সাদিয়া নাসরিন: প্রিয় পুত্র, আজ কন্যা শিশুদের জন্য একটি দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ হয়তো তুমি এই কন্যা শিশু দিবস বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারছো না। তবে, আর একটু বড়ো হলেই তুমি যখন আস্ত একটা পুরুষ মানুষ হয়ে উঠবে এবং দেখবে বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনায় এই বিশ্বে এখনো কন্যাদের জন্য, নারীদের জন্য আলাদা দিবস পালন করা হয়, সেই একদিনের দিবস দেখেই তুমি বুঝতে পারবে বছরের আর বাকি সবদিন তোমার। এই পৃথিবীর আলো বাতাস, ইহকাল, পরকাল, সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান সবটাতেই তোমার অপার আধিপত্য। এই পৃথিবী তোমার।
তুমি আরো দেখতে পাবে, “নারী” নামে এই গ্রহে এক প্রজাতি আছে যারা মাংস আর লিঙ্গ বৈ আর কিছু নয়। সেই নারী প্রজাতির অধিকার সুরক্ষায় কত কমিটি, কত সনদ, কত নীতি তৈরী হয়!! তুমি নিজেও এসব কমিটিতে থাকবে, সনদে স্বাক্ষর করবে, নীতি প্রণয়ন করবে। এতোসব ইনভলবমেন্ট তোমাকে সমাজের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। শুধু নিম্ন থেকে আরো নিম্নতর হতে থাকবে যার জন্য তুমি এতো সব করছো তার অবস্থান। কারণ ততদিনে তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারবে তোমার হাতেই আছে একজন মানুষকে “নারী” করে তোলার নিরঙ্কুশ অধিকার।
পুত্র আমার! এই অধিকার, এই আধিপত্য আমিই দিয়েছি তোমাকে দিনের পর ধরে। তুমি যেদিন ভ্রুণ হয়ে এলে, সেদিন মাতৃত্বের আনন্দ বুঝে উঠার আগেই আমি কাতর হয়েছিলাম তোমার লিঙ্গ চিন্তা করে। কারণ তোমার লিঙ্গ পরিচয়ের উপর আমার ও সামাজিক অবস্থান নির্ভর করে কিনা! নয় মাসের প্রতিটা মুহূর্ত আমি তোমার নড়াচড়া অনুভব করেই তোমার লিঙ্গ বুঝতে চাইতাম। মুখে যাই বলি না কেন, আমি জানতাম তুমি, মানে একটা না দেখা পুত্র সন্তানই আমার সংসারটা নিরাপদ আর টেকসই করে তুলবে। এই পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তুমি হয়ে উঠেছিলে আমার ভাগ্য বিধাতা। আমার জঠরে তোমাকে ধারণ করেও আমি আমার সকল কিছু সমর্পণ করে বসেছিলাম তোমার লিঙ্গের কাছে।
তোমার জন্মের সাথে সাথেই আমি এবং আমরা তোমার লিঙ্গের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তোমার নাম দিয়ে দিলাম “পুত্র”। তোমার কানে বিশাল জোরে আজান দিয়ে জানিয়ে দিলাম তুমি “পুত্র”। তোমার জন্য দুটো খাসি জবাই করে আকিকা করে জানিয়ে দিলাম তুমি “পুত্র”। পৃথিবীর সমুদয় শক্তির সাথে মিল রেখে তোমার নামকরণ করে জানিয়ে দিলাম তুমি “পুত্র”। তোমার পাতে মাছের মুড়োটা পড়ে, কপালে ফুলচন্দন পড়ে। তুমি যখন বিছানাটা এলোমেলো করে যাও, আমি খুশি হয়ে ভেবেছি আমার সন্তান পুরুষ হয়ে উঠলো বলে! বলেছি, তোমার হাতে লাঠি মানায়, ঘরের ঝাড়ু নয়। তোমাকে বলেছি, ওই বারবি পুতুল আর রান্না-রান্না খেলা তোমার নয়। তোমার জন্য আছে ফুটবল, পিস্তল।
আমি তোমার জন্য রচনা করেছি সমগ্র বিশ্বসম্ভার। তোমার জন্য অবারিত করেছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান,আকাঙ্খা আর উচ্চাভিলাষের অধিকার। এই উচ্চাভিলাষে তুমি রাজ্য জয় করেছো, মহাদেশ আবিষ্কার করেছো, পৃথিবীর মানচিত্র বদলেছো, ভবিষ্যত নির্মাণ করেছো। আমি তোমাকে গড়েছি শক্তিধর, পরাক্রমশালী করে। আমি তোমাকে বলেছি তুমি বাদশা, তুমি এই সমাজের একেশ্বর। বলেছি তুমি চাওয়া মাত্র পাবে সব কিছু। তুমি জেনেছো, এই পৃথিবী, নারী, সমাজ, পরিবার, ধর্ম সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে তুমি।
ক্ষমা করো প্রিয় পুত্র। একটি লিঙ্গের ভেতর বন্দি করে তোমাকে মানুষ করার বদলে পুরুষ করেছি এই আমিই। আমিই তোমাকে শিখিয়েছি “ আমি পুরুষ” এই কথাটি কতটুকু গর্বের! আমি তোমার ভেতরে তৈরি করেছি এমন এক চেতনা যে চেতনায় তুমি নিজেকে ভেবেছো কর্তা, নারীকে কর্ম। আমি তোমার হাতে তুলে দিয়েছি মানুষকে মাপার মানদণ্ড, যে মানদণ্ডে তুমি পুরুষ “শুভ” হয়েছো, “প্রভু” হয়েছো আর নারী হয়ছে অশুভ, দাসি। এখানে তুমি “খাদক” আর নারী খাদ্য ছাড়া কিছুই নয়। তুমি যেখানে শিকারী, নারী সেখানে শুধুই শিকার।
দুই লিঙ্গকে এই পৃথিবী সমানভাবে ভোগ করতে দিইনি আমরা। “স্ত্রীলিঙ্গ” কথাটি কতটুকু অবমাননার তা আমরাই তোমাকে বুঝিয়েছি চোখের সামনে কন্যা শিশু জীবন্ত কবর দিয়ে। কন্যা সন্তান বেঁচে থাকে পিতার দয়ায়, তার জন্মে আজান দিতে হয় নিচুস্বরে, তার নামকরণ করা হয় একটা খাসি জবাই করে। আমিই তোমার কানে কানে বলে এসেছি কন্যারা অপবিত্র, অচ্ছুত। তোমার পবিত্রতায় কন্যারা নিজেদের রজঃ লুকিয়ে রাখবে। আমি তোমাকে বলেছি নারী তোমার অর্ধাঙ্গিনী, নারী তোমার শয্যাসঙ্গিনী, নারী তোমার শস্যক্ষেত্র। আমি দিয়েছি তোমাকে প্রেম ও শরীরের একচ্ছত্র মালিকানা, আর অবাধ যৌনতার স্বেচ্ছাচারিতা। তুমি পুরুষ হয়ে ভোগ করেছো, সম্ভোগে মেতেছো, জোর করেছো, অত্যাচার করেছো।
পুত্র! প্রকৃতির করুণায় তুমি এমন এক লিঙ্গের অধিকারী হয়ে পৃথিবীতে এসেছো যে লিঙ্গ তোমাকে ঈশ্বরের কাছাকাছি ক্ষমতা দিয়েছে। আমার হাত ধরেই সে ক্ষমতার চর্চা করেছ তুমি। তোমাকে লজ্জা আর পরিশীলতার শিক্ষা আমি দিইনি। বরং বলেছি, তোমার কাম-ক্ষুদা নিয়ন্ত্রণে কন্যারা “পরিশীলিত” থাকবে। তোমাকে বলেছি, তোমার লিঙ্গের কোনো লজ্জা নেই। তোমাকে জনসম্মুখে উলঙ্গ করতে আমি লজ্জা পাইনি, বরং গর্ব বোধ করেছি।
তুমি দেখেছো তোমার লিঙ্গ নিয়ে খেলা করা যায়, তোমার লিঙ্গে ঘুঙ্গুর পরিয়ে উৎসব করা যায়, তোমার লিঙ্গ পূজা করা হয়। এই লিঙ্গ তোমাকে এমন নির্ভয় করেছে যে, তুমি চাইলেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে হিসু করতে পারো, নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটতে পারো, যেখানে সেখানে উদ্যত হতে পারো। এমনকি প্রয়োজনে অন্যকে ভয় দেখাতেও পারো এই লিঙ্গ দিয়েই। তোমার শরীরের এই প্রত্যঙ্গটিকে তুমি অস্ত্র হিসেবে একসময় তাক করলে নারীর দিকেই।
পুত্র আমার! তুমি একদিন বুঝতে পারবে, লিঙ্গ নিয়ে বিশ্বব্যাপি যে নির্লজ্জ রাজনীতি চলেছে তার শিকার শুধু নারী হয়নি, তুমিও হয়েছো। লিঙ্গ রাজনীতি তোমাকে এনে ফেলেছে সভ্যতার এমন তলায়, যেখান থেকে তুমি আর মানুষ হয়ে উপরে উঠে আসতে পারোনি। তুমি পুরুষ হয়ে নারীকে শোষণ করেছো, নারী তোমাকে নারী হয়েই অবজ্ঞা করেছে। তুমি পুরুষ হয়ে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করেছো, নারী তোমার পৌরুষকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তুমি নারীকে দমন করেছো, নারী তোমাকে অবিশ্বাস করেছে, ভাংচুর করেছে।

প্রিয় পুত্র, ভেবো না। একদিন এই বিশ্ব বদলাবে। আজকের কন্যা শিশু দিবসে বিশ্বের সকল পুত্র সন্তানের কাছে জন্য আমার শুভকামনা পৌঁছে দিও। ওদের বলো, এই বদল ঘটাবে তোমরাই। কন্যারা তৈরি হচ্ছে। তোমরাও প্রস্তত হও। একদিন আমাদের পুত্র কন্যারা “মানুষ” হয়ে মানবতার মিছিলে এসে সাম্যের গান গাইবে এক সুরে।
হাজার বছরের লিঙ্গ রাজনীতির মসনদ গুঁড়িয়ে দিয়ে একদিন মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠবে এই বিশ্বে। সেইদিন কন্যা শিশুর জন্য বা নারীর জন্য বিশেষ দিন বা সপ্তাহের প্রয়োজন হবেনা।
সেইদিনের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতি,
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন ‘মা’
৩০.০৯.২০১৬