স্যানিটারি প্যাড কেমন হওয়া উচিত?

আজই এক জায়গায় কথা হচ্ছিল এই প্রজন্মের মেয়েদের নিয়ে, তারা কতটা অগ্রসর, কতটা সচেতন, কতটা ‘অন্যরকম’ এ নিয়ে। আসলেই, এখনকার কৈশোরোত্তীর্ণ মেয়েরা যেসব কথা ভাবে বা বলার সাহস রাখে, আমাদের সময় তা ভাবতেও পারতাম না। আমাদের সময় পিরিয়ড একটা অস্পৃশ্য বিষয় ছিল। এ নিয়ে কথা বলাই ছিল পাপতুল্য। কিন্তু এখন মেয়েরা সামাজিক মাধ্যমেই এ নিয়ে কথা বলতে পারে অনায়াসে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়াই। জয়তু তোমাদের। এমনই একটি খুবই প্রয়োজনীয় আলোচনা ফেসবুক থেকে এখানে তুলে দিলাম। এ নিয়ে আরও কথা হওয়া উচিত।

Napkinমারজিয়া প্রভা: ক্লাস ফাইভে পিরিয়ড শুরুর পরপরই বিদেশী প্যাড ব্যবহার শুরু করি। সেনোরা স্কয়ার কোম্পানির এবং দেশে প্রস্তুত করা হলেও মূল কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনা। হুইসপার প্যাড P&G কোম্পানির এবং মূলত ভারত থেকে আমদানী। তাও ব্যবহার করেছি। খারাপ না।

তবে আরেকটু বড় হলে বাজারে আসে একদম বাংলাদেশের তৈরি “মোনালিসা”। সেটা ব্যবহার করতে গিয়ে চরম বিরক্তিতে পড়েছিলাম। প্যাডেরও আরাম-বেআরাম আছে। তাই মোনালিসা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম খুব দ্রুত।

সম্প্রতি বাংলাদেশে তৈরি স্যানেটারি ন্যাপকিন “জয়া” র এত প্রচারণা দেখে, “দেশি জিনিস ব্যবহার করবো না মানে” টাইপ ভাব নিয়ে জয়া ব্যবহার করলাম। আমি টাশকিত। মেয়েদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস, যেটা প্রতি মাসে দরকার, সেটা কি করে এত জঘণ্যভাবে ম্যানুফ্যাকচারড হতে পারে?

‘জয়া’ স্যানিটারি ন্যাপকিনে একটা গন্ধ দেওয়া আছে, অনেকটা বিউটি সোপের মত। গন্ধটা ব্যবহারের পরেও থাকে বলে খুব রিফ্রেশ একটা ভাব থাকে। কিন্তু এই গন্ধ আদৌ কেমিক্যাল দিয়ে দেওয়া কিনা, আমি জানি না! গন্ধআলা প্যাড শরীরের জন্য ক্ষতিকর কিনা এই নিয়ে আইডিয়া নেই ! তাই প্রথমে আমার ভালই লেগেছিল।

আসল প্রবলেমে পড়লাম পরে। ইউজ করতে গিয়ে দেখি প্যাডের আঠা জাস্ট একটুখানি। প্যান্টির সঙ্গে ঠিকভাবে এটাচড থাকে না। যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তারপর উপরের কভার ভীষণ খসখসে, আমার তিনদিনের মাথায় জঙ্ঘায় লাল র‍্যাশ উঠে পড়ে। আমি পড়ি মরি করে “জয়া” ব্যবহার ছেড়ে দিলাম।

বাইরের প্যাডগুলার দাম ১০০ থেকে ১১০ টাকার মতন, সেখানে জয়া দেশি পণ্য বলে ৬০ টাকাতেই পাওয়া যায়। অবশ্যই এটা ভাল। সব শ্রেণীর সব কর্মজীবী বা গৃহিণী নারীর জন্য বহনযোগ্য দাম। তাই এর ব্যবসা দারুণ হতো, যদি এর তৈরি প্রক্রিয়া মানসম্মত হতো!

