জীবনের ঘানিঘরে

g-3সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: এক বছরের বেশি সময় পর অশীতিপর বৃদ্ধ ইউসুফ আলীর বাড়ির পথ চিনতে কোন অসুবিধে হয়নি। ধরলা নদী ঘাটের নৌকায় পার হয়ে ভাঙ্গা ছেঁড়া বালির পথ ধরে মোটর বাইক নিয়ে এগোতে থাকলে পথের অনেকেই পথ এগিয়ে দেখিয়ে দিতে থাকলো। কুড়িগ্রামের হলোখানা ইউনিয়নের চর কাগজিপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। ‘ইছোব তেলী’ এই নামে তাকে সাত গ্রামের মানুষ চেনে।

পাকিস্তান আমল থেকেই তিনি তেলের ঘানিতে সরিষা ভেঙ্গে খাঁটি তেলের ব্যবসা করতেন। সামান্য কিছু জমিজিরাতও ছিল একসময়। নদীর ক্ষুধা ও সন্তানদের ক্ষুধার কামড়ে নিঃশেষ হয়েছে সে জমি। তখনও শরীরে সামর্থ্য ছিল, মনে ছিল সাহস। তাই তিনি মনোবল হারাননি।

আর এক জোড়া তাগড়া বলদও ছিল সেসময় ঘানি টানার। দিনের একবেলা সরিষা ভাঙ্গতেন, অন্য বেলায় তেল ফেরি করে বাড়ি বাড়ি বেচে বাজার-সদাই নিয়ে ঘরে ফিরতেন।

এভাবেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধি বড় ছেলে শাহাবুলের (৫০) বিয়ে দিয়েছেন, বড় মেয়েরও বিয়ে দিয়েছেন। সে সময় অভাবে পড়ে একটা বলদ বেচে দিতে হয়েছিল তাকে। অন্য বলদটি দিয়ে তার রোজগারের পথটুকু খোলাই ছিল বলে তিনি তখনও কোন ভয় পাননি। কিন্তু সাত বছর আগে যখন ছোট মেয়ে ফজিলার বিয়ের যোগ্যতা হিসেবে একমাত্র বলদটিই তার সামর্থ্য হলো, তখন সেটি দিয়েই কন্যাদায় মুক্ত হন তিনি।

কিন্তু খাবেন কী? যুগ যুগ ধরে চালিয়ে আসা পেশা বন্ধ হলে রোজগার করবেন কীভাবে? নিঃসন্তান ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধি ছেলে শাহাবুল, তার স্ত্রী, তাদের মা নুরজাহানকে নিয়ে ইছোব তেলির সংসারের চুলা আর জ্বলে না। বাধ্য হয়ে নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন সেদিন ঘানির জোয়াল।

বলদের শক্তি শরীরে নিয়ে জোয়াল টানতে যতটা না ঘানির সরিষা ভেঙ্গে তেল ঝরে, তার চেয়ে বেশি ঝরে শরীরের ঘাম। বুকের মাঝে জোয়াল চাপিয়ে দু’হাতে শক্ত করে ধরে যখন টানতে শুরু করেন জোয়াল, চোখদুটো তার সামনের দিকে বিচ্ছুরিত হয়ে ফেটে পড়তে চায় সর্বশক্তি দিয়ে। পা‘দুটোকে পিছনের মাটি শক্ত করে টেনে ধরে। কাঁধের রগ ফুলে ওঠে, চামড়া মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তবুও টানতে হয় জোয়াল। তবুও ঘানি ঘোরে। তবেই তো তেল ঝরে। তবেই তো চূলা জ্বলে।

ইছোব আলী যখন আর পা ছেচড়িয়েও এগোতে পারেন না, তখন ছেলে শাহাবুল তুলে নেন জোয়াল। নুরজাহানও সাথে থেকে নেড়েচেড়ে দেন। এটা-ওটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেন কাজে। এভাবেই চলে গেছে জীবনের সাত-সাতটি বছর।

এর মধ্যে ইছোব তেলির বাম হাতের বল একেবারেই কমে গেছে। কিন্তু মনের বল খুব একটা কমেনি আজো। নিয়তিকে খুব বেশি আপন করে নিয়ে তাকেও কোন অভিযোগ করতে চান না তিনি।

খোলা আকাশের নীচে তার ঘানিঘর। রোদ-বৃষ্টিতে কোন আড়াল করার উপায় নেই। রোদে তবুও পুড়ে পুড়ে কাজ চালানো যায়। কিন্তু বৃষ্টি হলে কাজ একেবারেই বন্ধ করে দিতে হয়। সরিষায় পানি পড়লে তেল নষ্ট হয়ে যায়। তখন পুরো পরিবার উপোস দিন কাটায়।

ইছোব তেলির জিরজিরে ছনের ঘরে কোন জানালা না থাকলেও দিনের বেলায় যেমন সূর্যের আলো বিছানায় পড়ে বিনা বাঁধায়। তেমনি বৃষ্টি-ঝড়ে ছেঁড়া ছাতাটার নিচে দিন-রাত স্ত্রীসহ বিছানায় বসে থাকেন তিনি। ভাঙ্গা বেড়া, ভাঙ্গা চালায় বছর বছর শীতও হুমড়ি খায় তাদের বুড়া হাড়ে।

g-5দেশ নাকি এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। প্রতি বছর প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। মাথা-পিছু আয় বাড়ছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এমন ঘোষণা রোজকার পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়। কানে আঙুল দিয়ে চেপে থাকলেও মস্তিস্ক ফুটা করে ঢুকিয়ে দেয়া হয় এমন ঘোষণা। অবশ্য তাতে ইছোব তেলির কোন জ্বালা নেই। তিনি পড়তেও পারেন না। কোন ঘোষণা শোনার মতো টেলিভিশনও তার মগজের নাগালে নেই। এসব তিনি বুঝতেও চান না।

সরকারি সুবিধা বলতে একটা বয়স্ক ভাতা পেতে একবার পরিষদেও গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেও দালাল ব্যবসাটা ভালো টের পেয়ে ফিরে এসেছেন। এককালীন চার হাজার টাকা ঘুষ দেয়ার সাধ্য তার পরকালেও হবে না এটা তিনি নিশ্চিত।

বন্যা আসে, খরাও আসে, আসে শীত। উৎসবে মাতাল বিত্তবান বাঙালীর আয়োজনের মতো সময় সময় আসে কিছু ত্রাণকর্তাও। তারা চোখের সামনে ফানুস উড়িয়ে দিয়ে রঙ দেখাতে চায়। নামের তালিকা হয় ফাইলের পর ফাইলে। ইছোব তেলির ঘানির সরিষা পিষে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল ঝরে। ফাইলের তালিকা থেকে একটা নামের ফোঁটাও গড়ায় না।

ইছোব তেলিকে একটা বলদ কিনে দেয়া হবে কয়েকজন মানবতাবাদীর উদারতায়। তিনি নিজে হাটে গিয়ে পছন্দ করে বলদ কিনে নেবেন। টাকা যা লাগবে দেয়া হবে। খবরটি শুনে তার একটুও চোখের পাতা নড়ে না। কোন উচ্ছাস, বিচলতার লেশমাত্র নেই। তিনি জোয়াল টানছেন তো টানছেন। আপন মনে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। ছয়মাস আগেও যে মানুষটি বলদ পাওয়ার আশায় শেষবার ফোন দিয়েছিলেন, সে মানুষটির আজ কোন আগ্রহ নেই তাতে।

এবার আবারো বলদ কিনে দেয়ার কথাটি একটু জোর দিয়ে জানাতে গেলে তিনি বললেন, ‘‘জীবন টানতে টানতে নিজেই বলদ হয়েছি, আবার বলদ টানতে পারবো তো? ‘আমার নিজের থাকার ঘর নেই, বলদ রাখব কোথায়? সেতো আর বুঝতে চাইবে না আমার নিয়তি। একেবারেই বাকরুদ্ধ পরিবেশ। শব্দহীন চারপাশ। দম বন্ধ হয়ে থেমে গেছে। থেমে গেছে ঘানিঘরের পাশে সারি সারি শিমুল-পলাশের ফুল থেকে রক্ত আলো ঝরা। বাতাসও হয়তো থেমে ছিল খানিক্ষণ।

তিনিই স্তব্ধতা ভাঙ্গলেন। স্ত্রী নুরজাহানকে ডেকে বললেন, আগামীকাল হাটে যাবো বলদ কিনতে। নুরজাহানের চোখ থেকে নুর মিশ্রিত জল গড়িয়ে পড়ল ঘানির খৈলে। চক চক করে উঠলো শাহাবুলের চোখ-মুখ।

লেখক ও সাংবাদিক

  

 

শেয়ার করুন: