সুমন্দভাষিণী: একসাথে এতোগুলো খবর। আমাদের ফুটবলে সর্বজয়ী মেয়েরা এতোগুলো খেলা খেললো, জয় দিয়ে ভরিয়ে দিল বাঙালীর মন-প্রাণ সব। বিপক্ষের জালে একটা করে বল পাঠায়, আর আমরা ‘আমাদের মেয়েরা’ বলে গর্বে বুক ভারী করে ফেলেছি। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হেসে কেমন একটা বিজয়িনীর ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি কদিন। পারলে ওদের ছবি বাঁধাই করে ঘুরে বেড়াই আর কী!
‘আমাদের মেয়ে’ বলে কথা! নারী জাতির অগ্রগতী বলে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছি।
কিন্তু ওরা কি আদৌ আমাদের মেয়ে? আমাদের মেয়েদের মুখ কি বিবর্ণ? ওরা কি আধপেটা খেয়ে থাকে? মুখের কাছে নানারকম খাবার নিয়ে কত টালবাহানাই না করি আমরা। এতোদিন টানা সময় ঢাকায় থেকে দেশ-বিদেশের পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে মেয়েগুলোর হাতে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। তাও এই বয়সে ওরা একা ফিরছে বাড়িতে। সঙ্গে বড় কেউ নেই। পথে যদি বড় ধরনের কোনো বিপদ হতো, তখন? ভাবুন তো, আপনার কিশোরী মেয়েটাকে ওদের জায়গায়?
ধোবাউড়া যাবার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারাই জানেন, পথ কতটা অমসৃণ সেখানে। তাদের উঠিয়ে দেয়া হয়েছে একটা লোকাল বাসে সকাল আটটার দিকে, সেই বাস সারাদিন খ্যাংড়াতে খ্যাংড়াতে গন্তব্যে পৌঁছেছে তিনটারও পর। ওরা ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে একের গায়ে আরেকজন। হবারই কথা।
ওদের মুখগুলো বেশ চেনা, প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ওরা শিরোনাম হয়েছে, তারপরও নেহায়েত মেয়ে বলে ওরা পার পায়নি ওই বরাহশাবকগুলোর কাছ থেকে। শুনতে হয়েছে যতো রকমের অশ্লীল এবং নোংরা কথা। যে এর প্রতিবাদ করতে গেছে, তাদেরও শুনিয়ে দিয়েছে বখাটেরা। তবে বাসের অধিকাংশই ছিল নির্লিপ্ত। ওদেরই বা দোষ দিয়ে কী লাভ?
যমুনা টিভির রিপোর্টে তো দেখলাম, গ্রামের খেটে-খাওয়া মানুষগুলোর মুখ। দারিদ্র্য ওদের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দিয়েছে। তাই প্রতিবাদ তাদের মুখে রোচে না। যেদেশে মানুষের সামনে একজন স্কুলছাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে দিব্যি পালিয়ে যায় খুনি, সেখানে মুখের কথায় কার কী আসে যায়!
আর আমরা? আমরা যারা ‘আমাদের মেয়ে’ বলে অভিনন্দন, জয়বাংলা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলাম গত কয়েকদিন ধরে, মেয়েদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলাম, তারা কী করছি আসলে?
আমরা কি কখনও ওদের ঘরের খবর নেই? ওরা কেমন আছে, কেমন থাকে, কী খায়, আদৌ খায় কীনা, কত টাকা পায় এই ভয়াবহ শারীরিক কষ্টের খেলা খেলে, কিছুই জানি না। ওরা যেন আমাদের ড্রইংরুমের বাড়তি শোপিস। বাহ্, কী সুন্দর জয়ের আনন্দে দৌড়ানো মেয়েগুলো, সাজিয়ে রাখার মতোন শোপিসই বটে! বেড়াতে আসা লোকজনও এই ছবি দেখে ভাববে, আমি কতো নারীবাদী, মানবাধিকার কর্মী, ক্রীড়াপ্রিয় একজন। তাই না?