ভাবা যায়, দেশের পিরিয়ড হওয়া নারীর সংখ্যা ৫ কোটিরও বেশী। অথচ এই দেশে “মেইড ইন বাংলাদেশ” স্যানিটারি ন্যাপকিনের সংখ্যা মাত্র দুইটা নিদেনপক্ষে তিনটা, এবং তার একটাও মানসম্মত নয়, কোনদিক থেকেও ! এটা আসলে কার উদাসীনতা ! দেশের সর্বস্তরের নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ তৈরি লক্ষ্যে প্রচারণা চালান হয়, অথচ দামে এবং মানে দেশের একটা প্যাডও ভাল নাই। সব শ্রেণীর মেয়েদের কাছে প্যাড পৌঁছে দিতে কি আসলে কেউই প্রকৃতপক্ষে আগ্রহী নয়?

পিরিয়ড হচ্ছে মানবজন্ম বিকাশের প্রথম ধাপ। অথচ, আমি সিউর না ,হয়ত পিরিয়ডকে এখনও কোন ভাইটাল সাবজেক্ট মনে করে না পাবলিক, তাই জয়ার মতো ফালতু প্যাড বাজারে বিক্রি হয়, প্রচার হয়!

বিঃদ্রঃ আমি ফ্রিডমের ব্যাপার এড়িয়ে গেছি, স্ট্যাটাস লেখার সময় মনে ছিল না, বাংলাদেশের এসিআই কোম্পানি ফ্রিডম প্রডিউস করে। পরে এডিট করে ঢুকাচ্ছি লাইনগুলো। কিন্তু এর দাম খুব বেশী, এক্সট্রা লার্জ সাইজ ১১০ টাকা। এর মান নিঃসন্দেহে ভাল। আমার স্ট্যাটাসটা জয়া প্যাডকে নিয়েই মূলত।

(এটা সম্পূর্ণ লেখকের মতামত, তার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, ‘জয়া’ কোম্পানির নজরে এলে বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে)

 

শেয়ার করুন:

(লেখাটি ফেসবুকে নোট আকারে লিখেছিলাম। প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় এখানে কমেন্ট আকারে দিলাম)

সরকারকে ধন্যবাদ একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত বিষয়ে নজর দেওয়ার জন্য। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টয়লেট ও স্যানিটেশন (ছাত্রীদের মাসিকের সময়ে করণীয়) বিষয়ে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করেছেন। সে বিষয়ে কথা বলার আগে আসুন মাসিক নিয়ে আমাদের ভাবনাগুলো কী তা দেখি।

মাসিকের দিনগুলোকে অনেকে ‘শরীর খারাপ’ বলে। এসময় নাকি মেয়েরা ‘অপবিত্র’ ‘অসুস্থ’ বা ‘অপয়া’ থাকেন। মাসিক নিয়ে কুসংস্কার আর অশিক্ষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এমন অনেক মিথ আছে প্রায় সব সমাজে ; যা সত্য নয় । এ নিয়ে কথা বলা দরকার। কথা বলা শুরু হলেই একে একে ভেঙ্গে পড়বে নৈঃশব্দের শৃঙখলে বেড়ে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই নীরব ঘাতক ; যা কেবল নারীকেই পিছিয়ে রাখছে না, পিছিয়ে দিচ্ছে সামাজিক প্রগতি আর আর্থনীতিক অগ্রগতি।

