মারজিয়া প্রভা: বোরকা খুলছো, শাড়ি খুলছো, টি-শার্ট পরলে হেনস্থা করছো। মানে কী দাঁড়াচ্ছে! সেই একই ব্যাপার। আমি কী পরবো এবং পরবো না, তা ঠিক করছে সমাজ। বলা ভালো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ!
গত মঙ্গলবার ফ্রান্সের নিস শহরের বিচে একজন বুরকিনি (বোরকা+বিকিনি, সুইমিং এর জন্য শরীর ঢাকার বিশেষ ইসলামি পোশাক) পরা নারীকে সশস্ত্র পুলিশ বোরকা খুলতে বাধ্য করে। কারণ এক মাস আগেই প্যারিসের মেয়র নির্ধারণ করে দিয়েছেন জনসম্মুখে ‘নো বোরকা’। তাই বিচে একদঙ্গল মানুষের সামনে একটা মেয়েকে বুরকিনি খুলতে বাধ্য করা হয়!
ছবিটি নিয়ে আমেরিকার বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকাগুলো তোড়জোড় করলেও ডেইলি মেইল পত্রিকা দেখিয়েছে, ছবিটি বানোয়াট। শুধু তাই নয়, আজ প্যারিস শহরে মেয়েদের বোরকা পরার প্রতি নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাখ্যান করেছে ফ্রান্সের উচ্চ প্রশাসন।
খবরটা নিঃসন্দেহে স্বস্তির। কিন্তু কিছু কথা থেকে যায়! কেন নারীর শরীরকেই বার বার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো? অনেকেই উদ্ভুত জঙ্গিবাদের কথা বলবে! বোরকাকে হাতিয়ার করে সন্ত্রাসীদের তৎপরতার কথাও বলবে। আমি নিজে ঘোর অবিশ্বাসী মানুষ। ধর্ম-কর্ম মানি না। আর তাই আমি মনে করি, বোরকা পরা বা না পরা রাষ্ট্রযন্ত্র কিছুতেই ঠিক করে দিবে না। যেমন দিবে না বিকিনি পরার ক্ষেত্রেও।
হ্যাঁ বিকিনি! নিউ ইয়র্ক টাইমস এ একটা লেখায় পড়লাম, ১৯৫৭ সালে ইতালির অ্যাড্রিয়েটিক সমুদ্রে গোসল করতে নামতে যাবার সময় এক মেয়েকে পুলিশ ধরে। চার্জ করে। নাহ! মেয়েটার গায়ে কোন বুরকিনি ছিল না! ছিল বিকিনি। তখনকার সময়ে পাবলিক প্লেসে বিকিনি পরাকে লোকে ঘোরতোর অভদ্রতা এবং অশ্লীলতা বলতো। আর তার জন্যই ঐ মেয়েকে চার্জ করা। জরিমানা করা এবং সর্বশেষে কথার বাণে বিদ্ধ করা।
ইতিহাসবিদ বলি আর প্রত্নতত্ত্ববিদই বলি, যুগ যুগ ধরে সকলের মতেই নারীর শরীর পুরুষদের যুদ্ধক্ষেত্রই। যুদ্ধ হচ্ছে তো নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে! সম্প্রতি আইএস এও দেখা যাচ্ছে যৌনজিহাদি। পুরুষ যখনই চেয়েছে তখনই নিজের প্রয়োজনে নিয়ম সৃষ্টি করেছে নারীর শরীরের উপর।
এই উপমহাদেশেই একসময় চালু ছিল “স্তন কর”। নিচু জাতের মেয়েরা স্তন আবৃত করতে চাইলে কাপড়ের সাইজ অনুযায়ী কর দিতে হতো তাদের। নাঙ্গেলি নামের এক বীরকন্যা এই করের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। সে নিজের ইচ্ছায় কাপড় দিয়ে স্তন ঢেকেছিল। ফলাফল উচ্চহারে কর নিতে ঘর ঘেরাও করে জমিদার বাহিনী। প্রতিবাদে নাঙ্গেলি নিজের স্তন জোড়া কেটে দেয় তাদের হাতে। মৃত্যু হয় তার।
তো কী বুঝলেন!
