ডা. সাবরিনা ‘পতিতা’ হলে তার সঙ্গী পুরুষরা ‘পতিত’ নয় কেন?

সালমা লুনা:

ডা. সাবরিনা আরিফ।
পেশায় ডাক্তার। আর দশজন সাধারণ ডাক্তারের মতো হলেও তিনি আজকে দেশে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন।
কারণ ডাক্তার হয়েও তিনি একটি প্যানডেমিক অবস্থায় দেশের মানুষের সাথে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছেন। মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার মতোই অপরাধ করেছেন।
এমন অন্যায় করেছেন সাহেদ করিম। রিজেন্ট হসপিটালের মালিক।

সাবরিনা অন্যায়ের জন্য দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকজনকে ব্যবহার করেছেন।
সাহেদও করেছেন।
সাবরিনার ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে অনলাইনে।
সাহেদের ছবিও।
দুইজনের ছবিতে ভিন্নতা আছে।
সাবরিনার ছবিতে দেখা যাচ্ছে সুন্দর সাজপোশাকে, বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে মনোমুগ্ধকর লাস্যময়ী নায়িকাসুলভ ভঙ্গীতে সহজ স্বাভাবিক একজন নারীকে।
সাহেদের ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে পুলিশের বড়কর্তা পর্যন্ত সবার সাথে হাস্যমুখ সুবেশী একজন পুরুষকে।

ঝামেলা হয়েছে দুজনই অপরাধী হলেও একজনকে পুলিশ খুঁজেই পাচ্ছেনা। আরেকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
ঝামেলা আরেকটা হয়েছে।
পুরুষ অপরাধীটিকে রেখে নারী অপরাধীকে নিয়েই মেতে উঠেছে ফেসবুক সমাজ।
এইটুকু অস্বাভাবিকতা হলেও কথা ছিলো না।
পুরুষটির ভাগ্যকে আইনের হাতে ছেড়ে দিয়ে, সে কেন ধরা পড়ছে না এই মর্মে লোকজন মাতামাতি না করলেও নারীটিকে তারা প্রায় সবাই নিজের হাতে নিজের কাছে চাইছেন মনমতো শাস্তি দেয়ার জন্য।

পুরুষরা বিভিন্নভাবে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে শাস্তি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
নারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, কেন সাবরিনাকে আবেদনময়ী ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে হলো! কেন সে ডাক্তার হয়ে একটি সম্মানজনক পেশায় থেকেও এমন খোলামেলা উত্তেজক ভঙ্গীতে ছবি তুলে ফেসবুক সাজালেন!
কাজেই নারীরাও সাবরিনার সেসব ছবি নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করছেন। সেখানে তারা ওইসব বীর পুরুষদের ডাকছেন , এসো বাছা পাওয়া গেছে ধর্ষণের মাল। যে নারী নিজেকে ঢাকাঢুকি করে রাখে না, সে ধর্ষণেরই যোগ্য। এবং খোলাখুলিই বলছেন তার এইসব ছবি সামনে নিয়ে কামে জরোজরো পুরুষরা হস্তমৈথুন করবে, এটাই ওর শাস্তি।

যে পুরুষটি রেপ করে শাস্তি দেয়াটাকে অন্যায় মনে করেন, তিনিও ডা. সাবরিনার দুটি যৌন আবেদনমূলক ছবি খুঁজে বের করে নিজের টাইমলাইনে ঝুলিয়ে রেখেছেন সেই মালয় দেশের শেয়ালের মত। যে মুরগি এঁকে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতো অবসরে বসে চাটবে বলে।

নারীকে কোন না কোনভাবে, নিচে ফেলে যৌনাঙ্গ দিয়ে বিদ্ধ করতে পারলে অথবা মৌখিকভাবে শুধু জিহবা দিয়ে বিদ্ধ করতে পারলেই ক্ষমতার অথবা আক্রোশের সম্পূর্ণ পৌরুষীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এখন তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখে লিখেও ধর্ষণ করা যাচ্ছে।

এটা যে শুধু পুরুষরা করতে পারেন তা নয়। নারীরাও ক্ষোভ মেটাতে করছেন। যেন এটিই একটি নারীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়ার একটি স্বাভাবিক তরিকা ।

যারা এইভাবে না পারেন তারা গালি দেন বেশ্যা, নষ্টা বলে। আরেকটু ভদ্রভাবে বললে রাস্তার মেয়ে, অসভ্য মেয়ে বলে থাকেন।
এটিও সমাজ রক্ষাকারী হিসেবে তাদের একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

