মনিজা রহমান: ঐশী কেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী? এমন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম আপনাদের উদ্দেশ্যে। অনেকটা বাংলা সিনেমার সংলাপের মতো। বাবা কেন চাকর? গরীব কেন রিক্সাওয়ালা টাইপের। প্রশ্নটা নিয়ে একটু ভাবুন। শত শত খুন করেও কেউ কেউ আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যাচ্ছে! তাহলে ঐশী রহমান নামে বখে যাওয়া কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণীর জন্য কেন সাজানো হবে ফাঁসির মঞ্চ! রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের কি কোন দায়বদ্ধতা নেই ওর জন্য?
জঙ্গি সমস্যা, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, আমেরিকার ইলেকশন এসব নিয়েই তো এখন চায়ের কাপে ঝড়। ঘটনার ঘনঘটায় ঘরে-বাইরে সদাই বিপর্যস্ত থাকে বাঙালী। এতো সব সমস্যার মধ্যে আবার ঐশী কেন এলো? কিন্তু ফাঁসির মঞ্চ দিন দিন এগিয়ে আসছে যার কাছে, সে তো মনোযোগ পাবার দাবি রাখেই।
তবে যুবলীগ করার মতো বয়স পুলিশ কন্যা ঐশী রহমানের হয়নি। কারণ যুবলীগ নেতাদের গড় বয়স পঞ্চাশের ওপরে। ছাত্রলীগ সভাপতি হতেই তো বয়স চল্লিশ হয়ে যায়। ঐশী ওদের কন্যাসম। আপনি ভাবছেন, বয়স এটা কি কোন আলোচনার বিষয় হলো! কিন্তু বয়সের ধুয়া তুলে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ফাঁসির আদেশ মওকুফ হয়ে গেল যে! তাহলে? দোষ সব ঊনিশ কিংবা কুড়ি বছর বয়সী ঐশীর। তার বেলাতেই বহাল থাকে ফাঁসির আদেশ?
সে বলে না। তাকে দিয়ে বলানো হয়! বাবা-মায়ের আত্মস্বীকৃত খুনি সে। তার মৃত্যু দিয়ে আড়াল করা হয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা পাপীদের! মাদক আর ইয়াবা ব্যবসায়ীদের! ঐশী কেন খুনি? একজন কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণী কেন জীবনের রঙ, রূপ, আলো, গন্ধ সব ভুলে, আপন হাত রক্তাক্ত করে বাবা-মায়ের রক্তে! কীভাবে এটা সম্ভব? কেন এই প্রশ্ন বিজ্ঞ আদালতের কারও মাথায় আসে না?
ঐশীর ছোট ভাই, পৃথিবীতে যার একমাত্র আপনজন বলতে এই বড় বোন, সেই শিশুটির জন্য কি কারও মন গলে না! দয়ার সাগর রাষ্ট্রপতি এখন কিছুই জানেন না, কিছুই শোনেন না, কিছুই বোঝেন না। বরং সারা দুনিয়াকে বোঝানো হয় ঐশীর মতো পাপী বান্দা দুনিয়াতে আগেও আসেনি, আগামীতেও আসবে না।
ভাবছেন, আমি ঐশীকে ভালোবেসে লেখাটি লিখছি, ধারণাটা ভুল। আর সবার মতো আমি ওকে অপছন্দ করি। কিন্তু আমার এগারো বছর বয়সী ছেলে যেমন কথায় কথায় ইংরেজিতে বলে ‘আই হেইট ইট’ ‘আই হেইট দ্যাট’, আমি সেটা বলতে পারি না। ‘ঘৃণা করি’ বলি না। আমি বলি, অপছন্দ করি।
ঐশীকে অপছন্দ করার আমার একশ একটা কারণ আছে। যে বিলাসিতা-সচ্ছলতায় ও বড় হয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও ওই বয়সে পাইনি। পুরান ঢাকা থেকে বাংলামটরে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, শাহবাগে কণ্ঠশীলনে যেতাম বাসে-টেম্পুতে চড়ে। তাও আবার নিজের টিউশনির টাকায়। নতুন বই কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে লাইব্রেরির সদস্য হতাম, কিংবা বাংলা বাজারের ফুটপাত থেকে পুরনো বই কিনতাম। মাগরেবের আজান দেয়া পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকার যেটুকু স্বাধীনতা পেতাম তার অপব্যবহার করতাম না!
