ফাহরিয়া ফেরদৌস: উইমেন চ্যাপ্টার কথা বলে সমাজ নিয়ে, তুলে আনে নারীদের ভাবনা ও সমস্যা। তবে শুধু নারীদের কথা নয় বরং নারীদের চোখে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে আনছে দেশের ও দেশের বাইরে থেকে। নারীদের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যায় এই জায়গায়। আজকে বলতে চাই আইনজীবী হিসেবে একজন নারীর পথ চলা নিয়ে।
ছোটবেলা থেকে আমি একটু সহজ সরল। তথাকথিত মানুষের মতো চতুর বুদ্ধি আমার কোন দিনোও ছিল না। তাই আমি যখন এসএসসি পাশের পরই ঘোষণা দিলাম যে, আমি আইনজীবী হবো, আর তাই আমার বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার কোন দরকার নেই, তখন আমার বাবা আবাকই হলেন যে, আমার বোকা মেয়ে বলে কি!!
বাবার ইচ্ছা কন্যা ডাক্তার হবে, আর মেয়েরও তাই ইচ্ছা (মেয়ে ডাক্তার বলতেই ভালো লাগে), ওকালতি মেয়েদের দিয়ে হয় না, তার উপর আবার মেয়ের মাথায় বুদ্ধি কম, বংশে নাই কোন উকিল। তিনি বললেন, ঠিক আছে পড়বে, কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগে পড়লে তো সমস্যা নাই। বাবা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করলেন আমি যেন ডাক্তারি পড়ি। বারবার বললেন, ওকালতি অনেক কঠিন, মক্কেল কোথায় পাবা, প্রথম কয়েক বছর কোন ইনকাম থাকে না। কথা যে পুরোটাই অসত্য, তেমন নয়। তবে আমিও বললাম যে, পরিবারে যেহেতু কেউ উকিল নেই, তাই আমি উকিলই হবো।
আইনে পড়ছি তো কী হয়েছে, আইন পড়ে তো শুধু আইনজীবী হয় না, জুডিশিয়ারিতে পরীক্ষা দেয়া যায়, বিসিএস দেয়া যায়! আমার বাবা হাল ছাড়লেন না, আমাকে ইন্সপায়ার করতেন আমি যেন জুডিশিয়ারিতে পরীক্ষা দেই, কারণ তার মতে, ওকালতি মেয়েদের জন্য নয়, মেয়েদের উপর মানুষের ভরসা কম!

যে যেভাবেই দেখুক, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পেরে আমি আনন্দিত, এটি আমার জীবনের এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ পাওয়া।
যেহেতু আমার লক্ষ্য নির্ধারিত ছিলো, তাই, ২০০৯ সালে অনার্স ফাইনাল দেবার পরই আইন অঙ্গনে আমার পথচলা শুরু। আইনজীবী হিসেবে আমার ক্যারিয়ার খুব বেশিদিনের নয়, তবে আবার একদম কমদিনেরও নয়। আজকাল অনেক মেয়েই প্রশ্ন করে, আপু কেমন লাগে আপনার এই পেশাটা? খুব কি কষ্ট? আপু, আসতে চাই এই পেশায় বা আমার ল’ পড়া শেষ হলো, এখন ভাবছি কোর্ট প্র্যাকটিসে আসবো, আপু আপনি কী বলেন?
তখন মনে হয়, না, পরিশ্রম একদম বৃথা যায়নি। অনেক না হোক, একটা মেয়ে তো অন্তত আমাকে সাপোর্ট দিচ্ছে, আমাকে জিজ্ঞাসা করছে। আমার কাছে এটাই সার্থকতা। মেয়ে হিসেবে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয় যে, আমি পারি, আমি পারছি। আর এই পারাটা কিন্তু কেবল কাজেই নয়, অর্থ উপার্জনেও। কারণ যেকোনো কিছুর বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে সাফল্য গণনা হয়, কে কত পরিমাণ টাকা আয় করলো তার উপর।
আবার বিভিন্ন পেশায় পদোন্নতি হয়, কিন্তু একবার উকিল হলে সারা জীবনই উকিল থাকে, কোনো পদোন্নতি হয় না। তাই এই পেশায় কে, কতটুকু সফল তা পরিমাপের একটা মাপকাঠি হলো, কে, কত অর্থ উপার্জন করলো, তার উপর। সেই অর্থে, অনেক ‘অর্থ’ আমার উপার্জন নয়, আমার সমসাময়িক যারা এই পেশায় অথবা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে তাদের তুলনায়। তাই এখনও অসফল ভেবে হাসে পাশের মানুষ, পরিবারের মানুষও!