এইখানে অবশ্য একটা দ্বিমতের জায়গা আছে। কারণ সমাজ রক্ষাকারী না হয়েও এই নষ্টা ভ্রষ্টা বেশ্যা রাস্তার মেয়ে এই গালিগুলি নারীরাও অনায়াসে অকপটে দিচ্ছেন।
নষ্টা ভ্রষ্টা বেশ্যা রাস্তার মেয়ে এইগুলি গালি কীনা কিংবা কেন গালি হলো সেইদিকে আর যাবো না। তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার।
আমরা বরং দেখি, কোন প্রেক্ষিতে নারী পুরুষ উভয়েই একজন নারীকে এই গালিগুলি দিয়ে থাকেন।

নারীর জন্য কিছু সীমানা নির্ধারণ করা আছে। সমাজ, সংসার ধর্ম মিলে সেই সীমানা নির্ধারণ করে ক্ষেত্রবিশেষে। অর্থাৎ এটি ক্ষমতাবানের কাজ। সেই নির্ধারিত সীমানার বাইরে গেলেই নারীর জিন্য এই বিশেষণগুলো জোটে।
সীমানায় কী আছে?
নারীর আচার আচরণ, যৌনতা, চলাফেরা ও শরীর নিয়ে সমাজ প্রদত্ত কিছু নিয়ম মেনে চলা। সেই নিয়মের যে কোনদিকে কোন ব্যতয় ঘটলেই নারী পতিত হয়।
দুঃখিত, শুদ্ধ ব্যাকরণ মেনে বললে পতিতা। অর্থাৎ বারোভাতারি, বেশ্যা, নষ্টা ভ্রষ্টা কূলটা ইত্যাদি।

সালমা লুনা

সমাজ নারীকে ঠিক করে দেয় কীভাবে চলবে, কী পোশাক পরবে। শরীরের কতটুকু উন্মুক্ত করবে। ছবি তোলার সময় ঠোঁট ও চোখের ভঙ্গীটি কেমন হবে। কতটা শালীন, মানে সমাজের দৃষ্টিতে তাকে হতে হবে। সে যে পেশায়ই থাকুক তার ব্যক্তিজীবন, তার পোশাকের রুচি সবই হতে হবে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত।

এসব মনমতো না হলেই সে বেশ্যা।
নারী দুই তিনটা প্রেম করলে অথবা তার একাধারে কয়েকটা বয়ফ্রেন্ড থাকলে সে বেশ্যা।
সে দুই বিয়ে বা তিন বিয়ে করলে বেশ্যা।
সে খুন, চুরি, ডাকাতি, তহবিল তছরুপ করলেও বেশ্যা।
তার সামনে তার স্বামী তার প্রাক্তন স্বামী বা বয়ফ্রেন্ড দ্বারা খুন হলে অথবা নিজেই আত্মহত্যা করলেও সেই নারী ‘বেশ্যা’।
সে ফেসবুকে ঠোঁট কামড়ে ধরে ছবি দিলেও ‘বেশ্যা’।
ভেজা চুলে, বৃষ্টিতে ভিজে ছবি দিলেতো কথাই নাই সে নারী পৃথিবীর সকল পুরুষের নিচে শুয়ে পড়তে একপায়ে খাড়া।

ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি?
একটুও না।
আপনি যদি উপরোল্লিখিত কারণগুলির সাথে গত কয়েক বছরের ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার স্মৃতি স্মরণে আনতে পারেন, তিন্নি মিন্নি মিতু ইতু ইত্যাদি নাম মনে করতে পারেন, তাহলে দেখবেন আমার একটি কথাও মিথ্যা না।

দেশের স্বাস্থ্যখাতের নানাবিধ দুর্নীতি প্রকাশ হচ্ছে প্রতিদিন। এমন ভয়ানক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি খাত, করোনা না এলে এভাবে প্রকাশ্যে আসতো না হয়ত।
শুরু থেকেই একেবারে টপ লেভেলের লোকজনের কথা শোনা গেলেও এখন মাঝারি গোছের লোকজনের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও কান টানলে মাথা আসে টাইপ বিবেচনায় বড়দের সাথে মাঝারিরা মিলেঝুলেই সব করেছেন এবং করেন।

তবু বলা নিষেধ আছে বলে সেসব থাক।
সাবরিনা বিষয়েই কথা বলা যাক।

সাবরিনা ডাক্তার। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট এর কার্ডিয়াক সার্জারির রেজিস্টার চিকিৎসক। এবং সরকারি চাকরিবিধি অমান্য করে, প্রকাশ্য অনিয়ম সত্বেও একটি বেসরকারি হসপিটালের চেয়ারম্যান পদে আছেন। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। তবু সত্য বেরিয়ে এসেছে। তিনিই ছিলেন চেয়ারম্যান।

