নিপীড়িত ও ব্যথিত গুলতেকিন খান

সীনা আক্তার: ”তোমাকে বিয়ে করাই আমার ভুল হয়েছে”- স্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্বামীর বলা এরকম একটি সংলাপ হুমায়ূন আহমেদের লেখায় এবং নাটকে একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। চরম অপমানজনক এই বাক্যটি শুনেছেন এমন বিবাহিত নারীর সংখ্যা আমাদের সমাজে কম না।

Gultekin 3গুলতেকিন খান কি তাদের একজন? পরোক্ষভাবে গুলতেকিনের উদ্দেশ্যেই কি অবমাননাকর ওই সংলাপ? তা হয়তো জানা যাবে না। বলা হয়, শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনের ক্ষত অনেক গভীর এবং এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে ‘মানসিক নির্যাতনকে’ প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় বা লঘু করে দেখা হয়। চিৎকার-কটূক্তি, অবমাননা, দোষারোপ-অনুযোগ, লজ্জা দেওয়া এবং কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণকারী আচরণ মানসিক নির্যাতনের আওতায় পড়ে। উন্নত দেশে মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন দণ্ডণীয় অপরাধ।

প্রথমত, পরিস্থিতি এবং অবস্থার কারণেই গুলতেকিন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়সে তিনি গৃহশিক্ষক হুমায়ূন আহমেদের প্রেমে পড়েন। এ বয়সীরা শারীরিক-মানসিক পরিপক্কতার অভাবে সর্বোচ্চ আবেগপ্রবণ থাকে, যা জটিল চিন্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্তরায়। ফলে এই বয়সী ছেলে-মেয়েদের খুব সহজেই প্ররোচিত করা যায়। সাধারণত ১৯-২০ বছরের আগে জীবন সম্পর্কে একজন মানুষের পূর্ণ উপলদ্ধি হয় না। সেজন্য বলা যায়, গুলতেকিন গ্রুমিং এর শিকার হয়েছিলেন।

Gul-Hum Collageশিশু গ্রুমিং (Child grooming) হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া, যেখানে প্রাপ্তবয়ষ্ক কেউ কোনো শিশুর সাথে বিশেষ সম্পর্ক তৈরির উদ্দেশ্যে সেই শিশুটির আস্থা অর্জনের জন্য একটি মানসিক সংযোগ তৈরি করে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্যই হচ্ছে শিশুটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক। এই প্রক্রিয়ায় অনেক শিশু এবং অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে না যে তারা নিপুণভাবে বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কারণ এর কু-কৌশল প্রয়োগের অংশ হচ্ছে  শিশুটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদান এবং বলা ‘তুমি আমার ভালবাসা’।

প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তির সাথে অ-প্রাপ্তবয়ষ্ক’র সম্পর্ক প্রায়ই নিপীড়নমূলক, কারণ দুজনের মধ্যে অবস্থান এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। অসম বয়সী বিয়েতে কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ, পারিবারিক সহিংসতা-নির্যাতন একটা সাধারণ ঘটনা। এর পাশাপাশি আছে অল্প বয়সে দাম্পত্যের চাপ, গর্ভকালীন শারীরিক-মানসিক ধকল, কষ্টকর পারিবারিক দায়িত্ব, বিষন্নতা ইত্যাদি।

১৬ বছরে বিয়ে এবং ১৮-১৯ বছরের মধ্যে দুই সন্তানের জননী গুলতেকিনের হয়তো কম-বেশী সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে।

অভিজাত, উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে গুলতেকিন খান এক সাধারণ পরিবারে, একটি ‘মিথ্যায়’ সুসজ্জিত বাসর রাত দিয়ে বিবাহিত জীবন শুরু করেন (হু.আহমেদ: অনন্ত অন্বরে)। পাঠক হিসাবে ঘটনাটি পড়তে যতটা রোমাঞ্চকর, এর বাস্তবতা ততটাই নিষ্ঠুর, যা কেবল গুলতেকিনই হয়তো অনুধাবন করেছেন। তিনি হয়তো নতুন জীবনের উচ্ছ্বাস, সহনশীলতা এবং স্বামীর স্বজনদের আন্তরিকতায় সেই কঠিন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন।

Gultekin 2কিন্তু আমেরিকায়, ভিন দেশের ভাষা-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এবং ঘর-সংসার-বাচ্চা পালনের দায়িত্ব, সব মিলে গুলতেকিনের জীবন মনোরম ছিল বলে মনে হয় না। এছাড়া তাঁর মানসিক কষ্টের আরও কারণ ছিল যেমনটা হুমায়ূন আহমেদের লেখায় দেখা যায়,  

”অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে কুৎসিত একটা ঝগড়া করলাম গুলতেকিনের সঙ্গে। সে বিস্মিত গলায় বারবার বলতে লাগলো,  তুমি এরকম করে কথা বলছ কেন? এসব কি? কেন এরকম করছ?

