সুরাইয়া আবেদীন: আমি হা করে তামান্নার দিকে তাকায়ে আছি। তামান্না: চোখ মুছতে মুছতে আমি আর পারি না, রাতের পর রাত… ও যে কী জঘন্য…
আমি: জঘন্য তো তুইও।
তামান্না: মানে? আমি কেমনে জঘন্য হইলাম…
আমি: তুই কি বুঝতেছিস তুই আমাদের কি বলছিস?? আমার তো শুনেই বমি আসছে… তোর উচিৎ ডিভোর্স দেয়া। তা না কইরা এখন কান্দস… আবার বাচ্চাও নাকি নিবি!! তার থেকে মইরা যা।
তামান্না: কী বলিস এগুলা…
আমি: তুই পড়ছিস এমন এক ইন্সটিটিউট থেকে, যেখান থেকে এই দেশের ‘মাথা’ রা বের হইসে… সেখান থেকে পড়ে তোর মধ্যে যদি ‘আত্মসম্মান’ বোধ কাজ না করে, সরি টু সে দোস্ত আমি তোর আর গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ের মধ্যে কোনো তফাত করতে পারছি না।
বরং আমার বলা উচিৎ তুই আহাম্মক বেশি। গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে তাও কিছু করতে পারবে না। শিক্ষা নাই, স্বাবলম্বী না।
আর তুই শিক্ষিত স্বাবলম্বী হয়েও স্বেচ্ছায় ‘শিট’ নিজের জীবনের সাথে নিয়ে চলতেছিস…
উপরিউক্ত কথোপকথন তামান্নার সাথে…আমাদের বন্ধু সার্কেলে সবার আগে ওর বিয়ে হয়েছিল। বাবা-মা’র পছন্দের ছেলে।
বাপ-মায়েরা ‘ভাল ছেলের’ যে সংজ্ঞা জন্মের পর থেকে আমাদের মননে, রক্তে ঢুকায় দেন এই ছেলে সেই সংজ্ঞায় পরা একজন!
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের পর থেকেই তামান্না অন্যরকম…
এতো সুন্দর হাসিখুশি মেয়েটি বেজার থাকে…
অনেক চাপাচাপির পরেও কিছু বলে না।
শেষে মুখ খুললো।
ওর স্বামী বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত!
রিফিউজ করলে গালে ঠাস করে চড়…
চুল ছিঁড়ে ফেলা…
তামান্নার মতে ওর স্বামীকে দেখলে ওর ভয় লাগে…
আমাদের সমাজ এসব তামান্নাদের দিয়ে বোঝাই। এরা ‘সমাজ’ কী বলবে- এই এক জুজুর ভয়ে রাতের পর রাত অত্যাচারিত হয়, দিনের বেলা মুখে কিছু নিতে পারে না, ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটা যার জন্য অনুভব করে না, তার সন্তানের মা হবার স্বপ্ন দেখে।
এসব তামান্নারা বাবার বাড়িতে থাকাকালে মায়ের ধমক খেয়ে বাবার কাছে আহ্লাদি নালিশ করে, কিন্তু বিয়ের পর মাঝরাতে স্বামীর বিকৃত ইচ্ছা পূরণে ব্যর্থ হলে গালে ঠাস করে পরা চড়েও রা করে না…করতে পারে না, কারণ সেই জায়গাটিই আসলে তাদের থাকে না, শেখেও না রা কীভাবে করতে হয়।
এমন তামান্নারা সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা। আর্থিকভাবে নিজের উপর নির্ভরশীল থাকে। যেখানে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারার ক্ষমতা রাখে সেখানে বাঁচে আত্মসম্মানহীন পরগাছার মত।
কারণ?
ঐ একই কারণ!
সমাজ কী বলবে?
এসব তামান্নাদের কাছে ডিভোর্সি- তকমা সবচে অনিরাপদ বস্তু, কিন্তু দিনের পর দিন অপমানিত, অসুখী দাম্পত্য খুবই নিরাপদ।
আচ্ছা এতো কিসের ভয়??
শান্তি কোনটায় বেশি?
মিসেস অমুক হয়ে অপমানিত, অত্যাচারিত, অসুখী জীবন যাপনে? নাকি ডিভোর্সি তকমা নিয়ে আত্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচায়?
মানুষ মানেই তো আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কেউ! যার আত্মসম্মান নাই সে আবার মানুষ নাকি?
বিয়ে মানেই একসাথে দুইজন মানুষের পথচলা, যে পথ চলায় এক অন্যের প্রতি সম্মান আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ থাকবে। এই দুইয়ের অভাবে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাতে যে একজনও সুখী হয় না- এটা কি মাইক নিয়ে বলার বিষয়? নিজের থেকে উপলব্ধি করা যায় না?
আর সেক্স আপাতদৃষ্টিতে বিয়ে-পরবর্তী জীবনের একটা অংশ। ন্যাচারাল একটা ব্যাপার। সেই ন্যাচারাল কিছু যখন আন-ন্যাচারাল হয়ে যায় তখন পরিণতি কী হয়?
ভয়াবহ!
নিজেকে এভাবে পিষে মেরে ফেলার অর্থ কি?
রিফিউজ করলে গালে ঠাস করে চড়, লাত্থি, চুল ছিঁড়ে ফেলা নিয়ে একজন নারী কিভাবে বাঁচে!
প্রিয় তামান্নারা,
জীবন খুব ছোটো।
দেখতে দেখতে জীবন একসময় মৃত্যু নামক রূঢ় বাস্তবতার গহীনে হারিয়ে যাবে।
তাই যতোক্ষণ বাঁচো, আত্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে হাসিমুখেই বাঁচো…
সমাজ আমাদের তৈরি..
একসময় সতীদাহ সমাজের অংশ ছিল। তা এখন কই? ইতিহাসের বইয়ের পাতায়।
এমন একটা সমাজ একসময় তৈরি হবে, যখন ডিভোর্সি মানেই হোর, স্লাট এই তত্ত্বও ইতিহাস হবে।
সে সমাজ কবে আসবে জানি না…
তবে আসবেই।
সে সমাজের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই সে সমাজ নির্মাণের একজন হও।
কে জানে সে সমাজে সুস্থ মানসিকতার কেউ তোমার হাত ধরার মত সাহসী হবে।
যার কাছে ডিভোর্সি মানেই স্লাট আর হোর না, বরং ‘ভুল’ কারোর জন্য তিনবার কবুল বলে ফেলা একজন, বা সাত পাকে বাঁধা কেউ।
বেঁচে থাকা হোক অর্থবহ।
সকল তামান্নাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। খুব শিগগিরই হোক- এই একটাই প্রত্যাশা।