জেকেজি নামের সেই হসপিটাল করোনাকালে সরকারি সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। করোনার টেস্ট করার অনুমতিও পেয়েছে। সৎ পথে না থাকার বদভ্যাস যেহেতু আছে তারা সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার টাকায় করোনার টেস্ট করিয়েছে। শুধু তাই না সেই টেস্ট যদি সত্যিকারের হতো তাহলে হয়তো কিছুই হতো না। তারা ভুয়া টেস্টের অভিনয় করেছে । যার জ্বর আছে তার করোনা পজিটিভ। যার জ্বর নেই সে নেগেটিভ – এইভাবে সার্টিফিকেট দিয়েছে।

আবার তিনি চিকিৎসকদের একটি প্রভাবশালী সংগঠনের দাপুটে এক নেতার জুনিয়র বান্ধবী। ফলে সরকারি যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে নানাসময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বাগিয়ে নিয়েছে পিপিইসহ নানাবিধ সুরক্ষা সরঞ্জাম।

এসব কাজে সাবরিনার স্বামীও ছিলো সহযোগী। স্বামীটি আগে ধরা পড়লেও স্ত্রী নানান উসিলায় আইনের নাগালের বাইরে ছিলেন। এখন অবশ্য ধরা পড়েছেন।
এই পর্যন্ত সাদাসিধা প্রতারণা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে জনগণের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা হিসেবেই ছিল বিষয়টা।
যেই না দেখা গেল, সাবরিনা একজন সুন্দরী নারী। এবং সে তার সৌন্দর্য নিয়ে কনসার্ন। সে ফেসবুকে নানা ভঙ্গীমায় ছবি দিত। হামলে পড়তে দেরী হয়নি নেটিজেনদের। সাংবাদিকদেরও।

সাবরিনা তার অন্যায়ের পেছনে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে তার সৌন্দর্যকে, এমনটাই সবার বক্তব্য।

তাহলে এখন প্রশ্ন প্রায় একই সময়ে, প্রায় একই রকম অপরাধ করা অপরাধী সাহেদও কি গোপন সম্পর্কের সহায়তায় কব্জা করেছে স্বাস্থ্যখাতের অনেককেই? এবং করোনাকালে কাজ জোগাড় করে নিয়েছে সেও?

এপর্যন্ত পড়ে আমারই হাসি পাচ্ছে।
আপনাদের তো পাবেই।
তাহলে দুজন একই পথের অর্থাৎ অন্যায় করলেও দুজনের সাথে ভিন্ন আচরণ কেন!

শুধু ফেসবুক আইডি ঘেঁটে বের করে আনা নারীর ওই ছবিগুলোর জন্য?

সাবরিনা পতিতা। ঠিক আছে। পতিত তো তারাও যারা সাবরিনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সাবরিনাকে সমস্ত সরকারি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। সাবরিনা সরকারি কাজে থাকার পরও বেসরকারি হসপিটালের দায়িত্ব পালন করছে জেনেও যারা মুখ খোলেনি এতদিন তারাও পতিত। সাবরিনার সকল অনিয়ম গোপন রাখতে সাহায্য করেছে যারা তারাও পতিত।
কিন্তু কেউ তাদের পতিত ডাকছে না।

সাবরিনার মতো তাদের ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে তার নিচে কোন নারী বা পুরুষ লিখছে না, এই পুরুষটি বেশ্যা পুরুষ, এই পুরুষটি ভ্রষ্ট নষ্ট, রাস্তার পুরুষ। এর সাথে যৌনাচার করা যায় যেকোন ভাবে।
একজনও বলছে না এই পুরুষটির পরিবার থাকা সত্ত্বেও সে সাবরিনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিয়ে পতিত হয়েছে। তাকে ধর্ষণ কর, আসো সকলে মিলে এই পুরুষদের ধর্ষণ কর। এদের পশ্চাদদেশ দিয়ে সারা বাংলাদেশকে ভরে দাও।

নাহ। কেউ বলছে না।
বলবে কেন!
নারী পতিতা হলেও পুরুষ যে পতিত হয় না। নারী বেশ্যা হলেও পুরুষদের জন্য এইরকম কোন শব্দই নেই।

সাহেদ এবং সাবরিনা দুজনেরই উপযুক্ত এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। রাজনৈতিক কলাকুশলী ছাড়া এইসব পাপীদের দৌরাত্ম্য এই পর্যায়ে আসে না। কাজেই শাস্তি হোক তাদের পেছনের কলাকুশলী রাঘব বোয়ালদেরও। যেন পরবর্তীতে কেউ কোনদিন মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে এইরকম ঘৃণ্য বেসাতি, এইরূপ পাপাচার করতে না পারে।
পরিশেষে, স্বাস্থ্যখাতের সকল অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক৷ সকল অপরাধীকে ধরা হোক।

শেয়ার করুন: