কান নিয়ে গেছে চিলে, চলো দৌড়াই

ফেলু মিত্তির: আমার এক বন্ধু আমাকে তাদের গ্রামের একটি গল্প প্রায় বলেন।গল্পটা এরকম, সিরাজগঞ্জে তাদের গ্রামে হাটবারে একদিন তারা কয়েক বন্ধু মিলে ঘুরতে গেছেন।তারা দোকানে বসে চা খাচ্ছেন, এমন সময় একটি লোক দৌড়াতে দৌড়াতে দোকানে ঢুকে চিৎকার করে বলতে লাগলো যে তাদের গ্রামের কেউ একজনকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের আরেকজন মেরেছে। এই কথা শোনামাত্রই দোকানে বসা একলোক হাতে থাকা একটি খালি বোতল দিয়ে রাস্তায় বসে থাকা এক দোকানিকে বেদম প্রহার শুরু করলেন। হতভম্ব সবাই, আমার বন্ধু উঠে গিয়ে বোতল হাতে থাকা লোকটিকে থামানোর চেষ্টা করলেন। তাকে বললেন, আপনি ওকে মারছেন কেন? লোকটি উত্তর দিল, ওর গ্রামের লোক আমার গ্রামের লোককে মারছে। আমার বন্ধু বললেন, আপনি তো দেখেন নাই, হাতে প্রমাণও নাই, খামাখা লোকের কথার ভিত্তিতে আপনি ওকে এভাবে মারতে পারেন না। লোকটি উত্তর দিল, আরে ভাই, থামেন তো, আগে ‘বাইড়াইনি’, তারপরে অন্যকথা।

Hindu_thereport24
সংগৃহীত

গত ১০ ই এপ্রিল ‘কুমিল্লার বার্তা’ নামক একটি ওয়েবসাইট এ (http://www.comillarbarta.com/2016/04/মহানবী-সাঃ-কে-কটুক্তি-উত্/) “মহানবী (সাঃ) কে কটুক্তি; উত্তাল মনোহরগঞ্জ, শিক্ষিকা আটক” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স নামে একটি গ্রুপ এই খবরটি ফেসবুক এ শেয়ার করার মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদে সবাইকে সামিল হবার আহ্বান জানায়, এবং আমার এক বন্ধু এতে সামিল হয়। এই সামিল হওয়াটা আমার কাছে চিলে কান নেবার মতোই মনে হল। এবং এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে আসা শত শত মানুষের কানও যে ঐ চিল নিয়ে গিয়েছে তা প্রকাশিত ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চিলটা এতগুলি কান নিলো কিভাবে?

এরকম খবর এখন প্রায়ই পত্র-পত্রিকাতে আসে, এবং বোধকরি আসার মাত্রাটাও বেড়ে গেছে। পত্রিকাতে আসে ‘কটূক্তি’, কিন্তু উক্তিটা কী সেটা আসে না। কিন্তু খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই মানুষজন জুতা, লাঠি, দা- কুড়াল, হাতের কাছে যে যা পাবে, তাই নিয়ে চলে আসে বিক্ষোভ জানাতে, তথাকথিত ‘অপরাধীর’ শাস্তি দিতে।

বেশীরভাগ সময়েই এই বিচার করা হয় (একটি গণতান্ত্রিক দেশে) অগণতান্ত্রিক পর্যায়ে, জনতার গণধোলাইয়ের মাধ্যমে, যেখানে থাকে না কোন আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ। প্রশাসন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখে, এবং এর প্রমাণ উল্লেখিত ওয়েবসাইট এর ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যাবে।।

এতে বোধকরি, ‘কটুক্তি’ যিনি করেন, তার প্রশাসনিক এবং জনতার শাস্তি দুটোই হয়। উপরোক্ত খবর এর ‘নায়ক’ হলেন একজন নারী শিক্ষক, তাই জনজীবনে উৎসাহের মাত্রাটাও বেশী। উনি যেদিন ‘কটুক্তি’ করেছেন, তার একদিন পরে খবরটি জানা-জানি হয়, মানে খবর এর validity, weight, transparency, credibility, and authenticity নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন থাকে। কিন্তু, ঐ যে, চিলে কান নিয়ে গেছে, চল দৌড়াই চিলকে মারার জন্য।