মিথের বিপরীতে প্রকৃত সত্য হলো রেচন-নিঃসরণের মতো মাসিকও একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রাকৃতিক চক্র। মাসিকের স্রাব হচ্ছে রক্ত আর টিস্যুর মিশ্রন যা মাতৃগর্ভে শিশুর শরীর গঠনের জন্য কাজে লাগতে পারতো কিন্তু লাগেনি। শরীরের জন্য মাসান্তে এর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, শরীর তাই একে ত্যাগ করছে, যেমন ত্যাগ করে ঘাম, মল বা মূত্র। আরেকটি মিথ হলো মাসিকের সময় নারীরা সকল ধর্মীয় আচারাদি পালনে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, বা ধর্মীয় পুস্তকাদি স্পর্শ করতে অযোগ্য। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো প্রচলিত কোনো ধর্মমতেই মাসিকের সময়ে নারীকে অস্পৃশ্য বা অযোগ্য বলা হয়নি। ধর্মবিশেষে কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে যা সেই ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্যে অনুসরনীয়। কিন্তু তা কোনভাবেই নারীকে অস্পৃশ্য বা অযোগ্য বলে সাব্যস্ত করে না। মাসিকের সময়ে রান্না করা যায় না, পিঠা বানানোর সময় উপস্থিত হলে পিঠা নষ্ট হয়ে যায়, মাসিকের সময় সঙ্গমে গর্ভধারণ সম্ভব না, মাসিকস্রাবে এত রক্ত যায় যে নারী রক্তশুণ্যতায় ভোগে, মাসিক শুরু হওয়া একজন নারীশিশু পুরুষশিশুর সংস্পর্শে এলেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে, এ সময় নারীর জন্য মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া ঠিক না, গোসল বা সাঁতার কাটা উচিৎ না ইত্যাদি নানা মিথ আছে প্রায় সকল সমাজে।

এই সকল গভীরে-প্রোথিত অবৈজ্ঞানিক ও অসত্য ধারনার ফলে, অন্যান্য অবমূল্যায়নের পাশাপাশি, নারী তার শরীরের এই প্রাকৃতিক চক্রের কারনে বঞ্চিত হয় মানবাধিকার থেকে। যেমন, প্রতিমাসের এই ‘শরীর খারাপ’ আর ‘অপবিত্রতা’র অনুভবের চক্র ধীরে ধীরে তাঁকে হীনম্মন্য করে তোলে। তাঁর নিজের শরীরই তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় তাঁরা বাইরে যেতে স্বস্তি বোধ করেন না, এমনকি নিজের ঘরেও আড়ষ্ট থাকেন। নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হওয়া এই দিনগুলোর রেশ চলে পরের দিনগুলোতেও। তাঁকে অশুচি অপয়া ভাবা হয়, এমনকি তাঁকে নিজেকে অশুচি ভাবতে বাধ্য করা হয়, সে বঞ্চিত হয় তার মানবমর্যাদার অধিকার (Right to Dignity) থেকে। তাঁকে আবদ্ধ রাখা হয় ঘরে, এ সময়ের নিরাপত্তাহীনতা আর ‘লজ্জা’র কারনে অনেক নারীশিশু ঝরে পড়ে বিদ্যালয় থেকে, লঙ্ঘিত হয় তার শিক্ষার অধিকার (Right to Education)। মাসিককে একটা শারীরিক বৈকল্য বিবেচনা করে তাঁকে বঞ্চিত রাখা হয় বিশেষ কিছু কর্মের অধিকার (Right to Work) থেকে। উপযুক্ত টয়লেট সুবিধা না থাকায় ক্ষুন্ন হয় তার উপযুক্ত কর্ম-পরিবেশের অধিকার (Right to Work in Favorable Environment)। না খেয়ে, কম খেয়ে বা ভুল খাবার খেয়ে অথবা অস্বাস্থ্যকর নোংরা দ্রব্যাদি ব্যবহার করে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাবে নারী বঞ্চিত হয় স্বাস্থ্যের অধিকার (Right to Health) থেকে। বাধাগ্রস্থ-ক্ষতিগ্রস্ত-অস্বীকৃত হয় তাঁর ব্যাক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, নীরবে সব সহ্য করায় বা সহ্য করতে শেখানোর মাধ্যমে হরন করা হয় নারীর মতপ্রকাশের অধিকারকে ( Freedom of Expression)। ফলে, এই ক্রণিক বা সিস্টেমেটিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে সমাজে পোক্ত হয় জেন্ডার বৈষম্য। বেড়ে ওঠা কিশোরী মেয়েটার পায়ে, মাসিকের অসত্য ও অবৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে সাথে, প্রতিমুহুর্তে পরানো হয় অজস্র অদৃশ্য শিকল, ‘এটা ছেলেদের, ওটা মেয়েদের, এটা ভালো মেয়ের লক্ষণ, মেয়েদের একটু মেনে নিতে হয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি হাজার হাজার শিঁকল। ফলে মানুষ হয়ে জন্মানো আমাদের মেয়েরা প্রথাবদ্ধ চিন্তায় আবদ্ধ সমাজের অটোসাজেসন পেয়ে পেয়ে, অবশেষে, কেবল ‘মেয়ে’ই হয়ে ওঠে।