ঠিক আছে, আমার ছেলের মতো আমিও বললাম ‘আই হেইট ঐশী’। যখন পত্রিকার পাতায় ওর হাতে বাবা-মায়ের মৃত্যুর বিস্তারিত বর্ণনা পড়েছি, তখন ওর প্রতি ঘৃণায়, বিবমিষায় জর্জরিত হয়েছি। একইভাবে ছি: ছি: করেছি ওর বখে যাওয়া উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কথা জেনে। কিন্তু একটু পরে যখন দেখলাম হত্যার পরদিন সিএনজিতে চড়ে সারাদিন উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরেছে ঐশী ওর ছোট ভাই আর কাজের মেয়েকে নিয়ে, ওই সিএনজি ড্রাইভারের বাসায় রাতে থেকেছে, খুব খুব অবাক হয়েছি। ঐশীর উদ্দেশ্যবিহীন আচরণ বলে দেয় মানসিকভাবে কতোটা অস্থির ছিল সে। কতখানি গলদ ছিল তার পরিকল্পনায়!
ঘৃণা? হ্যাঁ ঘৃণা! ‘একজন মাদক আক্রান্ত তরুণ-তরুণী সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে তার বাবা-মাকে।’ মাদক থেকে নিরাময় হয়ে আসা এক নারীর জবানবন্দীতে কথাটা পড়লাম সেদিন। ঐশীর ঘুষখোর পুলিশ অফিসার বাবা আর মায়ের অঢেল টাকা খরচ করার জায়গা ছিল না। তাই ওইটুকুন মেয়ের মাসের হাতখরচ হিসেবে তারা দিত পঞ্চাশ হাজার টাকা। মেয়ে সেই টাকায় বন্ধুদের নিয়ে উদ্দাম জীবনে মত্ত হয়। মদ, ইয়াবা, ডিসকো, বন্ধুদের নিয়ে বেলেল্লাপনা- ওইটুকু বয়সে কোনকিছু বাদ দেয়নি সে। ওদিকে পড়াশুনায় ধস নামে। দেরিতে হলেও যেটা দৃষ্টিগোচর হয় ওর দরদী পিতামাতার। যখন তারা হাতখরচ কমিয়ে দিয়ে, কন্যাকে গৃহবন্দী করতে চায়, তখনই তাদের প্রতি জারি হয় মৃত্যু পরোয়ানা।
অবক্ষয়ী এক সমাজের চিত্র এটি। বাংলাদেশে মাদক কেনা-বেচা এখন একটি উন্মুক্ত বিষয়। যে কেউ শিশু-কিশোর, বালক-বালিকা, বুড়ো-খোকা চাইলেই সেটা কিনতে পারে, এজন্য কারো কোন নজরদারি নেই। মাদক গ্রহণ যে একজন মানুষের সমস্ত সুকুমারবৃত্তিকে শোষণ করে, তার মধ্যে জন্ম দেয় কেবল প্রতিহিংসার, এটা সমাজের নীতি নির্ধারকরা কেউ বোঝে না। মনে হয় তারাও যেন অচেনা কোনো মাদকের নেশায় বুদঁ হয়ে আছে। হঠাৎ করে তাদের ঘুম ভাঙ্গে। আর তাতেই স্বাক্ষরিত হয় ঐশী বা তার মতো কারও মৃত্যুদণ্ড।
কেউ কী মনে করেন, ঐশীর ফাঁসি একটা বিরাট দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপিত হবে? বখে যাওয়া ছেলেমেয়েদের রাতারাতি ফিরিয়ে আনবে সুস্থ জীবনের স্রোতে! সেটা ভাবলে সে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বরং ঐশীকে যদি সংশোধনের সুযোগ দিয়ে নতুন মানুষ হিসেবে জন্ম দেয়া যায়, তবে সেটাই হয়তো হবে কোনো দৃষ্টান্ত। হত্যাকাণ্ডের সময় ঐশীর বয়স, তার শারীরিক-মানসিক অবস্থাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

‘আত্মরক্ষার জন্য, অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়, নাবালক/নাবালিকা বয়সে- যে অপরাধ করে, তাকে খুনের জন্য দায়ী করে ফাঁসি দেয়া যায় না।’ –এই অভিমত মানবাধিকার কর্মী ও লেখক মিনহাজ আহমেদের। নিউইয়র্কে বসবাসরত এই মানুষটি জানালেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছে ঐশীর ঘটনাটি তুলে ধরবেন।
তিনি আরো বলেন, ‘নিজের সন্তানকেও কেউ যদি গৃহবন্দী করে রাখে, আদালতে যদি তা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটা জবরদস্তিমূলক আটক হিসেবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মাদকের উইথড্রয়াল এ্যাফেক্ট মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে মানুষের ওপর। অনেক কিছু বিবেচনা করেই আধুনিক শাস্তি ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধনমূলক, প্রতিশোধমূলক নয়।’ মিনহাজ আহমেদ শেষে বললেন, ঐশীর জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা আছে তাঁর নিউইয়র্কে।
