মৌসুমী বিশ্বাস: অস্থির প্রেক্ষাপটে সুস্থির কিছু লেখার জন্য ভাবাটাই সংকটময়তার বহিঃপ্রকাশ। অনেককাল ধরে ভাবছিলাম কিছু একটা লিখব যাতে অবশ্যই শৈশব থাকবে, নানা মুখরতার কথা থাকবে, রাজনীতির উত্তাল দিনগুলোর কথা থাকবে, থাকবে হঠাৎ না বলে আসা ভালোলাগার মুহুর্তরা। কিন্তু আমার বরাবরই যেটা হয় কোনকিছু শুরু করতে অসম্ভব সময় নিয়ে ফেলি। অবশ্য শুরুটা কোনক্রমে করা গেলেই শেষ নামিয়ে ফেলা যায় দ্রুতই। এটিও তার ব্যতিক্রম হলো না; যাই হোক মূল লেখা শুরু করা যাক।
একসময় রিকশায় প্রচুর অকারণ ঘোরাফেরা হতো। এম এম কলেজে আমাদের বিখ্যাত মাঠে বসে বন্ধুরা মিলে হুলস্থুল আড্ডা দিচ্ছি হঠাৎ মনে হলো ধূর, যাই রিকশায় ঘুরে আসি। তখন মনে হওয়া মাত্রই ছোটখাটো ইচ্ছা পূরণ করা যেত। ১০/১৫ জনের দল থেকে ৩/৪ জন চোখের ইশারায় বেরিয়ে পড়তাম। কখনো এক রিকশায় ৩/৪জন, কখনো ২ জন আবার কখনো বা একাই বেরিয়ে পড়া হতো ভর দুপুরে, সন্ধ্যা নামার কিছু আগে বা সন্ধ্যায়। তখন আসলে এত সময়ের হিসাব থাকত না বা হিসাব রাখতে হতো না। পুরোটাই বে-হিসাবি কিন্তু অসম্ভব উপভোগ্য জীবনযাপন। আমাদের গদ্ বাধা কিছু রাস্তা ছিল যে রাস্তায় যাওয়ার জন্যই মূলতঃ এই বিপুল আয়োজন। আমার একসময়ের সবচেয়ে কাছের নির্ভেজাল বন্ধুটি (যে এখন সবচেয়ে দূরেরও বটে) একদিন রিকশায় যেতে যেতে বলল, ‘‘পথ আর রাস্তার পার্থক্য জানিস্?” মনেআছে একমুহুর্ত সময় নিয়েছিলাম উত্তর দিতে। বলেছিলাম, ‘‘মানুষের প্রয়োজনে রাস্তা, আর যেতে যেতে পথ”। বন্ধু আমার এই উত্তরই চেয়েছিল বোধহয় অথবা ভাবেনি এইভাবে ভাবা যায়। জিজ্ঞাসা করা হয়নি আর কখনো।
তখন মুগ্ধতার কোন সীমা পরিসীমা ছিল না। ঢাকা রোডের পাশে বিশাল এক পুকুর ছিল, রিকশায় যেতে যেতে ওই পুকুরের পাশে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একসময় গোটা পুকুরটাকেই নিজেদের কেনা মনেহত। কতদিন এমন হয়েছে যে, রিকশা ভাড়া আছে কি না সেটা না দেখেই রিকশায় উঠেছি। একঘন্টা ঘোরার পর মনেহল, তাইতো, টাকা তো সবটা নেই। তখন রিকশাওয়ালাকে বলেছি, ভাই দুপুরে ভাত খেয়েছেন? না খেলে চলেন আমাদের সাথে। ফসয়ালা হয়েছে কিছু টাকা দিয়ে আর বাকিটা বাসা থেকে ভাত খাইয়ে দিয়ে। কখনো বন্ধুরা মিলে সবার পকেট হাতড়ে ভাড়া মিটিয়েছি।
এক দুপুরে ঘোর বর্ষা নামলো বিকশায় ঘুরতে ঘুরতে। আনন্দ আর কাকে বলে। সমানে আমরা হুড খুলে ভিজছি রিকশায়, ঢাকা রোডের রাস্তা ধরে। হঠাৎ রিকশা গেলো উল্টে। আমরা পড়ে গিয়ে কাদাজলে একাকার। তখন সুবিধা ছিল একটাই। মোবাইল ফোন ছিল না। বাসা থেকে ফোন আসার কোন তাড়া নেই, পড়ে গিয়ে ফোন ভাঙ্গারও কোন ভয় নেই। এতসব আনন্দের মাঝে দুঃখ হতো একটাই, আর সেটা হচ্ছে, আহা, পকেটে যদি আর সামান্য কিছু টাকা থাকতো! তাহলে আরো কিছুটা সময় ঘোরা যেত রিকশায়। রিকশায় ঘোরাটা তখন নেশার মতো ছিল। এখন বেশকিছু টাকা পকেটে এমনিতেই থাকে সবসময় শুধু সময় আর মানুষগুলোকে আর পাওয়া যায় না।
আমার দারুণ পছন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- কখনো খুব ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি হাঠাৎ অসম্ভব পছন্দের সুমনের গানের লাইন ভেসে এলো স্পিকারে “জানিনা এ পৃথিবীর ঘাতকেরা গান শোনে কি না, জানিনা লালন শুনে ভাসে কেন মনের আঙ্গিনা—”। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে শোনারও কোন উপায় নেই আবার চলে যেতে যেতে মনে হয়, কী যে ফেলে গেলাম, না ফিরে পাওয়ার মতো! কিছু অনুভূতি পুরোনো হয় না। এই ভালো লাগা বোধটি এখনও সেই আগের মতই আছে। এখনও কোথাও হাঠাৎ জোরে গান বাজলে মনে হয়, ইস্ আর একটু শুনে যেতে পারতাম যদি (ঢাকার এ্যলিফ্যান্ট রোডের গীতাঞ্জলী অডিওর দোকানের সামনে এখনও বাজে এইরকম হঠাৎ গান)!
প্রত্যেকটি কালেরই পরিচিত কিছু গন্ধ থাকে। একসময় রাতে নিয়মিত যখন পার্টি অফিস, উদীচী, বিবর্তন অথবা কোন বন্ধুর বাড়ি থেকে বাসায় ফিরতাম তখন চলতি হাওয়ায় ছাতিম ফুলের মাতাল গন্ধ ভেসে আসত। তখন মনে হত, আরো কিছুক্ষণ এইখানে দাঁড়িয়ে এই ঘ্রাণ না নিয়ে যেতে পারলে গোটা জীবনেরই কোন মানে হয়না। বেঁচে থাকা আসলে কাকে বলে? এইসব অর্থহীন অনুভূতির নামই তো বেঁচে থাকা; অন্ততঃ আমার কাছে। হেঁটে যেতে যেতে প্রায়ই দেখতাম চকচকে রোদ্দুর পড়েছে কারো গাড়ির ব্যাক গ্লাসে। সেই গ্লাসের ওপর দিয়ে শরতের নীল আকাশ আর টুকরো সাদা মেঘ চোখের সীমানায় ক্ষণিক ঘোরাফেরা করছে। এই সব অহেতুক দৃশ্য দেখে অকারণ আনন্দ পেতাম।
একদিন আমি আর আমার বন্ধু রিমা কলেজ শেষে পার্টি অফিস ঘুরে রিকশায় বাসায় ফিরছি। চারখাম্বর মোড়ে এসে দেখলাম ভ্যানের ওপর তিনচোখের নরম তালের শাস বিক্রি হচ্ছে। তখন ভর দুপুর। দুজনের কাছে শুধু রিকশা ভাড়াটাই আছে; তালের শাস খাবার টাকা নয়। তাছাড়া দুইটা আস্ত মেয়ে শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে মধ্য দুপুরে তালের শাস খাবে এই দৃশ্যে শহরবাসী তখনও এত উদার হতে পারেনি। সেইসময়ে যাকিছুই করতাম মেয়ে হিসাবে প্রথা ভেঙ্গেই করতে হতো (যেমন- রাস্তার চা-এর দোকানে মেয়েদের দাঁড়িয়ে চা খাওয়া ও আড্ডাবাজি করা- এই দৃশ্য বহুল অপরিচিত, অথচ আমরা তা করেছি অবলীলায়)। যাহোক, রিমাকে বললাম, তালের শাস খাওয়া হবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে যাই বলুক আজ। তারপর দু’জন মিলে রিকশা ছেড়ে তালের শাসে বৃদ্ধাঙ্গুলি ডুবিয়ে তা খেয়ে ইচ্ছা পূরণ করা হলো। এই আনন্দ সতেরো বছর পরও প্রবলভাবে মনে আছে আমার।
