পর্নোসাইট বন্ধের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই

শাশ্বতী বিপ্লব: এখনকার অবস্থা জানি না, তবে একসময় স্কুল-কলেজের টয়লেটের দেয়ালে শোভা পেতো হাতে আঁকা অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি ও সুড়সুড়ি মার্কা লেখা। কালের বিবর্তনে টয়লেটের সেই দেয়াল এখন উঠে এসেছে অনলাইনে, বিশেষ করে ফেসবুকের দেয়ালে।

কারো কিছু অপছন্দ হলেই কিছু বিকৃতকাম মানুষ সেই মানুষটির ফেসবুকের দেয়ালে বা কোন কোন অনলাইন পত্রিকার দেয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাকে টয়লেটের দেয়াল বানিয়ে ছাড়ে। সে হোক কোন বিখ্যাত লেখক বা তারকার প্রথম বা দ্বিতীয় বিবাহ বা কোন ক্রিকেটারের তার বোনের সাথে ছবি বা কারো নিজের ফিল্মি ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত। কেবল বিখ্যাত বা মিডিয়ার মানুষ নয়, ছাড় পায় না অখ্যাতরাও। কেউ একটু নারীবাদী কথা লিখলো, বা কারো রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধিতা করলো বা নিছক মজা করেই কিছু লিখলো বা নিজের সেল্ফিটাই দিলো, ব্যস অমনি নোংরা অশ্লীল খিস্তির ঝাঁপি খুলে বসে কিছু মানুষ।

কানাডায় চাকরিসহ অভিবাসনে সাহায্য করে এমন একটি স্পন্সরড বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে সেদিন সত্যি বাকহারা হয়ে গেলাম। একটি মেয়ে তার শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ লিখেছে সে কাজ নিয়ে যেতে ইচ্ছুক, তাকে কি করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ চায়। তাতেও একদল মর্ষকামীর কোথায় লাগলো কে জানে, দেয়ালটা মূহূর্তেই ভরে গেল দুর্গন্ধে আর আদিরসাত্মক চিৎকারে।

Shaswati 5
শাশ্বতী বিপ্লব

এমনকি এই আক্রমণ থেকে মুক্ত নন আমাদের বর্তমান বা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীরাও। কয়েকমাস আগে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, ড. ওয়াজেদের সাথে সদ্য বিবাহিত শেখ হাসিনার বিয়ের একটি ছবিতে কিছু মানুষের কুৎসিততম বিকৃত মন্তব্য! কেউ শেখ হাসিনাকে পছন্দ নাই করতে পারে, কিন্তু একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে লেখা মন্তব্যগুলো আমাকে সেই টয়লেটের কথাই মনে করিয়ে দিলো। আমাদের বাহ্যিক চেহারা যাই হোক, অন্তরে আমরা এখনো টয়লেটবাসী। একই কথা খাটে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও। শুধুমাত্র নারী বলে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে কতো বিকৃতভাবেই না উপস্থাপন করা হয়, রগরগে কাহিনী বানানো হয় তাঁকে নিয়ে। ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধও নেই নারীর প্রতি।

একদিকে অতি অবদমনের চাপ আর অন্যদিকে নির্বিচারে বিকৃত পর্নোপ্রাফি দেখতে পাওয়ার লাগামহীন সুযোগ – একইসাথে এই দুই উল্টোস্রোত ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের অনেক মূল্যবোধ। বিভ্রান্ত আমাদের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা অনেকেই, যার কুফল আমরা প্রতিদিনই ভোগ করছি।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইবার ক্যাফে, হাতে হাতে স্মার্টফোন, মোবাইল কোম্পানিগুলোর রাত বারোটা থেকে ন্যুনতম দামে বিশেষ প্যাকেজ – এগুলোর সমন্বয়ে পর্নোগ্রাফিসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ জগৎ পৌঁছে যাচ্ছে অভিভাবকের চোখ এড়িয়ে আমাদের সন্তানদের হাতের মুঠোয়। পৌঁছে যাচ্ছে বাস-ট্রাক ড্রাইভার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অবধি। বাড়ছে বিকৃতি, বাড়ছে অস্থিরতা। সেইসাথে বাড়ছে অপরাধ, অপরাধ প্রবণতা। একটা জরিপ চালালে দেখা যাবে, প্রায় প্রতিটি ঘরই আজ এই দোষে দুষ্ট। প্রতিটি অভিভাবক চিন্তিত, অস্থির সময় পার করছেন উঠতি সন্তানদের নিয়ে।

সেভ দ্য চিলড্রেনে কাজ করার সময় ইংলিশ মিডিয়াম একটি স্কুলের ক্লাস সেভেন/ এইটের ছাত্রছাত্রীদের কাণ্ডকারখানা শুনে আমরা কয়েকজন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। দুজন সহপাঠী নিজেদের শারীরিক সম্পর্ক নিজেরাই ভিডিও করে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছে নিছক মজা হিসেবে। কেমন উদ্ভটরকম পাল্টে গেছে, যাচ্ছে আমাদের সন্তানদের মজার সংজ্ঞা!

এসব থেকে মুক্তি পেতে করার আছে অনেক কিছু, তবে বাংলাদেশে সকল পর্নোসাইট বন্ধ করে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত সম্প্রতি নেয়া হয়েছে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সিদ্ধান্ত। তবে এ যেন শুধু ঘোষণাতেই শেষ হয়ে না যায়, বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। বিশেষ করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে, তাতে করে প্রতিমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হবে কীনা, কিছুটা সন্দেহ থেকেই যায়। তারপরও আশা রাখি। যদিও জানি এটাই একমাত্র সমাধান নয়, সরকার একাও করতে পারবে না সবটা, করার আছে আমাদেরও।

যারা এই সিদ্ধান্তের সাথে অমুক স্বাধীনতা, তমুক অধিকার ইত্যাদির সংঘর্ষ দেখতে পাবেন, তাদের বলছি, দূরে গিয়া মরেন। আপনাদের ওইসব তাত্ত্বিক স্বাধীনতার জন্য আমার সন্তান এখনো তৈরি নয়, তৈরি নয় আমার সমাজ – একজন অভিভাবক ও সামাজিক প্রাণী হিসেবে আমি এই সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করি ও সাধুবাদ জানাই। আর হ্যাঁ, শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে আসুন আমরা নিজেদের কর্তব্যটাও সঠিকভাবে পালন করি।

 

শেয়ার করুন: