ফারদিন ফেরদৌস:
“তোমারই ঝর্ণাতলার নির্জনে মাটির এই কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন ক্ষণে!”
সাংবাদিক রাজু আলাউদ্দিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কেদারা-ছায়ানট রাগ ও দাদরা তালের এই গানটির কথা বলেছিলেন সনজীদা খাতুন। আজ তিনি কেমন করে যেন মহাকালের নির্জনে মাটির এই জীবন ছাপিয়ে চলে গেলেন!
বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, সংগীতজ্ঞ, ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি প্রফেসর ড. সনজীদা খাতুনের প্রয়াণে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও শোক জানাই। বিশুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি এই গৌড়জনকে আপন করে রাখবে। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে স্মরণ করবে কাল থেকে কালান্তরে।
৯২ বছরের দীর্ঘ জীবন তিনি কাটিয়ে গেছেন বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণকে বেগবান করতে। ছায়ানটের সঙ্গে তাঁর যে আত্মিক বন্ধন, তা তাঁর জীবনকেই ছাপিয়ে উঠেছে। তিনি প্রথম আলোর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—
“এখন আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছায়ানট। ছায়ানটে শিশুদের স্কুলটা অভিনব। সেটা নিয়ে আমি খুব গর্বিত। আমি সে স্কুলের শিক্ষকদের পড়াই। তা ছাড়াও আমরা অনেকগুলো উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন ভাষার আলাপ, সাহিত্যপাঠ, ‘সুরের জাদু, রঙের জাদু’ নামে অটিস্টিক শিশুদের জন্য ক্লাস, ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামে পত্রিকা প্রকাশ, দেশঘরের গান, লোকসংগীত, শুদ্ধসংগীত, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত ও নৃত্য উৎসবের আয়োজন।”
ছায়ানটের সঙ্গে সনজীদা খাতুনের পথচলা শুরু ১৯৬৩ সালে, যখন তিনি বাংলা একাডেমির বারান্দায় সংগীত শেখানোর ক্লাস চালু করেন। এরপর ধীরে ধীরে তা ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনে রূপ নেয়। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবও তাঁর হাত ধরে শুরু হয় ১৯৬৭ সালে।
তিনি বলেছিলেন—
“পয়লা বৈশাখটা আমাদের সংস্কৃতিগতভাবে জাতিকে সচেতন করার একটা অনুষ্ঠান। প্রথমদিকে খুব কম লোক হতো। কিন্তু যারা আসত, তারা আন্তরিকভাবে আসত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গান করতে করতেই আমরা বুঝে গেছি, সংস্কৃতিটা রাজনীতিনিরপেক্ষ নয়। সংস্কৃতি এক বিশাল আন্দোলন, ঠিক যেমন রাজনীতিও এক আন্দোলন।”
সনজীদা খাতুন সরাসরি রাজনীতি করেননি, কিন্তু সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের মানবিক চেতনা ও স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার এক প্রতিবাদ সভায় ভাষা শহীদদের জন্য বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন—
“একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা দিয়ে মানুষের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছেন। পরবর্তীকালে ছায়ানট ছাড়াও জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা বিদ্যালয় ও কণ্ঠশীলনের মতো সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অনেকেই অভিযোগ করেন, সনজীদা খাতুন প্রাকৃতজনের শেকড়সন্ধানী সংস্কৃতি নিয়ে কাজ না করে অভিজাত সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার করেছেন। তবে এ কথাও সত্য যে, সংস্কৃতির রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রক মূলত শহরের অভিজাত শ্রেণিই হয়ে থাকে। রাজধানীর মানুষকে সংস্কৃতি সচেতন করা মানেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিপরীত অবস্থান নয়; বরং শহুরে অভিজাতদের শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার সুফল শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মধ্যেও পৌঁছায়।
সনজীদা খাতুন একাধারে সংগীতজ্ঞ, গবেষক ও শিক্ষক ছিলেন। তিনি শুধু ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাই নন, তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন—
“ছায়ানট শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চর্চার একটি কেন্দ্র। ৫৮ বছর ধরে ছায়ানট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের সবাইকে সঞ্জীবিত করে চলেছে।”
এবারের পহেলা বৈশাখেও প্রভাতসূর্যের স্পর্শ মেখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের সংগীতায়োজনে নতুন বছর শুরু হবে। কিন্তু তাঁর মধ্যমনি সনজীদা খাতুন সেখানে থাকবেন না। তবে তাঁর দিকনির্দেশনা, দিশা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভাবনা আমাদের পথ দেখিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
“কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী
আজি ভরা বাদরে।
ঘন ঘন গুরু গুরু গরজিছে,
ঝরো ঝরো নামে দিকে দিগন্তে জলধারা–
মন ছুটে শূন্যে শূন্যে অনন্তে অশান্ত বাতাসে।”
রবী ঠাকুরের প্রকৃতিপর্বের মল্লার রাগের এই গানটির কথা সনজীদা খাতুন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলতেন। এখন ভরা বাদর নয়, বসন্ত। তবু আজ অশান্ত বাতাসে দিক দিগন্তে যেন শোকের এক জলধারাই ঝরছে।
লেখক: সাংবাদিক
২৫ মার্চ ২০২৫
তথ্যসূত্র:
১. দৈনিক প্রথম আলো
২. দ্য ডেইলি স্টার
৩. ‘স্বাধীনতার অভিযাত্রায়’ গ্রন্থের ‘বাঙালি অন্তরের নববর্ষ’ নিবন্ধ
৪. ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘সন্জীদা খাতুন সম্মাননা স্মারক: বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে’ গ্রন্থে প্রকাশিত ‘একজন সনজীদা খাতুন’ -শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ/ মতিউর রহমান