পারফিউমের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব আছে আমার বরাবরই, খুব কাছের মানুষেরা সবাই জানে সেটা। বাসা থেকে কোন কারণে হয়ত খুব মন খারাপ করে বেরিয়েছি। দেখা গেল চলতি পথে হঠাৎ পরিচিত সুগন্ধির কোন গন্ধে মন খারাপ মিশে গিয়েছে হাওয়ায়। আমাদের কলেজে মান্নান ভাই চটপটি বিক্রি করতেন একসময়। তার চটপটি একদিন না খেলে মনে হতো দিনটাই বৃথা গেল। প্রায়শইঃ আমাদের চটপটি খাওয়ার পর্যাপ্ত টাকা থাকত না। কতদিন এমন হয়েছে যে, চার প্লেটের অর্ডার দিয়ে আমরা আট জন খেয়েছি! মান্নান ভাইকে বলেছি, চার প্লেট নিলে একটা ফ্রি দিয়েন তো মান্নান ভাই..আহা! সেইসব মজার দিনগুলি।
মনেআছে, অনেক দিন পর হয়ত ক্লাস করতে গেছি। একটা ক্লাস করেছিও। পরের ক্লাসে আসতে স্যার দেরি করে ফেলছেন। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে তখন মিছিল শুরু হবে। ভাবলাম, দূর, পরের ক্লাসই আর করবো না। বন্ধুদের এইকথা বলতেই শিল্পী আমার ওড়না টেনে ধরে বলেছে, ‘ক্লাস না করলে তোকে বের হতে দেব না। থাক আর একটু, এই কøাসটা করে যা।’ এইসব ছোটখাটো আদর-যতœ, বন্ধুত্বের টান অনেক পরে বুঝেছি। ভালো লেগেছে সেইসব মুহুুর্তগুলো যখন দেখেছি আমাদের ছোটখাটো সফল আন্দোলনের প্রাপ্তি ্উদ্যাপনের কোন মিছিল শেষে ক্লান্ত হয়ে টেন্টে বসেছি তখন হঠাৎ না চেনা কোন ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই এসে বলেছে, আপনাকে দেখেই ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শিখেছি। এতসব ভালোলাগা তখন কোথায় রাখি!
মুন্নী আমার বন্ধু, বর্তমানে অষ্ট্রেলীয়া প্রবাসী, আমাকে না পেয়ে বাসার বারান্দায় টিস্যু পেপারের ওপর লিখে রেখে গেছে, “এসেছিলাম। তোকে পেলাম না।” বাসায় ফিরে তালাবদ্ধ ঘর খুলতে যেয়ে বন্ধুর রেখে যাওয়া বার্তার ধরণ দেখে মন ভালো হয়ে গিয়েছে। কখনো রাস্তায় চলতে যেয়ে দূর থেকে পরিচিত কারো “এই মৌ, কই যাস…” বলে গলা ফাটানো ডাক শুনে মন ভালো হয়ে গিয়েছে। মা’র মৃত্যুদিবসে বন্ধুদেরকে আমার মন ভালো রাখার জন্য আয়োজন করতে দেখে মন ভালো হয়ে গিয়েছে! ছাত্র আন্দোলনে একবার মাথাটা ফাটিয়ে ফেলেছিলাম। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারিনি প্রথমবার। সেইসময়ে আমার জন্য বন্ধুদের শোক দেখে মন ভালো হয়ে গিয়েছে। পরের বার ফাইনাল এক্সজামের সময় ৪ ঘন্টা পরীক্ষা শেষে বাইরে বেরিয়ে অনাকাঙ্খিতভাবে বন্ধুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমবার পরীক্ষা না দিতে পারার শোক আনন্দে পরিণত হয়েছিল। পরিচিতি ভিক্ষুক অনেকদিন বাদে বাসায় সাহায্য নিতে এলে তাকে দেখে মন ভালো হয়ে গিয়েছে। মধ্যরাতে ছাদে যেয়ে গরম কফির মগ হতে চরাচরের নিস্তব্ধতা দেখে মন ভালো হয়ে গিয়েছে। অনেক অযাচিত পাওয়ার মুগ্ধতা এখনও কাটাতে পারেনি ক্ষেত্রবিশেষে। এতসব আয়োজন যেখানে ছড়ানো সেই আয়োজনের উপলক্ষ হতে পারাটাই তো সমবেত অর্জন; ব্যর্থতা অথবা মনখারাপ শব্দটির খুব বেশি মানে হয়না আসলে। ভালো থাকা আর ভালো রাখাটাই মূখ্য।