আসলে কিছুই না আমি বা আমরা। দিনশেষে আমরা হলাম হিপোক্রেট একেকজন।
এইতো সবে শেষ হলো রিও অলিম্পিক। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে এবার অসম্ভব ভালো করলো মার্গারিতা মামুন। রাশিয়ার হয়ে অংশ নিয়েছে সে। তার আরেকটি পরিচয় তার বাবা বাংলাদেশি আর মা রুশ। ব্যস, ‘রিতা আমাদের, রিতা আমাদের’ বলে বিলাপ শুরু করে দিয়েছিলাম আমরা অনলাইন-অফলাইনে। বিরক্তি ধরে গিয়েছিল আমার এই আদেখলাপনায়।
আমি হলফ করে বলতে পারি, এই রিতা যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশে থাকতো, জীবনেও কোথাও যাওয়া হতো না তার। অলিম্পিক তো দূর অস্ত। তখন তার পোশাক, চলন-বলন নিয়ে এমন সব নোংরামি হতো যে, ওর বাবা দেশ ছেড়ে পালিয়েও রক্ষা পেতো কীনা সন্দেহ আছে।
এই দেশে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যেই একটু ওপরে উঠতে যায়, যে ক্ষেত্রেই হোক, অমনি তাকে আংটা দিয়ে কষে টেনে নামানো হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা সাংঘাতিকভাবে প্রযোজ্য। মেয়েরা কোথাও একটু ভালো করলো তো শুরু হয়ে গেল তাকে নিয়ে নানারকম নোংরামি, অস্ত্র তো মোক্ষম। সেই অভাবী ঘরের মেয়েই হোক, আর জানাশোনা পরিবারের মেয়েই হোক। বিছানায় শুইয়ে দিতেও পিছপা হয় না এই সমাজের পুরুষগুলো।
বলছিলাম নানারকম খবরের কথা। রাতে ঘুমাতে গিয়েছিলাম কলসিন্দুরের এই তেজি মেয়েগুলোকে বাসে হেনস্থা করার খবর শুনে, এখন শুনতে পাচ্ছি ওদের স্কুলের শিক্ষকরা অভিভাবকদের অপমান করেছে, একজনের বাবাকে মারধরও করেছে, আবার একটি খবরে জানলাম, এই দ্বন্দ্বের জেরে স্কুল থেকেই মেয়েগুলোকে বের করে দেয়ার পাঁয়তারা করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
হায়রে জীবন! সাফল্যটুকু দুদিনও উপভোগ করতে পারলো না মেয়েগুলো। একদিকে অভাব, সংসারে টানাটানি, অন্যদিকে স্কুলের সাথে এই টানাপোড়েন, শেষপর্যন্ত মেয়েগুলোর ভবিষ্যত কী হবে, তাই নিয়ে চিন্তিত আমি। সামনের খেলায় যদি এদের মধ্যে দু’একজন না আসে, তাও আশ্চর্য হবো না।
২০১১ সালে কলসিন্দুর গ্রামের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা যখন মেয়েদের সংগঠিত করেছিলেন, তার পিছনেও ইতিহাস ছিল। এই কোচের নাম মফিজ উদ্দিন। তার ছেলেরা দিনের পর দিন ব্যর্থ হচ্ছিল, একটা ট্রফিও আনতে পারছিল না। এসময় তিনি এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। পরিবারের অসম্মতি, সমাজের ভ্রুকুটি কোনটাই তাকে দমাতে পারেনি। আর মেয়েরাও হতাশ করেনি। একের পর এক স্থানীয় জয়ের পর জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পেতে শুরু করে কলসিন্দুরের মেয়ে দলটি। ছড়িয়ে পড়ে নাম-ডাক। এমনও হয়েছে এই মেয়েদের কল্যাণেই প্রত্যন্ত গ্রামটিতে আজ বিদ্যুত পৌঁছে গেছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও অনেক লাভবান হবে এই গ্রাম, আমাদের দেশ, পক্ষান্তরে আমরা। কিন্তু যতদিন না আমরা এই পোড় খাওয়া মেয়েগুলোকে ‘আমাদের মেয়ে’ হিসেবে ভাষার চাকচিক্যে ভরে না রেখে সত্যি সত্যি নিজের মেয়ে ভাববো, ততদিন অনেক দূরের পথই মনে হবে সব অর্জন।
তাই আসুন, আজ, এখন থেকেই পাশে দাঁড়াই এই মেয়েদের। সংখ্যায় তো ওরা কয়টা মাত্র। ওদের একটু ভালো খাবার, পুষ্টিকর খাবার, একটু ভালো থাকা, আমরাই তো পারি মেটাতে। পারি না?