বলতে হয়?
নারী নির্যাতন আজ জাতীয় ইস্যু, জাতীয়ভাবেই এর মোকাবিলা করা উচিত। ফেসবুকের কল্যাণে মেয়েটির ছবি দেখলাম, নাম জানলাম, এমনকি একটি ভিডিও দেখলাম, যেখানে মেয়েটিকে বার বার প্রশ্ন করা হচ্ছে, আপনাকে ধর্ষণ করা হইছে? মেয়েটি প্রশ্নের তোপে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমাদের এই নাগরিক সভ্যতার শব্দ ‘ধর্ষণ’ এর সাথেই পরিচিত নয় সে। কে জানে! সাংবাদিকতার সকল রীতিনীতি ভেঙে মেয়েটির ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেল, হয়তো তা দেখে লোকজন নিশ্চয়ই এরইমধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা শুরু করেছে যে, এমন একটি কালো, হ্যাংলা গ্রাম্য মেয়েকে এতোদিন ধরে ধর্ষণের কী দরকার ছিল! আর ভালো কেউ ছিল না?
ঘটনাটি এরকম: মোল্লাহাট উপজেলার চুনখোলা ইউনিয়নের শোলাবাড়িয়া গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের এক গৃহবধূকে ভয় দেখিয়ে ১৫ দিন ধরে ধর্ষণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ধর্ষক ওই পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখে। এমনকি তলোয়ারের কোপে ধর্ষণের শিকার নারীর পায়ের গোড়ালি কেটে গেলেও তাকে হাসপাতালে নিতে দেওয়া হয়নি। জানা গেছে, একপর্যায়ে গৃহবন্দী রাখার এই ঘটনা জানতে পেরে প্রতিবেশীরা আহত মেয়েটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে মোল্লাহাট উপজেলা হাসপাতাল ও পরে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। আহত অবস্থায় মেয়েটির স্বামী গত বৃহস্পতিবার রাতে মোল্লাহাট থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তবে গতকাল পর্যন্ত পুলিশ ধর্ষক শোলাবাড়িয়া গ্রামের মৃত মোহাম্মাদ মোল্লার ছেলে সোবাহান মোল্লাকে (২৮) গ্রেফতার করতে পারেনি।
উইমেন চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল। উনি তখন নামাজে ছিলেন এবং পরে কোরান শরিফ পড়বেন বলে তার এক সহযোগী ফোনটা ধরে জানান। তবে এটাও জানান যে, মামলা হয়েছে, অভিযুক্ত ধরা পড়েনি।
কথা হলো, এইদেশে কয়টা ঘটনায় অভিযুক্ত ধরা পড়ে? তাও তা যদি হয় ধর্ষণ সংক্রান্ত ঘটনা? তারও উপর সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের ঘটনা! এতো সোনায় সোহাগা! এদিকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতে তো আমাদের গলার তারই ছিঁড়ে যাচ্ছে প্রায়, কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতে কারও কোনকিছু আসছে-যাচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। মোল্লাহাটের সেই সোবহান মোল্লার কোমরের জোর কতো, রাজনৈতিক জোরই বা কতো, তা সবাই মিলে পরিমাপ করতে না নামলে তো সে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।
একজন বন্ধু যথার্থই লিখেছেন, কাদের মোল্লা থেকে সোবাহান মোল্লা…. ‘৭১ থেকে ২০১৬…. ধর্ষণের মহোৎসব, চলছে চলুক। চিৎকার করাই সার যখন, অসাড় হয়েই থাকি!