অভিজিৎ- আলো হাতে আঁধারের যাত্রী

Abhijit 3লুতফুননাহার লতা: দেখতে দেখতে সময় কিভাবে চলে যায়! এই তো সেদিন মাত্র অভিজিৎ আর বন্যা দেশে এসেছে ২০১৫’র মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। একুশের বইমেলাই প্রধান উপলক্ষ। বইমেলাতে থাকবে পারলে প্রতিদিনই। বই নিয়ে, লেখালেখি নিয়ে আড্ডা দেবে। বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করবে। তাঁর আর ডঃ মীজান রহমানের লেখা ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইখানি প্রকাশিত হয়েছে সে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবে বাংলাদেশের বিজ্ঞান মনস্ক ভক্তদের সাথে। বন্ধু, ভক্তদের সাথে সময় কাটাবে বইমেলায় এমন সব স্বপ্ন নিয়ে।

দেশে আসবার পরে আজ ক’দিন প্রায় রোজই ওরা আসে। আজো এসেছে। আসবার সময় দু’জনেই পরেছে পতাকার লাল সূর্যের মত নাকি লাল রক্তের মত রঙের পাঞ্জাবি আর ফতুয়া! সেদিন বই মেলাতে কারা(?) যেন ডেকে নিয়েছিল ওদের! বই মেলায় বিজ্ঞান আলোচনা হলো। ওরা প্রকাশনার স্টলে ভক্তদের সাথে আড্ডা দিয়ে, বাংলা একাডেমির মাঠে বসে সিংগাড়া খেয়ে ঘরে ফিরছিল খুশী মনে। দুজনার হাত ধরে ছিল দু’জনে। বাসায় ফেরার পথে বাইরে কিছু খেয়ে ফিরবে বলে প্ল্যান করছিল ওরা! হাসছিল দুজনেই বাড়ীর মানুষদেরকে ফাঁকি দিয়ে বাইরে খাবে বলে। বাড়ীতে জিজ্ঞেস করলে যা হোক একটা কিছু বলবে। ওদের গাড়ীটা একটু দূরে অপেক্ষা করছে। হেটে এইটুকু পথ গেলেই গাড়ীতে উঠবে ওরা।
কিন্তু না ওরা আর যেতে পারেনি। একটি বা কয়েকটি ধারালো চাপাতি অদুরে অপেক্ষমান ছিল চা দোকানের কাছ ঘেসে, পুলিশ পেট্রোল টিমের নাকের ডগায়, মেলা ফিরতি লোকজনের হালকা আনাগোনার আশেপাশেই। কিছু বুঝে ওঠার আগ মূহুর্তেই অভিজিৎ গড়িয়ে পড়ল মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। মাথা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল মৌলবাদের ত্রাস অভিজিতের মগজ। রক্তাক্ত প্রান্তর হয়ে গেল রাজু ভাস্কর্যের উলটো দিকটা।

আর বন্যা! মাথা কপাল চোখ নাক মুখ বুক পেট লাল রক্তের বন্যায় ভাসতে ভাসতে উদ্ভ্রান্তের মত চিৎকার করে সবাইকে সাহায্যের জন্যে ডাকতে ডাকতে একেবারে ভেসে গেল বুড়িগঙ্গার বদলে রক্তগঙ্গায়। রাস্তায় কংক্রিটের উপরে বৃত্তাকার মহাশূন্যের উপর পড়ে রইল অভিজিৎ এর চশমা, মাথার মগজ, বন্যার বাদামী ব্যাগ, হাতের আঙ্গুল। ওদের রক্ত ওই বৃত্তকে ভেদ করে গড়িয়ে গেল রাস্তায়। বৃত্তাবদ্ধ রইলো না। শূন্য থেকে মহাবিশ্বের এক ঐন্দ্রজালিক সুপারনোভা এইখানে এই জন্মভূমির ধূলামলিন রাস্তা থেকে মিলিয়ে গেল মহাশূন্যে।

সেই অন্ধ মৌলবাদের কালো ছায়াঘেরা সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সকল গৌরবের স্মৃতিকে মলিন করে দিয়ে এক অমানবিক সাম্প্রদায়িক অন্ধ ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসী কালরাত্রির অশুভ সূচনা হল আবারো বাংলাদেশে আর তা ঐ অমর একুশের বই মেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টি এস সি , ফুলার রোড, ঢাকা মেডিকেল আর শহিদ মিনার থেকে খুব বেশী দূরে নয়।
অভিজিৎ কে নিয়ে লেখা খুব সহজ নয়। যতবার ভাবি ওর কথা, দু’চোখ জলে ভেসে যায়। ওকে চিনেছি ওর লেখায়, ওকে জেনেছি ওর লেখায়, ওকে আবিষ্কার করেছি ওর লেখায়। এমনি করে ভুলেই গেছি যে ওকে দেখিনি কোনদিন।