খবরে জানা যায় যে, উনি একজন বাংলার শিক্ষক এবং সপ্তম শ্রেণীতে পাঠদানকালে উনি ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে ‘এরকম’ ‘কটুক্তিমূলক’ মন্তব্য করেন। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রদের প্রতিবাদের বিকাশ তখনও হয়ে উঠেনি, শিক্ষক কোন ভাবে, কী কারণে, কী মন্তব্য করেছেন, সেটা ছাত্ররা তখন কিছুতেই বুঝতে পারেনি, কিন্তু বুঝেছে এর একদিন পরে।

আগেই বলেছি, এই কালক্ষেপণের কারণে এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ের  credibility অনেকটুকুই নষ্ট হয়; কিন্তু সবচেয়ে মজার কথা হলো, উনি হিন্দু (তাই এর গ্রহণযোগ্যতা আজীবন থাকবেই)।

ব্যস, আর যায় কোথায়; একে তো শাড়ি, তারপর আবার শাঁখা-সিঁদুর। সোনায় সোহাগা। তামাশা দেখার মতো লোকের কমতি যে হবে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে, জনতা, সবার ভিতর একটি উত্তেজনা। এবং যারা আগে থেকেই তক্কেতক্কে ছিলেন, তাদের জন্য তো আরও সুখবর, এইবার একটা সুযোগ আসছে, এই ‘মালাউন’ এর সমস্ত ভিটে-বাড়ী, সম্পত্তি দখল করার, সবার সামনে হেনস্থা করার, এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য করবার।

আর জনতার গঠনটাও চোখে পড়ার মতো, কত যে ছোট ছোট ছেলে আর ভদ্র মানুষ এর লেবাস পরিহিত জনেরা জনতার মিছিলে সামিল হয়েছেন- সেটা রীতিমত ভয়ানক। আমরা আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কী শিক্ষা দিচ্ছি? কীভাবেই না তাদেরকে আমরা উস্কে দিচ্ছি!

আমার এ হেন মন্তব্যর কারণ আছে। আমাদের দেশে বিশ্বজিৎরা বারবার মরে, মন্দির এ ভাংচুর বার বার হয়ে থাকে, গ্রামের পর গ্রাম থেকে আদিবাসি, হিন্দু, সংখ্যালঘু উচ্ছেদ চলতেই থাকে, হিন্দু মেয়ে, ছেলে শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতিত হতেই থাকে, বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল এ ইসলাম ব্যতিত অন্য ধর্ম  সম্পর্কে কুৎসা রটতেই থাকে, ইসলামের অপব্যাখ্যা চলতেই থাকে, মানুষকে প্রবঞ্চনার প্রয়াস চলতেই থাকে, এমনকি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক, অপমানকর বাণী প্রচারিত হতেই থাকে- কিন্তু কখনই কাউকে দেখা যায় না জুতা, লাঠি, ছুরি, দা-কুড়াল হাতে নিয়ে এর প্রতিবাদ করতে (যদিও সভ্য সমাজে প্রতিবাদের ভাষা এরকম হওয়া উচিৎ নয়), প্রশাসন তো তখন থাকেই না, আর থাকলেও মিডিয়াতে কী ভাষণ দিবে সেটা ঠিক করা নিয়েই উদ্বিগ্ন থাকে।

কোন তথাকথিত ‘কটুক্তি’ করার থেকে এ সমস্ত কাজ অনেক নিকৃষ্ট, এবং অমানবিক, এবং তা সাম্প্রদায়িকতাকেই আস্কারা দেয়। এসবের কোন বিচার তো দূরে থাক, এসব নিয়ে কোন কথাই ক্ষতিগ্রস্তরা বলতে পারে না। তাদের সামনে দুটি রাস্তা খোলা থাকে- জোর করে ধর্মান্তরিত হওয়া, কিংবা দেশ ত্যাগ করা।

আমেরিকাতে এক লোক কোরআন শরীফ এ আগুন দেবার প্রতিবাদে বাংলাদেশে আমেরিকার পতাকা এবং সেই লোকের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়; কিন্তু হেফাজতে ইসলাম যখন মসজিদে আগুন দেয়, এবং কোরআন শরীফ পোড়ায়, তখন কিন্তু কোন পতাকাতে আগুন দেয়া হয় না, কোন কুশপুত্তলিকা পোড়ানোও হয় না, কেউ লাঠি, জুতা, দা-কুড়াল হাতে প্রতিবাদ করে না, এবং প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয় না।

কিন্তু এই যে, শোর উঠেছে একজন হিন্দু নারী ‘কটুক্তি’ করেছেন, সেটাই হলো বড় কথা, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হেনেছেন, এবং তাই তার বিচার হতে হবে। দোষ করলে বিচার তো হতেই হবে, কিন্তু তা প্রশাসনিক ভাবে, আদালতে।

আমাদের দেশে যারা ওয়াজ মাহফিল এ বক্তৃতা দেন, তাদের মতো ভণ্ড মানুষ বোধহয় খুব কমই আছে (এদের ভিতর কিছু ভালো মানুষ নিশ্চয় আছে), কিন্তু তাদের নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই। এরা যে সাধারণ মানুষের সাথে বেইমানী করে, ধর্মের আদলে অধর্মের বাণী শোনায়, সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়, এ ব্যাপারে সবাই উদাসীন। এদের কোন কর্মকাণ্ড কখনও ধর্মবিকৃতির আওতায় পড়ে না। এরা যখন ঠিক পরীক্ষার আগে জোরে জোরে মাইক বাজিয়ে সারা রাত পরীক্ষার্থীদেরকে বিরক্ত করে, তখন কেউ এদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না।

আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে বাসা বেঁধেছে তা যদি আমরা এখন না বুঝি, এবং তা নির্মূলে ব্যবস্থা না নেই, তাহলে তো সমূহ বিপদ। লোক দেখানো রাজাকার আর আলবদরদের শাস্তি ভণ্ডামি বৈ আর কিছু হবে না। জামাত কখনো যদি সরকার গঠন করতো, তবে তার চিত্র কিরকম হতো সেটা এই তথাকথিত ‘আওয়ামী লীগ’ সরকারই দেখিয়ে দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটিই ধর্ম আছে, মানুষকে নিরাপদে রাখা ও তাদের অধিকার সংক্রক্ষণ করা; এ ছাড়া আর কোন ধর্ম কোন পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট কখনো বলবে কিনা সন্দেহ।

কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের ধর্ম হলো ‘ইসলাম’। ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি এবং ফায়দা লুটার সুযোগটাও এর মধ্য দিয়ে আর একটু জোর পেলো। সংখ্যালঘু যারা আছে না কেন, তাদের সম্পর্কে কোন ক্ষোভ থাকলে শুধু বলুন, উনি কটূক্তি করেছে, বা ব্যঙ্গ করেছে, ব্যস তারপর বসে বসে খেলা দেখবেন।

এটা আমি বানিয়ে বলছি না, এরকম হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। এ লেখার কারণে কাল আদালত সমন পাঠাতে পারেন, বলতে পারেন আমি ধর্মীয় উস্কানিমুলক কথা বার্তা লিখছি, তাতে কিছু যায় আসে না; আমার এই বাংলা ক্ষুদিরাম এর বাংলা, আমার বাংলা সূর্যসেন এর বাংলা, শেখ মুজিব এর বাংলা, এবং এই বাংলাতে সাম্প্রদায়িকতার কোন সুযোগ নেই। সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ করা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার, ভণ্ড সেজে বেঁচে থাকতে পারবো না।

 

শেয়ার করুন: