‘স্টে উইথ ডিগনিটি’

ইশরাত জাহান ঊর্মি: ইন্টারভিউ শেষ করে আমার কি হয় হঠাৎ আমি খুব স্ট্রংলি ঘুরে তাকাই সুলতানা কামাল আপার দিকে। খাস বাংলায় বলি, ঠ্যাকায়া কিন্তু আপা রাখতে পারবে না কেউ। সুলতানা আপা জারুল বেগুনী রং শাড়ী পরা, পিসিতে কাজ করতে করতে মুখ না তুলেই বলেন, তা তো পারবেই না। পারবে না বলেই এতো খুনোখুনি। পারলে তো আর খুনোখুনির দরকার পড়তো না।

Urmiসুলতানা কামাল বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আর আমি সামান্য অখ্যাত সাংবাদিক, আমরা কেউ কারো দিকে না তাকিয়েও যেন বুঝতে পারি, আমাদের লড়াই কোথাও না কোথাও একই রকমের।আমাদের কষ্টগুলোও কোথাও নিশ্চয়ই এক।

এবার নারী দিবসে মুন্নী সাহা দারুণ আইডিয়া দিলেন। দিদি বললেন, শোন, কোন বাংলাদেশী নারী এভারেস্ট জয় করছে, কে পুলিশের সর্বোচ্চ পদে গেছে, কে শান্তিরক্ষা মিশনের হেড হইছে, এগুলা তো ভালোই। এ অর্জনের কথা প্রতিদিন বলা হচ্ছে।

তুই এবার যে মেয়েটা প্রত্যেকদিন পুরুষের সাথে চাপাচাপি করেই বাসে ওঠে, যে জোহরা সারাদিন গার্মেন্টস এ কাজ করে এসে আবার ভাত রাঁধে স্বামীর জন্য হাসিমুখে, যে প্রেগন্যান্ট মেয়েটি এতোবড় পেট নিয়েও অফিসের টাইম ঠিক রাখে, তাদের কথা নিয়ে স্টোরি কর।

এত্তো ভালো লাগলো আইডিয়াটা।

কদিন আগে ফেসবুকে দেখা একটা ছবির কথা মনে পড়লো। একটা মেয়ের পায়ের সাথে অনেকগুলো পাথর বাঁধা। একটা পাথর সামাজিকতা, একটা সংসার, একটা হয়তো বাবা-মায়ের দায়িত্ব একটা সন্তানের। এবং এইসব পাথরসহ তাকে একটা উঁচু প্রফেশনাল জায়গায় যেতে বলা হচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি।

যায় কিন্তু। মেয়েরা এইসব পাথরসহই পুরুষের পাশাপাশি হাঁটে। মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে প্রমাণ করে সে কারো থেকে কম না আবার ঘরে এসে ঠিকঠাক পাঁচফোড়ন দিয়ে নিরামিষ রাঁধে অথবা গরুর মাংসের কাবাব। মেয়েরা পারে। মেয়েরা আস্থা রাখে নিজের ক্ষমতায়।

মেয়েদের পক্ষে রাষ্ট্রের বানানো আইনকানুন নিশ্চয়ই অনেক হয়েছে, কিন্তু এসবে আসলে খুব কি কিছু এসেছে-গেছে? কাজ হয়েছে মেয়েদের নীরব শক্তিতে, দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পে।

পুরুষ জিদে বাদশা আর নারী জিদে বেশ্যা…এই প্রবচন শুনেও মেয়েরা উড়িয়ে-ঘুরিয়ে দিয়ে এগিয়েই গেছে। সমাজ কখনও তাকে বাহবা দিয়েছে, কখনও বেশ্যাও ডেকেছে, সে পরোয়া করেনি।