: আমি চেঁচিয়ে বললাম, ভাল করছি।’

: তুমি খুবই বাজে ব্যবহার করছ। কেউ এরকম ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে না।

: কেউ না বলুক, আমি বলি।

: আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।

: চলে যেতে চাইলে যাও। মাই ডোর ইজ ওপেন …

সে কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো, তারপর নোভাকে চুমু খেয়ে এক বস্ত্রে বের হয়ে গেল। আমি মোটেই পাত্তা দিলাম না।” …  (হু.আহমেদ: হোটেল গ্রেভার ইন)

Gultekinবলাই বাহুল্য, ক্রোধ নির্যাতনের সূত্রপাত ঘটায়। গুলতেকিনের প্রতি সেই ‘কুৎসিত’ ব্যবহার কতটা নিষ্ঠুর ছিল তা আমরা জানি না। তবে বিদেশে আত্মীয় পরিজনহীন পরিবেশে একজন অষ্টাদশী একাকি যখন বাড়ি ছাড়েন এতে মানসিক অত্যাচারের মাত্রা অনুমান করা যায় বৈকি। যদিও হুমায়ূন আহমেদের লেখার যাদুতে সেই ‘কুৎসিত’ ব্যবহারের রুঢ়তা বোঝার উপায় নেই। তাঁর লেখায় ফাঁকি আছে যা আগের লেখায় উল্লেখ করেছি। যাই হোক, তাঁর লেখায় এ ধরনের বিশ্রী ঘটনার পুনারাবৃত্তির আভাস পাওয়া যায়।

”(হু. আহমেদ) আমি বললাম, আমেরিকা তোমাকে বদলে দিয়েছে।

: হ্যাঁ দিয়েছে। এই বদলানোটা কি খারাপ?

: না।

: না- বলার সৎ সাহস যে তোমার হয়েছে সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তবে এ বিদ্রোহ এখানে আমি করতে পারলাম, দেশে থাকলে তা কখনো করতে পারতাম না। দিনের পর দিন অপমান সহ্য করে পশু শ্রেণীর স্বামীর পায়ের কাছে পড়ে থাকতাম।

: আমি কি পশু শ্রেণীর কেউ?

: হ্যাঁ। নাও, চা খাও। তোমার চেহারা এত খারাপ হয়েছে কেন? এই দুদিন কিছুই  খাওনি বোধহয়।

বলতে বলতে পশু শ্রেণীর একজন মানুষের প্রতি গাঢ় মমতায় তার চোখে জল এসে গেল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি এর পরেও তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে এবং তবুও আমি বারবার তোমার কাছেই ফিরে আসব।” (হু.আহমেদ: হোটেল গ্রেভার ইন)

আমাদের দেশের মেয়েরা সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায়, অবমাননা-অবহেলা সহ্য করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে মানিয়ে নিতে। বিশেষ করে গুলতেকিনের মত যারা নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করে তাদের অসহায়ত্ব নিদারুণ। এজন্যই হয়তো তিনি নিজের আকাংখা পূরণে অধিক দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।

বিদেশে দ্রুত ইংরেজি ভাষা রপ্ত করা, ভিনদেশি বাচ্চাদের বেবি সিটিং এর যোগ্যতা অর্জন এবং নিজের চার বাচ্চা লালন-পালন করে পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করা- এসব প্রমাণ করে তিনি মেধাবী-আত্মবিশ্বাসী একজন নারী। এসব গুণাবলী মানুষকে আত্মমর্যাদাশীল করে, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অধিকাংশ পুরুষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বুদ্ধিদীপ্ত, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী মেয়েদের তথাকথিত ভাল স্ত্রী মনে করে না।

হুমায়ূন আহমেদ এর ব্যতিক্রম ছিলেন না, কারণ পরোক্ষভাবে তিনি সেই মনোভাবই প্রকাশ করেছেন। যেমন: তাঁর লেখায় এক ছাত্রীর বক্তব্য, ”ছেলেরা এরকম স্মার্ট মেয়ে পছন্দ করে না, তারা চায় ‘পুতুপুতু’ ধরনের ভ্যাদা টাইপের মেয়ে।” (হু.আহমেদ: হোটেল গ্রেভার ইন, পৃ: ৫৩)

