লীনা হাসিনা হক: এই মায়ার পৃথিবীর জীবন ভারী অদ্ভুত। থেমে থাকে না। চলছে। বাংলাদেশের সোহাগী তনুরা প্রশাসনের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে, তনুর বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে খুন হয়ে যাওয়া তনুকে বার বার ধর্ষণ করা হচ্ছে, প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, বিচার চাওয়া হচ্ছে, খবরের কাগজে, টেলিভিশনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সব পড়ছি, তনুর পরিবারের মনের মধ্যে কী হচ্ছে সেকথা ভেবে শিউরে উঠছি এবং তার পর মুহূর্তেই ‘আচ্ছা আমার মেয়েতো নিরাপদ আছে’ ভেবে নিজের উটপাখির জীবনে ফিরে যাচ্ছি।
এইতো আমি! বাংলাদেশের খৎনা হয়ে গেলো সেই উপলক্ষে জশনে জুলুশ হচ্ছে, অ-মুসলমানদের এই দেশে আর থাকার দরকার কি, কাজেই তাদেরকে মাইকে আওভান জানিয়ে তাড়ানো হচ্ছে।
চলছে সবকিছুই- নিয়মমতো, কী নিয়মের বাইরে, তা দিয়ে দরকার কী, চলছে তো। থেমে তো নাই। অ-মুসলিম বন্ধুদেরকে ফোন করে ঠিক আছে কিনা জানতে চাই, দরকারে যেনো জানায় এই বলে আবার মুখ গুঁজে ফেরত আসি আমার উটপাখির জীবনে।
আমার মতন অতি সাধারণ, প্রায় না-মানুষী জীবন যাপনকারী একজনের জীবনে কী হলো তা দিয়ে এই জগতের কিছু এসে যায় না। তবু জানাতে এসেছি, এই মানুষরুপী উটপাখি আমার জীবন গত কয়েকদিন ধরে থেমে না গেলেও প্রায় থমকে আছে। আমার ভেতরের উটপাখিটি তার পাখায় লুকোনো চোখে কিছুই দেখছে না আর!
আমার ঊনিশ বছরের কন্যার কান্নাসিক্ত গলা শুনি টেলিফোনের অপর প্রান্তে, ‘মা, কেন বাংলাদেশ এমন? কেনো মেয়েদেরকে ভালোবাসে না বাংলাদেশের লোকেরা? কেন এতো সেক্সিস্ট এটিচ্যুড, এমনকি রাষ্ট্রেরও?’ আমি জানতে চাই, কী হয়েছে তার? সে জোরে কেঁদে ওঠে, ‘মা, কেন মেয়েরা এতো অনিরাপদ বাংলাদেশে? রাস্তায়, ঘাটে, হাটে-বাজারে, স্কুলে-কলেজে, বাড়িতে, নিরাপদ (!!) ক্যান্টনমেন্টে, পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে? কেন মেয়েরা নিরাপদ নয় ভোরের আলোয়, দুপুরের রৌদ্রে কিংবা সন্ধ্যার আঁধারে?’
উত্তর দিতে পারি না পনেরো হাজার কিলোমিটার দূরত্বে থাকা কন্যার প্রশ্নের, সান্তনাও দিতে পারি না, চুপ করে থাকি। মেয়ে বলে চলে, গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের সোহাগী তনু হত্যা নিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা হচ্ছে। মেয়েটি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বাংলাদেশী আন্ডার গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী। তার সহপাঠীরা, হোস্টেলের বন্ধুরা, এমনকি তার দু’একজন শিক্ষকও তার কাছে জানতে চায়, পড়া শেষ করে সে কি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে যাবে কিনা? বাংলাদেশ কি তার জন্য নিরাপদ কিনা!
মেয়েটি এখনো দেশের জন্য মায়া ধরে রেখেছে তার প্রাণে, সে ফিরে আসতে চায়। তার বন্ধু কীর্তি, জাম্বিয়ার নাগরিক। কীর্তি বলেছে, জাম্বিয়া গরীব, তবু সে পড়া শেষ করে ফেরত যাবে নিজের দেশে। নিজের দেশের জন্য কিছু করতে চায় সে।
কীর্তির ভাষায়, “জাম্বিয়া ইজ পুওর, বাট নট সেক্সিস্ট, মাই কান্ট্রি ইজ জাস্ট পুওর, বাট আই উইল নট বি রেপড এন্ড কিল্ড বাই দি কান্ট্রি। বাট বাংলাদেশ পারহ্যাপস ডাজ নট ওয়ান্ট ইউ অর এনি অফ ইটস গার্লস, সো মে বি ইট ইজ আনসেইফ ফর ইউ টু রিটার্ন ব্যাক হোম ফর এভার!”
আমি টেলিফোনের এই প্রান্তে চুপ করে মেয়ের হাহাকার শুনি! আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, ‘বাংলাদেশ ইজ এ সেক্সিস্ট কান্ট্রি! বাংলাদেশ ধর্ষক রাষ্ট্র! ধর্ষক! ধর্ষক! বাংলাদেশ ডাজ নট লাভ ইটস গার্লস। বাংলাদেশ ইজ নট সেইফ ফর ইটস ডটার্স!’
ভাঙতে পারবো কি এ খাঁচা?