আমি বারবার বলি, নারীর প্রতিবন্ধকতার ধরন বদলেছে। এখন আর কেউ নারীকে বলবে না তুমি কাজ করো না, চাকরি ছাড়ো। কিন্তু তার বেতনটা কী হবে সেই সিদ্ধান্ত অনেকসময়ই সঙ্গী পুরুষ চাপিয়ে দিয়েছে। তাও যদি না পেরেছে তো সংসার কেন ঠিকঠাক চলছে না তা নিয়ে গাল ফুলিয়েছে। বউকে গৃহস্থালী কাজে সাহায্য করে বন্ধুদের আড্ডায় ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। যেন এই সাহায্য করাটা নারীকে বিরাট দয়া করে ফেলা হলো। নারীকে এই রিলিফ দেয়াটা যেন বিরাট ঔদার্য্যের কাজ।

না বন্ধুরা, ভাবনাটা একটু পাল্টান। হাতে হাত লাগান কাজে। নিজের চা নিজে বানিয়ে খেয়ে এমন কোন মহাভারত উদ্ধার করেননি, পারলে নিজের চায়ের সাথে সাথে বউ এর টাও বানিয়ে দেন। এতে আপনার সম্মান বাড়বে, কমবে না।

এখানে যুক্তি-তক্কোর কিছু নেই, এটা হলো হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া। এই একসাথে এগিয়ে যাওয়াটা শেখেন প্লিজ, আস্থা রাখেন, ঠকবেন না।

প্রতিবন্ধকতার কত ধরন হয়! আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন থেকেই শুনছি, স্টুডেন্ট তো, তাই এতো উড়েঘুরে বেড়াতে পারো, সংসার করো, চাকরি করো, বুঝবা।

আমি সংসার এবং চাকরি করেই উড়েঘুরে বেরিয়েছি।

এরপর শুনলাম, হোক একটা বাচ্চা, বুঝবা।

আমি মা হয়েছি, কী বুঝতে বলে সবাই আমার মাথায় ঢোকে না। যেসব প্রতিবন্ধকতা আগেও ছিল সেসব তো থাকবেই, সেইসবকে পায়ে দলেই তো এগিয়ে যেতে শিখেছি। তাহলে নতুন করে কী বুঝবো?

অফিসে ফিটফাট হয়ে যাই, বসন্ত উৎসবে যাই, বর্ষবরণ করি, ননদ দেবরের বিয়েতে নাচ-গান করি, বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডা দিই, বরের সাথে হাতে হাত রেখে সংসার করি, এতেও অনেকের চোখ টাটায়। বুঝবা, বুঝবা!

এই চোখ ঠেরে “বুঝবা বুঝবা” বলার মূল উদ্দেশ্য কি জানেন? ভয় দেখানো। ভয় দেখাতে পারলে দমিয়ে রাখা সহজ হয়। কর্নেল তাহেরের কথাটা খুব মানি আমি, নি:শঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় সম্পদ নাই।

বোনেরা, বন্ধুরা, ভয় পাবেন না। আপনার সাথে যেকোন কিছু ঘটতে পারে, কিন্তু ভয়ের ধার ধারবেন না। স্টে উইথ ডিগনিটি। ভুল হবে, কখনও অনেকরকম কৌশল করতে হবে, কখনও হয়তো নতও হতে হবে, কিন্তু রাস্তাটা ছেড়ে আসবেন না। পুরো আকাশ আপনার, জমিও, ইউটিলাইজ ইয়োর স্পেস।

আর এই আকাশে, জমিতে-পুরুষ, আপনারও ভাগ আছে। তাই পাশের নারীটিকে আপনারই মতো সত্ত্বা ভাবতে শিখুন। এখনই। একা একা আপনিও ভালো থাকতে পারবেন না। ভালো থাকুন, ভালো রাখুন। তা না হলে ক্ষতি আপনারও কম হবে না।

নারী দিবসে শুভেচ্ছা সেইসব পুরুষদের যারা এসব অনুধাবন করে বন্ধুর হাতটি দৃঢ়ভাবে ধরে থাকেন। আপনারা আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.