আমার স্তন ঢাকা কিংবা না ঢাকা, ক্লিভেজ দেখানো কিংবা না দেখানো, শরীর সম্পূর্ণ কাপড়ে আবৃত করা কিংবা না করা, সবসময় এই নিয়মগুলো ঠিক করে এসেছে সমাজ। সমাজপতিরা এক হয়ে মেয়েদের শরীরের উপর জোর খাটিয়ে দেখিয়েছে তাদের ক্ষমতা।
প্যারিসে অনেক আগেই “ফেস কভার” করা নিষেধাজ্ঞা হয়েছে। যোগ হতে যাচ্ছিল বুরকিনি পরাও। কিন্তু কেন মেয়েদের শরীর বার বার scape goat হবে? যদি বলি সেটা আপনার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এর কারণেই!
পহেলা বৈশাখে মেয়েটার শাড়ি খোলা ঠিক মনে হয়েছিল একদিন আপনার, সেই আপনিই মেয়েদের ‘হিজাব নিষেধাজ্ঞা’ এর প্রতিবাদ করেন। কেন সেদিনের শাড়ি খোলা অন্যায় না মনে হলে পরেরটা আপনার কাছে অন্যায় মনে হয়?
দুটোর মাঝে আমি কোন ফারাক দেখি না, দুটাই আমার কাছে নারীকে শ্লীলতাহানি করার নামান্তর।
স্টাডি করলে দেখা যায়, আইন প্রণয়ন, ধর্মীয় নীতি আর সমাজের চাপ এই তিনটার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নারীর পোশাকে। আমাদের দেশের মেয়েরা তাই ওপেনলি বিকিনি পরার পরিস্থিতি পায় না। যেমন সৌদি আরবের মেয়েরা হিজাব ছাড়া ভাবতেও পারে না। যেমন মুসলমান মেয়ে টিপ পরলে পাপে তাপে পড়ে।
বিকিনি, বোরকা, শাড়ি, টি শার্ট, কামিজ সবই আসলে একটা পোশাক বৈ অন্য কিছু না। সময়ে সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক নারীর গায়ে পরিয়ে সমাজ তাদের নিজেদের হিম্মত দেখায়!
ফ্রান্সে ইসলাম বিষয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। আখড়া হচ্ছে আমেরিকাতেও, ট্রাম্পের ভূমিতে। হিজাব, বোরকা এখন ওদেশের মুসলিম মেয়েদের জন্য হুমকিই হবে! তার দেখাদেখি কী এই দেশে শাড়ি পরা বন্ধ হবে? টিপ পরতে দিবে না?
এই যুদ্ধ, এই বিগ্রহ, এই ক্ষমতার লড়াই! নাহ! কোনটার জন্যই তো নারী দায়ী নয়! তবুও এইসবের জন্য নারীকেই হারাতে হচ্ছে নিজের শরীরের প্রতি নিজের অধিকার! কিন্তু সেটা কেন? প্রশ্ন করেছেন কখনও নিজেকে?
নারী কি পড়বে সেটা চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। নারী যদি ধর্ম মেনে ধর্মীয় পোশাক পরে অথবা ধর্মীয় পোশাক না পড়ে যদি ভিন্ন পোশাক পড়ে তাতে তাঁকে বাধার ও তাঁর পরনের কাপড় খোলে নেওয়ার অধিকার কারোর নেই। এটা তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকার। আমরা স্বাধীনতার কথা বললেও ঠিকই অন্যের স্বাধীনতা হরণ করি।
বুককিনী পড়া মুসলিম মহিলাদের আশে-পাশে ঘিরে বিকিনি পড়া মহিলাদের ভীড়, যাদের শ্লীলতা হানি করে চলছে পুরুষকূল প্রতি নিয়ত।