বাবা-মাকে নিজের হাতে হত্যা করার সময় ঐশী মানসিকভাবে সুস্থ ছিল কিনা সেটা কি আদৌ প্রমাণিত হয়েছে? তাছাড়া ওর বয়স নিয়ে একটা ধুম্রজাল আছে। কারা ঐশীকে ঘুমের ওষুধ সরবরাহ করলো? একা একটি মেয়ের পক্ষে কি দুইজন মধ্যবয়সী, সুস্থ, সবল মানুষকে হত্যা সম্ভব? এরকম অনেক বিষয়ই অজানা।
ঐশী আদালতে বলেছে, বা বলানো হয়েছে যে সেই হত্যাকারী, তাহলে অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু সেই শাস্তি কি মৃত্যুদণ্ড? বয়সের কারণে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী, ১৯৭১ সালে ঘাতক-দালালদের নেতা গোলাম আযম যদি বিচারকদের ক্ষমা পান, ফাঁসির দড়ি এড়াতে সক্ষম হন, তাহলে ঐশীর জন্য এতটুকু করুণা কি কারও হবে না!
বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি চাইলে সেটা পারেন। কারণ ঐশী নিশ্চয়ই যুবলীগ নেতা আসলাম ফকিরের চেয়ে বেশী অপরাধী নন!
ফরিদপুরের যে যুবলীগ নেতার ফাঁসির দড়ি সরিয়ে নেয়া হয় একদিন আগে। তার জন্য ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। রেওয়াজ অনুযায়ী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে উপস্থিত থাকতে বলেছিল কারা কর্তৃপক্ষ। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের একদিন আগে স্থগিত করা হয় খুনের আসামী আসলাম ফকিরের ফাঁসি। তার পরিবর্তে ১৪ বছর কারাদণ্ড দেন রাষ্ট্রপতি।
লক্ষ্মীপুরের এইচ এম বিপ্লবের চেয়ে কি বেশি ভয়ংকর এই ঐশী? ফাঁসির দণ্ড থেকে মাফ পাওয়ার পরে একের পর এক বিশেষ সুবিধা পেয়ে চলেছে ‘তাহেরপুত্র’ নামে পরিচিত এই সন্ত্রাসী, নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার প্রধান আসামী। যার কারণে নুরুল ইসলামের পরিবার, তার বংশের সব লোকজন এখন ভিটেমাটি ছাড়া। রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় একটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ড থেকে রেহাই ও দুটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা আংশিক মওকুফ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে একটি হত্যা মামলা থেকে নাম প্রত্যাহারের পর এবার বিপ্লবের আরও এক বছর ছয় মাস চার দিন সাজা মাফ করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। বাকি সাজা মাফ করতেও চলছে তোড়জোড়।
ক্ষমার পর ক্ষমায় যখন ভেসে যাচ্ছে চারদিক, ১৪ বছর ধরে কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী ইয়াসিন খানের কন্যার বয়স যখন ‘চার বছর’, শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফের যখন মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন পায়, সাত খুনের আসামী তারেক সাঈদ হাসপাতালে কেবিনে ঘর সংসার পেতে থাকতে পারে, তখন ঐশী কেন পাবে না একটু করুণা ভিক্ষা?
৪ আগস্ট, ২০১৬, নিউইয়র্ক
(ঝর্ণার জলের কারাগার)
ami lekhoker sathe ekmot
Amaro mone hoy honourable judge should consider Oishi’s age, drug effect and give her aquital instead of capital punishment. The duties and responsibilities of Oishi’s parents, surrounded society also need to consider. … She should get ‘rectifying verdict from court which would open eyes of thousands of families in our society.
ঐশী রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার যেমন হাজারটা কারণ থাকতে পারে। তেমনি ঐশী বিপথে যাওয়ার হাজারটা কারণও আমি দেখাতে পারি এই সমাজকে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই রায়ের বিপক্ষে। তাকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হোক।
আপনাকে ধন্যবাদ।