রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা: বেশ ভালো লাগছিল অনুর্ধ্ব -১৬ নারী ফুটবল দলের এএফসি কাপের বাছাই পর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় চারিদিকে তাদেরকে নিয়ে উচ্ছ্বাস, তাদের জয়জয়কার দেখে।
আমজনতার পাশাপাশি মেয়েগুলো একেবারে উপর মহল পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলেছিল, খেলা চলাকালিন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঘটনা নিয়ে দেয়া একজন এমপির স্ট্যাটাস দেখে প্রায় চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিল, “কাজের ফাঁকে ‘আপনার মেয়েদের খেলা দেখাচ্ছে’ বলাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই রিমোট দিয়ে টিভি অন করলেন তাঁর রুমে এসে, মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর। খেলা তখন আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকী, আমাদের কথা চলছে কিন্তু তাঁর দৃষ্টি টিভিতে।। আনন্দের দ্যুতি তার চোখেমুখে……….”।
দেশের সবাই জানে ঊনি খেলাধুলার খুব ভক্ত। সত্যিই খুব ভালো লাগছিল দেখে যে, দেশের টপ টু বটম সবাই মেয়েগুলোকে নিয়ে মেতে আছে।
কিন্তু পুরুষশাষিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের নিয়ে উচ্ছ্বাস কতোক্ষণই বা সহ্য করা যায়? কতোটাই বা মাথার উপরে তোলা যায়? তাই তো ভালোলাগার ঘোর কাটতে বেশী সময় লাগলো না। আজকেই “ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই মেয়েদেরকে লোকাল বাসে যেতে হলো বাড়ী” ধরনের পত্রিকার শিরোনাম দেখে মনটা ভরে উঠলো বিষাদে। অন্যান্য আরো খবর থেকে জানা গেলো, সেই লোকাল বাস রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলেছে এবং মেয়েগুলোকে বিভিন্ন কটুবাক্য হজম করতে হয়েছে বিভিন্নজনের কাছ থেকে। তো, কী হয়েছে? আমরাও তো পাড়ি দিয়েছি এসব। পুরুষরা কী বদলেছে একটুও? বরং আমরা পাল্টেছি, পাল্টাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
কৃষ্ণা, মগিনি, সানজিদা, মৌসুমীসহ আরো যারা ফুটবল খেলে-নয়জনই ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের মেয়ে। খুবই প্রত্যন্ত অঞ্চল। জীবনযাত্রার মান উন্নত নয় সেখানে। ফুটবল খেলতে গিয়ে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের নানা স্তরের মানুষের কাছ থেকে নানাবিধ কথা শুনতে হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছে, খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। তারপরও তারা ফুটবল খেলতে পেরেছে এটাই তো অনেক। বাড়তি হিসেবে পেয়েছে-
আন্তর্জাতিক মানের একটা খেলায় অংশগ্রহণ
বেয়াদ্দপের মতো হাফপ্যান্ট পরে খেলতে নামা
চান্সে পড়ে প্রতিপক্ষের জালে কোনমতে ২৬টা গোল দেয়া
এএফসি কাপের অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বে খেলা নিশ্চিত করা
অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়া
দেশের মুখ উজ্জ্বল করা
এতোকিছু পেয়েও আবার ইস্পিশাল গাড়ী? স্ট্যাটাস? কতো সখ! লোকাল বাস, বখাটেদের কটুক্তি, এগুলোই তো বেশ মানিয়ে যায়।
এদের অন্য যে বোনেরা ক্রিকেট খেলে তাদের বিষয়ে বেশ কিছুদিন আগে টিভিতে একটা সাক্ষাৎকারে দেখছিলাম, নারী ক্রিকেটারদের আগে কোন পারিশ্রমিকই দেয়া হতো না। এখনকার সালমা, জাহানারারা নাকি ১০/২০/৩০/৪০ হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক পায় সম্মানী হিসেবে। উপস্থাপিকা যখন পুরুষ ক্রিকেটারদের বেতন তুলে ধরে পাশাপাশি নারী ক্রিকেটারদের কথা বলে বিষয়টা যথেষ্ট বৈষম্যমূলক কীনা জানতে চাইলো, উত্তরদাতা কী সুকৌশলে এড়িয়ে গেলো এই বলে যে, আস্তে আস্তে সব ঠিক করা হবে। আদৌ ঠিক হয়েছে কীনা তা হয়তো হরিই জানে।
মেয়ে তুমি ফুটবল, হাডুডু, কাবাডি, ক্রিকেট যে খেলাই খেলো না কেন, তোমার জন্য ঐ লোকাল বাসই ভরসা। তুমি না পাবে উড়োজাহাজ, না পাবে কোন প্রাইভেট কার, নিদেনপক্ষে একটা উন্নতমানের বাসও না।
অনেকেই বলছে, তুমি শুধুই মেয়ে। তোমার আবার স্ট্যাটাস কিসের? না, কথাটা একেবারে সত্যি না। মেয়ে বলেই যুদ্ধটা প্রলম্বিত হয় ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধটা ছিনিয়ে নিতে শিখতেও হয়। ধরে নাও, যা হয়েছে, এটা তোমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
তোমাদের ১৭ সেপ্টেম্বর যে সম্বর্ধনা দেবে তাই তো বিশাল ব্যাপার। আবার বাফুফে তো কিছু নগদ অর্থও পুরস্কার ঘোষণা করেছে, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো মেয়েরা। অভিভাবক চেয়ো না, কেয়ারিং চেয়ো না। ভিআইপি মর্যাদা? ওটার কথা স্বপ্নেও ভেবো না।
সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৬