জীবনটাকে যতটা সহজ ভেবেছিলাম, ততটা সহজ নয়। অনেক প্রশ্ন, অনেক বাঁধা। এই পেশা আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু, শিখিয়েছে আসলে শেষ বলে কিছু নেই ও ধৈর্য্য ধারণ। কোনো সমস্যা পুষে রাখা ঠিক না, সবকিছুরই একটা সময় আছে, তাই সেই সময়ের মাঝেই সেই সমস্যার মোকাবেলা করা উচিৎ। সময়ের সাথে, পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলা। অনেক কিছু সহজভাবে মানিয়ে নেয়া।
পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কাজ করাটা আমার পেশার অংশ, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যায় এখন এটি আমার পেশার চেয়ে নেশাই বেশি হয়ে গেছে। এমন কোনদিন নেই যেদিন আমার কাছে একটি ফোন আসবে না, যেটি পারিবারিক সমস্যা সম্পর্কিত।
শেষ কয় মাসে আমার কাছে কিছু সমস্যা এসেছে, যেগুলো ব্যতিক্রমধর্মী, এবং ভাল কিছু করার অপশনও ছিল। কিন্তু না, সামজের ভয়ে মেয়েগুলোকে তাদের পরিবারগুলো কোর্টের বারান্দায় আসার আর সুযোগ দিল না। আবার কিছু মেয়ে বিচারের আশায় কোর্টের বারান্দায় গেলেও পায়নি ন্যায় বিচার! কিছু কাজে সফলতা না পাওয়াতে একঘেয়েমি লাগছিল, তাই কাজ করতে করতে একসময় ক্লান্ত লাগায় ভেবেছিলাম যে কিছুদিন ছুটি নিবো কাজ থেকে।
একজন আইনজীবীর কেবল কোর্টেই কাজ থাকে না। মামলার জন্য কাগজ প্রস্তুত করা, লেখাপড়া করা একটা বড় অংশ হয় কোর্টের বাইরে, যেটি সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই। স্বেচ্ছায় অবসরের প্রথম দিন সকাল থকেই ফোন, আর বেশিরভাগ ফোনই মেয়েদের, তাদের সমস্যা নিয়ে। আবার নূতন করে কাজ করার প্রেরণা পেলাম এই মেয়েদের ফোনগুলো থেকে। তাই কিছু মানুষের সমস্যা সমাধান করতে না পারলেও, অপর কিছু মানুষের সমস্যা সমাধান করতে পারবো, এই আশায় আবার শুরু করে দিলাম কাজ। কোর্টে না গেলেও সকাল থেকেই কাজ শেষ করছি ঘরে বসেই।
যে মেয়েগুলো আমার কাছে আসে, তার সিংহভাগেরই তেমন কোন নিজস্ব আয় থাকে না তাই, অনেক মেয়ের সমস্যা সমাধানের পর সেরকম ফি দিতে না পারলেও মন থেকে যে ধন্যবাদ দিয়ে যায় তাতে নূতন করে প্রেমে পরে যাই নিজের পেশার। জীবনটা ষোল আনাই সার্থক মনে হয়!
এক একটা মেয়ের জয় যেন আমারই জয়! একটা গান আমার খুব প্রিয়- “যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে”। গানটা সত্যিকার অর্থেই সত্য। জীবনের পথচলার পাশে ছিল এবং আছে কিছু নারীই। যখন আমি বললাম যে আমি ওকালতি করব, আমাকে টিকে থাকতে হবে, তখন অনেক মেয়েই আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় যখনই যে কেউ কোন আইনগত সমস্যায় পরে কোন আইনজীবী খুঁজেছেন, আমার এই বোনেরা নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেছেন আমার নামটি। আমার পথচলায় তাদের ভূমিকায় আমি প্রতিদিন অনুপ্রাণিত হই।
একজন আইনজীবীর জীবন আর দশটা মানুষের জীবনের চেয়ে ভিন্ন, আইনজীবীর জীবন রংধনুর মত, যেখানে সব রং আছে। আসলে এক-একটি মামলা মানে এক-একটি জীবনের ঘটনা, এক একটি পরিবারের ঘটনা। এই ঘটনাগুলো, ঘটনার সাথে জড়ানো মানুষগুলো তাদের অজান্তেই প্রতিনিয়ত কাজ করে থাকে আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা হিসেবে। এই মানুষগুলো, মেয়েগুলো আমাকে জানিয়ে দিয়ে যায় আমার অস্তিত্বকে; সার্থক করে দিয়ে যায় আমার বেঁচে থাকাকে, মূল্য দিয়ে যায় আমার লেখাপড়াকে।
: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
(বিশেষ ঘোষণা উইমেন চ্যাপ্টারের নারী পাঠকদের প্রতি: আইনগত যেকোনো জটিলতায় আমরা আপনাদের পাশে থাকতে চাই। বিপদে স্মরণ করুন আমাদের, লিখুন ফাহরিয়া ফেরদৌসকে)
ধন্যবাদ আপু। আপনার নম্বর থাকলে গরিবদের দিতাম