তানিয়া মোর্শেদ: মধ্য বয়সী পুষ্পকে দেখলে বোঝা যায়, সুন্দরী বলতে ভারতীয় উপমহাদেশে যে নারীদের ধরা হয় সে তাদেরই একজন। সব মিলিয়ে কেমন যেন দূর্গা দেবীর মত মনে হয়। অধরার সাথে পুষ্পের পরিচয় কিছু সময়ের। তার মাঝেই পুষ্পের মানবিকবোধের পরিচয় পেয়েছে অধরা। পুষ্প নিজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সমাজ এখনো সেভাবে নারীর প্রতিষ্ঠাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে না।

পরিচয়ের প্রথম দিকেই অধরাকে বলেছিল যে তার অনেক অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঐ কথাটুকুর মধ্যেই অধরার মনে হয়েছিল, পুষ্পের গল্পটার মধ্যে আরো কিছু আছে। অধরার কাউকে ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করার অভ্যেস নেই। অথচ সে অনেকেরই না বলা কথা বুঝে যায়। আবার অনেকেই কেন জানি তাদের না বলা কথাগুলো অধরাকে নিজে থেকেই বলে।
পুষ্পের কন্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে কয়েক বৎসর হলো। ছেলে আগেই পড়া শেষ করে কর্ম জগতে ব্যস্ত। অফিসের কাজ শেষে এখন পুষ্পের কিছু সময় থাকে হাতে। আগে সে সময়গুলো সন্তানদের শিক্ষা, জীবন গড়ার কাজে দিতো। তখন বরং সময়ের টানাটানি ছিল। এখন সেই বাড়তি সময়টুকুতে তার অতীত সামনে চলে আসে। আর দশটা বাংগালী নারীর মত সেও নিজেকে সময় দিতে শেখেনি। তাই বিষন্নতা ঘিরে ধরে পুষ্পকে।
এক বিকেলে পুষ্প আসে অধরার কাছে। কিছুক্ষণ বিভিন্ন বিষয়ে কথার পর পুষ্প বলে, “দিদি আমার কেন জানি শুধু অতীতের কথা মনে হয়। কষ্টের স্মৃতিগুলো সামনে আসে। অথচ আমার তো এখন ভালো থাকার কথা। সব আছে যা একজন মানুষের থাকার কথা।”
অধরা বলে, “সম্ভবত তোমার এম্পটি নেস্টের বোধ থেকে এটা হচ্ছে। নিজের পছন্দ মত কিছু খুঁজে নিয়ে সেই সময়টা ব্যস্ত থাকো ও উপভোগ করো। পছন্দের বিষয় যে কোনো কিছু হতে পারে। শুধু দেখবে তা তুমি উপভোগ করছো কি না।”
এক পর্যায়ে পুষ্প বলে, “আমার মেয়েটার পড়া শেষ হলে আমি বাংলাদেশের নারীদের জন্য কিছু করবো। আমি বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে কিছু করবো। এটা মেয়েদের জীবন নষ্ট করে দেয়।” এক পর্যায়ে বলে যে অনেক বয়সের ব্যবধানে বিয়ে হওয়াটা খুব খারাপ।
বলে, “আমরা কাজ থেকে ফিরে কোনো কথা বলার কিছু খুঁজে পাই না। দু’জন দুই ঘরে। আমি হয়তো একটা মুভি দেখার কথা ভাবছি, বা অন্য কিছু করার কথা ভাবছি আর তিনি কোরান শরীফ নিয়ে বসছেন।”
অধরা বলে, “বিয়ের সময় হয়তো কারো কারো কাছে বয়সের ব্যবধান সেভাবে কিছু মনে নাও হতে পারে, কিন্তু একটি বয়সে পৌঁছানোর পর অনেক বয়সের ব্যবধান থাকা নারী-পুরুষের মধ্যে মানসিক ব্যবধান তৈরী হতে পারে। বয়সের সাথে মানুষের কিছু চিন্তা, আচরণের পরিবর্তন আসে। অনেক সময় এটা অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।”
পুষ্প এর পর বলে ওঠে, “শুধু পরের কথা বলছো কেন দিদি! বিয়ের সময় কি সব ঠিক থাকে?” তারপর সে বলে চলে যে তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাকে বাস করতে হয়েছে। এসব কারণে তার বাবা-মা তাকে তার নানীর বাড়ীতে রেখে ছিলেন। নানী ছিলেন বেশ গোঁড়া নারী। আর পুষ্পের শত্রু ছিল তার রুপ। কাজিনদের থেকেও তাকে দূরে দূরে রাখতেন নানী, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় এই চিন্তায়।