তাই আমার অদেখা চিরচেনা অভিজিৎ, মুক্তমনা, বিজ্ঞান লেখক, আলো হাতে আঁধারের যাত্রী। ডঃ অভিজিৎ রায়। যিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন দূরের আলোর মশাল। জানিয়েছিলেন কত অজানারে। ইতিহাসের রক্তাক্ত পাতায় পাতায় হাঁটতে শিখিয়েছিলেন আমার মত কত মানুষকে, কত অগনিত তরুণের হাত ধরে।

সে অনেক দিন হলো, হঠাৎ করে ম্যানহাটানে দেখা ছেলেটির সাথে। ওর নাম জাহেদ। আগেও ওকে দেখেছি মিছিলে মিটিঙে। দেখেছি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাথে। কম্পিউটারে তার বেশ দখল আছে জানতাম। বাংলায় লিখতে চাই কিন্তু ঠিক কোন কী বোর্ড কিভাবে ব্যাবহার করবো তার কিছুই জানিনা। দেড়’শ ডলারে মুক্তধারা থেকে বিজয়ের কীবোর্ড এনেছি কিনে কিন্তু তা কাজে লাগাতে পারছি না । জাহেদকে দেখেই সেকথা মনে পড়ল, অনেক অনুরোধ করলাম একটু এসে আমাকে বাংলা লেখায় সাহায্য করতে।

জাহেদ এলো, কম্পিউটারে বাংলালেখার আর মুক্তমনার সন্ধান দিয়ে গেল। সেই থেকে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন।
অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিতজ্ঞ প্রফেসর মীজান রহমানের সাথে পরিচয়ের পরে শুনেছি উনি আর অভিজিৎ দু’জনে মিলে লিখছেন ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইখানি।

ওর প্রতিষ্ঠিত ব্লগ ‘মুক্তমনা’ তিল তিল করে কাজ করে গেছে সেই কবে থেকে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ পরবর্তী পাকিস্তান-বান্ধব সরকারগুলোর ইতিহাস বিকৃতির কারণে সৃষ্ট মহান মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসকে অনেকের সাথেই তরুণ প্রজন্মের কাছে আবার তুলে আনেন অভিজিৎ রায় আর তার মুক্তমনা।

Alo alo
ছবিটি উদিসা ইসলামের তোলা

ঘাতক পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও আমাদের দেশের রাজাকার, আলবদর, আল শামসের কুলাঙ্গার যুদ্ধাপরাধীদের মুখোস উন্মোচন করে দিয়েছিল অভিজিৎ। আমি মনে করি যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ ও জামাত পাকিস্তান বান্ধব খালেদা’র অপসারণ সম্ভব হয়েছে তার পেছনের কারিগর যেমন তরুণ প্রজন্ম, তেমনি আমাদের ২০১৩’র শাহবাগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সারা বাংলাদেশকে এক করবার বীজমন্ত্র যারা উচ্চারণ করেছিলেন, তরুণদের মধ্যে চেতনার আগুন যারা উল্কার গতিতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অভিজিতের নাম ভাস্বর হয়ে থাকবে।

জ্ঞান চর্চায়,সত্যানুসন্ধানে, বিজ্ঞানের অসীম সমুদ্রে ওর যে সুবিশাল উপস্থিতি তা অনস্বীকার্য। সত্ উদ্ঘাটনে, দৃঢ়তার সাথে তা প্রকাশে আর সাহসী উচ্চারনের অসম বীরযোদ্ধা ছিল অভিজিৎ। প্রচলিত অন্ধ ধারণার বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সত্যকে সত্য বলে সামনে আনার এক যাদুকর ছিল অভিজিৎ। অগনিত তরুণের ভেতরে জ্বেলেছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের মশাল। সত্য সে যত নিষ্ঠুর হোক যুক্তি দিয়ে তাকে জয় করবার বরাভয় ছিল ওর কন্ঠে ওর লেখায়।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে শুনেছি তদন্তের কথা, বিচারের কথা কিন্তু জানি সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। মৌলবাদ নিপীড়িত বাংলাদেশ মুক্ত হোক মৌলবাদের করাল গ্রাস থেকে। স্বাধীনতার এতোবছর পরে যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে তখন জানি, নিশ্চিত জানি অভিজিৎ সহ সকল ব্লগার হত্যার বিচার হবেই একদিন। মানুষের মৃত্যু হয় চেতনার মৃত্যু নেই। অভিজিৎ যে সত্যের জন্যে জীবন দিয়েছে সেই সত্যের মৃত্যু নেই। মৃত্যু নেই তাঁর আদর্শ ও মননের। জয় হোক পৃথিবীর সকল উদার মুক্তমনা মানুষের।

শেয়ার করুন: