পুরুষ হিসেবে আজ আমি নিজের কথাই বলবো

Man with fluগোলাম কিবরিয়া: ক্যান্সার আক্রান্ত এক নারীর স্বামী হিসেবে আমি জানি উপরের এই কার্টুনটি কতোটা সত্যি কথা বলছে। রোগাক্রান্ত পাঁচটি বছরের তাকে কমপক্ষে ৩৭টি কেমোথেরাপি নিতে হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, গড়ে প্রতি মাসেই  একটির বেশি কেমো নিয়েছে। তারপরেও মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া, রান্নার মেন্যু ঠিক করা, ঘরবাড়ি দেখাশোনা এবং সামাজিক সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে ছেদ পড়েনি। শুধু হাসপাতালে ভর্তি থাকার দিনগুলো আর কেমো নেয়ার পরের দু-একটি দিন, যখন বিছানা থেকে উঠার মতো অবস্থা থাকতো না শরীরের, সেই দিনগুলো ছাড়া।

২০১০ সালের এপ্রিলে রোগ ধরা পড়ে, পহেলা বৈশাখের পরদিন, অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল অপারেশন হয়। এর পর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলে প্রাণ রক্ষার সংগ্রাম, কেমোকেরাপি আর শরীর থেকে জীবনী শক্তি শুষে নেয়া ওষুধ সেবন। প্রথম কয়েক মাস চাকরি থেকে বিনা বেতনে ছুটি নিয়েই চলছিলো চিকিৎসা, পরে ডাক্তারদের পরামর্শে চাকরিটা ছাড়তেই হলো। তারপরও স্বপ্ন ছিলো, একদিন আবার ঠিক নতুন কোথাও চাকরি নেবে।   

Kibria 1তার অসুস্থতা এবং অপেক্ষাকৃত সুস্থ্ দিনগুলোতে আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, একজন নারী বলেই হয়তো এতো প্রবল প্রাণশক্তি। এই পাঁচ বছরে আমরও যে ছোটখাট অসুস্থতা দেখা দেয়নি, তেমনটা নয়, কিন্তু সামান্য জ্বর বা মাথা ব্যথায় কাতর হয়ে বিছানা নিতে রীতিমতো লজ্জা পেতাম আমি। অবাক হয়ে ভাবতাম, এতো বড় যন্ত্রণা শরীরে পুষে কীভাবে দিন যাপন করছে সে?

হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে দিয়ে এসেও দিব্যি অফিস করেছি আমি, সহকর্মীদের কেউ বুঝতেই পারেনি, মনে ভেতর কতোটা কী অধীর উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগে দিন কাটছে! এটি সম্ভব হয়েছে শুধু তার কারণেই। তার অসম্ভব মনের জোর আমাকে অবাক করে দিতো। ডাক্তারদের কপালে চিন্তার রেখাগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিঁধতো, দিশেহারা হয়ে পড়তাম আমি।  অথচ, তার মনোবল ছিলো সাংঘাতিক।

জোর গলায় বলতো, দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। কেমোথেরাপির এই সাইকেলটা শেষ হলেই সুস্থ হয়ে উঠবো আমি। এখন বুঝতে পারি, নিজেকে নয়, আমাকে প্রবোধ দিতেই ছিলো তার অভিনয়। শরীরের ভেতর যে ভাঙ্গনের সুর, সেটা ভুক্তভোগীর চেয়ে বেশি কে জানে!

Kibria 2আমার মেয়েটাও হয়েছে মায়ের মতোই। গতবছর ঠিক এই মাসেই, ১৮ মার্চ তার মায়ের মৃত্যুর পর রাতারাতি আমার ৯ বছরের মেয়েটা যেন ১৯ বছরের তরুণী হয়ে উঠেছে। এক বছরে তার চিন্তা-চেতনার বয়স বেড়েছে ১০ বছর। স্কুল, পড়াশোনা সব সামলে আমার দেখাশোনা করাটাও এখন তার অন্যতম প্রধান একটি কাজ। অফিসে মাঝে-মধ্যেই তার ফোন পাই, নাস্তা করেছি কিনা, দুপুরের খাবার খাওয়া হয়েছে কিনা….যেমনটি করতো তার মা। চোখের দুকোণ ভিজে উঠে।

প্রতিটি নারীর ভেতরই বাস করে একজন মমতাময়ী মা, বইয়ে পড়া এই বাক্যটির সত্যতা আমার মতো আর কেউ কী এভাবে প্রতিদিন অনুভব করেন?   

 

শেয়ার করুন:

নারীরা নারীদের সম্মান করুন,প্রত্যেকে নিজ জায়গা থেকে নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তা করুন,পুরুষ এবং রাষ্ট্র বাধ্য হবে আমাদের সম্মানে যোগ্য মর্যাদা দিতে।
অধিকার কেড়ে নিতে হয় ,
অধিকার লড়ে নিতে হয়।

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.