এসবের মধ্যেই একদিন পুষ্প স্কুল থেকে ফিরে জানতে পারে তার বিয়ে। পাত্র মেধাবী, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন। তাই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে। পুষ্প পড়ালেখায় অনেক মেধাবী। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। সে কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরে। মায়ের মন কোনো কিছুতেই টলে না। বিয়ে হয়ে যায়। এ কথাগুলো বলার সময় পুষ্পের চোখ ছল ছল করে।
অধরা ভাবে, সে কি উঠে যেয়ে পুষ্পকে জড়িয়ে ধরবে না কি ওকে কথা বলতে দেবে? এর মাঝেই পুষ্প বলে ওঠে, “জানো দিদি, আই ওয়াজ রেইপড! চারদিন পর চলে যাবে বর। ঐ চারদিন তার যা ইচ্ছে তা করেছে আমার সাথে। চৌদ্দ বৎসরের আমি কিছু বুঝি না তখন। আমার এমন অবস্থা হয়েছিল যে ডাক্তারের কাছে নিতে হয়েছিল। ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছিল না। ডাক্তার এমন রেগেছিল যে বলেছিলেন, মেয়ের বাবাকে ধরে নিয়ে আসেন।”
একথা শোনার পর অধরা স্থবির হয়ে যায়, নড়তে পারে না। শুধু কথা বলে পুষ্পকে জীবন সম্পর্কে পজেটিভ থাকতে বলে। শুধু এটুকুই বলে, “তুমি তোমাকে নিয়ে ভাবো এখন। মরে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। নিজের জন্য বাঁচো।” পুষ্প বেশ কয়েকবার মরার কথা বলেছিল।
পুষ্পের বর বিদেশে চলে যাবার পর পুষ্প পড়ালেখা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। বর যখন মাঝে মাঝে আসতো, পুষ্পের বাবা খুব অপছন্দ করতেন। পুষ্প অনেকবার ডিভোর্স নিতে চেয়েছে। মা বোঝাতেন, “ডিভোর্সী মেয়েকে কে বিয়ে করবে? কয়েকটি বাচ্চার বাবা করবে হয়তো। তখন সেই সব বাচ্চাদের তোমার বড় করতে হবে।”
পুষ্প এক সময় সেই বরের কাছে যায়। বর তখনো পড়ছে। বরের পড়ার খরচ, সংসার চালানোর জন্য পুষ্পকে কাজ করতে হয়। যেহেতু তার সে দেশের ডিগ্রী ছিল না তাই অনেক কষ্টকর কাজ করতে হয়। এরমধ্যে সে গর্ভবতী হলে বরের চাপে অ্যাবরশন করতে হয়। একথা বলে পুষ্প আবার কাঁদে। বলে তখন বর অনেক খারাপ ব্যবহার করতো। চিৎকার, চড় থাপ্পর মারতো। পুষ্প পরে নিজেও বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নেয়। এখন সে অনেক বড় জায়গায় চাকরি করে। বলে, “আমি এখন ভালো আয় করি। বর এখন আর চড় থাপ্পড় মারে না। টাকার সাথে অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে।”
এখন ওর মা ওর জন্য অনেক কিছু কিনে নিয়ে আসেন। ও বলে এসব কিছু ওকে স্পর্শ করে না। বলে, “মা হচ্ছে সবচেয়ে বড় আশ্রয়। সেই মা আমাকে দেখেনি। বলেছে, মেয়েদের বরের বাড়ীই সব। বরের কথাই সব। এখন এতো বৎসর পর মা আমার জন্য কী আনলো, কী করলো তা কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না।” আরো কিছু কথার পর বলে, “এই যে সবাই মুভিতে ভালবাসার গল্প বলে, দেখায়, আমি কোনো ভাবে এর সাথে নিজেকে মেলাতে পারি না। আমি জানি না ভালবাসা কী জিনিস, প্রেম কী?” ও চলে যাবার আগে অধরা ওকে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ।
পুষ্প চলে যায় তার না বলা গল্প করে। অধরার কানে বাজতে থাকে, প্রেম কী জিনিস? ভালবাসা কী আমি জানি না!