এই অবস্থার নিরসনে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা আছে বটে। কিন্তু শেষাবধি দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধেই বর্তায় । কারন সকল মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, সেগুলি সংরক্ষণ করা এবং তা পূরণ করা রাষ্ট্রেরই আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব। আশার কথা হচ্ছে, দেরিতে এবং ধীরে হলেও, আমাদের রাষ্ট্র মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে এগিয়ে আসছে। যার অন্যতম একটা প্রমাণ হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত ২৩শে জুন ২০১৫ তারিখের একটি পরিপত্র।

পরিপত্রে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের মাসিকের সময়ের বিদ্যমান সমস্যাকে চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিপত্রে স্বীকার করা হয়েছে যে,

১। গড়ে ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্যে ১ টা টয়লেট আছে,

২। সেগুলির শতকরা ৮৭ ভাগ বন্ধ থাকে

৩। শতকরা ৭০ ভাগে পানি ও সাবানের ব্যবস্থা নেই

৪। টয়লেট না থাকা বা টয়লেটের অব্যবস্থাপনার কারনে মাসিকের সময় মেয়েরা স্কুলে আসে না

৫। ফলে ক্লাসে ৮০ পার্সেন্ট উপস্থিতি না থাকায় মেয়েরা উপ-বত্তি থেকে বঞ্চিত হয়।

এই অবস্থার পরিবর্তন করতে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহন করেছে যাদের অন্যতম হলো মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কারিগরি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে,

১। ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকতে হবে

২। টয়লেটে ঢাকনা যুক্ত পাত্র থাকতে হবে (মাসিকের ন্যাপকিন ফেলার জন্য)

৩। মাসিক নিয়ে কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষিকা থাকতে হবে (অর্থাৎ একজন অন্তত শিক্ষিকা ছাত্রীদের সাথে মাসিক নিয়ে কথা বলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন)

৪। স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখতে হবে (প্রয়োজনে যেন ছাত্রীরা তা কিনতে বা সংগ্রহ করতে পারে)

এই পরিপত্রের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সাহায্য করা উচিৎ। সেক্ষেত্রে কমদামী স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা বা পুনঃচক্রায়ন, তদারকি, ব্যয়নির্বাহ, দায়-দায়িত্ব নিরুপণ ও দায়িত্বপালনে অবহেলার পরিণাম ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করা দরকার । আপাতত এই পরিপত্রের বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার ; যেন আমাদের মেয়েরা জানতে পারে তাঁদের মাসিকের সময় নিজ নিজ স্কুলের কাছে তাদের কী কী অধিকার আছে। অধিকার না পেলে তাঁরা যেন তা আদায় করে নেওয়ার মতো আওয়াজ তুলতে পারে সেটাও তাঁদের জানানো দরকার। মনে রাখতে হবে, কোনটা আমার অধিকার তা যদি আমি না জানি এবং তা যদি আমি দাবি না করি তাহলে আমার অধিকার আদায়ের পথ কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হবে।