Sina Akhter
ড. সীনা আক্তার

আমেরিকা থাকাকালীন তাঁদের মধ্যকার বিরোধ-সংঘাত হয়তো সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এর কারণ সংসারে, হুমায়ূন আহমেদের পড়াশোনা-লেখালেখিতে গুলতেকিনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আবশ্যক ছিল। এছাড়া পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সেদেশের কঠোর আইন এবং দ্রুত সহায়তা গুলতেকিনের পাশে ছিল। ফলে তাঁর অবস্থান সুরক্ষিত ছিল এবং তিনি কিছুটা ক্ষমতাবান ছিলেন। এছাড়া, তাঁদের ভালবাসাময় সম্পর্ক, আবেগ-বন্ধন তো ছিলই। কিন্তু দেশে ফিরে পরিস্থিতির কারণেই গুলতেকিনের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁর নিজের উপার্জন ছিল না এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নিপীড়ন বিরোধী সহায়তা ছিল না। যাই হোক, আমেরিকা ফেরৎ জীবন, পড়াশোনা, মতবিরোধ বিষয়ে তিনি সামান্য স্মৃতিচারণ করেছেন এবং তা থেকেই তাঁর মানসিক কষ্ট বোঝা যায়।

‘নীরবতা ভাঙ্গো’ (break the silence)- নিপীড়নমূলক আচরণ প্রতিকার ও প্রতিরোধে সভ্যদেশে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রচার করা হয়। এর উদ্দেশ্য ভুক্তভোগীর কষ্ট লাঘব করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং অন্যদের সতর্ক বার্তা দেয়া। অন্যদিকে আমাদের দেশে ভূক্তভোগীর উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় অপমান-অবমাননা ও মনোকষ্ট হজম করতে।

তুমি অমুক-তমুক, তোমাকে এটা মানায় না, তোমার মান-সম্মান ইত্যাদি বলে তথাকথিত শুভাকাংখীরা কূটকৌশলে একজন ভুক্তভোগীর মধ্যে অপরাধবোধ সৃষ্টি করে। অপরাধীকে আড়াল করে নারীর উপর কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্যই এসব করা হয় এবং এভাবেই আমাদের দেশে পুরুষতান্ত্রিকতার দুষ্টচক্র টিকে আছে। গুলতেকিনের সাথে ‘কুৎসিত’ ব্যবহারের জন্য হুমায়ূন আহমেদের শিল্প-সাহিত্যের আবেদন ম্লান হবে না, আবার তাঁর সৃজনশীলতা ও খ্যাতির জন্য কোন অন্যায় আচরণ ন্যায্যতা পায় না।

সেজন্য খ্যাতিমানদের অন্যায় অধিক আলোচিত হওয়া দরকার, কারণ তাদের দ্বারা সমাজ প্রভাবিত হয়।

বিবাহিত জীবনে গুলতেকিন অবমূল্যায়ন, অবহেলা সহ্য করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চাপে সেই মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘদিন চেপে রেখে দ্বিতীয়বার নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

সম্প্রতি এক ঝলক স্মৃতিচারণে সেই মর্মপীড়া প্রকাশ করে অনেকের নিষ্ঠুর সমালোচনায় জর্জরিত হয়েছেন, মানে তৃতীয়বার নির্যাতিত হয়েছেন। তাঁর মানসিক ক্ষত কতোটা গভীর, মর্মবেদনা কতোটা তীব্র তা তিনিই কেবল অনুভব করতে পারেন, Only the wearer knows where the shoe pinches এবং তা ব্যক্ত করে মনোকষ্ট প্রশমনের অধিকার অবশ্যই তাঁর আছে।

ড. সীনা আক্তার: সমাজবিদ, প্যারেন্টিং পেশাজীবী।

শেয়ার করুন:

লেখকের সুনাম অার বিপুল জনপ্রিয়তার প্রতি সন্মান রেখেই বলছি- যত বড় প্রতিভাবান আর প্রগতিশীল ই হোন না কেন বেশীর ভাগ পুরুষ কেবল পুরুষই হয়, পুরুপুরি মানুষ হতে পারেনা। তারাই বরং রংঢং অার মোহনীয় বর্ননায় পুরুষ তান্রীকতাকে জন প্রিয় ও গ্রহণ যোগ্য করে তুলেন। অার আমরা বোকারা সেই রং মেখে ঢং করে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা করি। অামরাও কেবল নারী হওয়ার প্রতিযোগিতায় বিভোর থাকি, প্রকৃত মানুষ হতে পারি না।

Gultekin madamer egulo air beche thakte na bolata sandeho jonok.ekhon esob bole uni ki pacheen ami janina..protekta mea ja sojjo kore uni tar chaite besi korechen bojai jae.Humaun ahammed bole amra ta auto maf kore deachi.ami neje sawaon ke bea korar por onae boi porini.cacer hobar por abar porechi.but Gultekin madam thokon ki korechen.mrito baktir vabmurti nosto kore uni ki chaichen amar bodhogommo na.