নাজনীন মুন্নী:
বেড়াতে যেতে চাই,বেড়াতে যেতে চাই, তিন মাস ধরে খই এর মতো ফুটতেছি। এই অবস্থা অবশ্য পুরো বছর জুড়েই থাকে। কিন্তু জ্যোৎস্না, ঠাণ্ডা, এইসব বিশেষ বিশেষ সময়ে যেমন পাগলের পাগলামি বাড়ে, আমারও বর্তমানে সেই অবস্থা চলছে।
গত তিন মাস ধরে এই পাগলামি চরমে। অফিসে একটি মাত্র পাগলা বন্ধু আছে। তারে বললাম, দোস্ত ঘুরতে নিয়া চল। সে আমারে কইলো, পেট লাথি দিস না মা। তোরে নিয়া ঘুরতে গেলে অফিসের ক্ষমতাবানরা যে আমার ক্যারিয়ার শেষ করবে তা না, চাকরি নিয়া টান পড়ে যাবে।

আমাকে তার পেটে লাথি দেয়ার বিন্দু পরিমাণ সময় না দিয়া দেখি, নানা জায়গায় তার বেড়ানোর ছবি ঝোলে। তার কাছে ছ্যাঁকা খেয়ে অফিসের বাইরে গেলাম। দুইখান বন্ধু সেখানে। একটা ব্যাংকার, একটা বিমানে কাজ করে। এবার ভাবলাম, একটা ছুটলে একটি লাগবে।
বিমানের বান্ধবী তৎক্ষণাৎ রাজী। “দোস্ত কেবল একটা মাস সময় দে, ছেলের পরীক্ষা শেষ হোক। তারপর দুজন বিন্দাস। সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর,বান্দরবন, সুন্দরবন, যেখানে যেতে চাস। আশায় বুক বাঁধার পাশাপাশি ব্যাংকার ধরলাম। চল দোস্ত, একটা শর্ট ট্রিপ দিয়া আসি। সেও নাচলো। রাজী, রাজী। আমি এই প্ল্যান করি, সেই প্ল্যান করি। তার একদিন বোর্ড মিটিং, একদিন প্রজেক্ট, একদিন বোনের মেয়ের অসুখ, একদিন চাকরি যায় যায়। এই দেখে আমার অবস্থাও তখন যায় যায়।
এমন অবস্থায় সে আমারে এক সন্ধ্যায় বললো, “কাল বেড়াতে যাই”..তোমাকে পরে নিয়া যাবো!” প্রবল এক ছ্যাঁকা খেয়ে বিমান বাংলাদেশ এর কাছে ফিরলাম। ‘দোস্ত ছেলের পরীক্ষা তো শেষ। চল এবার’। বান্ধবী বললো, ‘দোস্ত জামাই তো ইউএস যাবে। তার লাগেজ গুছাইতে হবে। তাকে প্যান্ট পরাইয়া না দিলে বিমানে কেমনে উঠবে, এমন এক স্বর এনে বললো, পরে যাই’?
প্রবল ধৈর্য্য দেখাইয়া বললাম, আচ্ছা, তাইলে চল মাওয়া থেকে ঘুরে আসি। সে বললো, চল চল। পরের দিন কোন জামা পরে যাবো যখন ঠিক করছি, অন্য মাধ্যমে খবর পাই, বান্ধবী যেতে পারবে না, ভাই-ভাবী আসছে। ঢাকায় বসবাসকারী প্রায় প্রতি সপ্তাহে দেখা হওয়া ভাই-ভাবীকে মা’র কাছে রেখে বান্ধবীর সাথে বেড়াতে যাওয়া অসম্ভব হয়ে গেলো তার কাছে। কোনোভাবেই কিছুতেই সময় বের করতে না পারা প্রবল পারিবারিক সেই বান্ধবী দেখি ব্যাংকক এর চেক ইন অন্য বান্ধবীর সাথে।
এমন হতাশ যে মনে হলো, বন্ধু-বান্ধব আসলে সব নামকা ওয়াস্তে। কাউকে দরকার নাই, সবাইকে দেখিয়ে দেবো, এমন এক ভাব নিয়া আবার অফিস ফিরলাম। গুড়াগাড়া সব কিছুতেই দারুণ অানন্দ খোঁজা ২/৩ টাকে বের করলাম খুঁজে। ‘চল ঘুরতে যাই’। এইবার ছেলেমেয়ের কম্বিনেশন। ফেল হওয়ার আশংকা ১০%। সবাই নাচলো, কাছকাছি না। ৩/৪ দিন থাকবো, এমন জায়গায় চলো। আমার চেহারা ফুটে বের হতে চাওয়া খুশি আমি আটকে রাখি। যথাসম্ভব বড় আপার মতো চেহারা বের করে বলি, ঠিক আছে।
গন্তব্য সিলেট। মোট ১০ জন। হোটেল ঠিক হলো। বিছানাকান্দি। রাতারগুল। হাওড় এ রাত থাকা হবে কী হবে না, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। এর মাঝে মন পড়ে থাকে ব্যাংকার বান্ধবীর কাছে। আহা তারেও নেই। সবাই তো আমাকে ছাড়াই ভাবে। আমিই শালা পারলাম না। অফিসের বাইরে ব্যাংকারের নামটাও যোগ হলো। দিন এগোয়। আমার মনে লাড্ডু ফুটতে থাকে। একটা না, পটকার মতো অনেকগুলা একসাথে।
কোনো খোলা জায়গায় যেয়ে দুহাত ছড়িয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিতে চাই। স্বপ্ন যখন প্রায় বাস্তব- বাস এ যাবো? না ট্রেন? নাকি নিজেরাই গাড়ি নেবো, হিসাব করতে যেয়ে সঙ্গীদের মনে হলো, টাকা তো অনেক লাগে ঘুরতে। অত:পর বেড়াতে যাওয়ার একদিন আগে জানা গেলো, আমরা যাচ্ছি না। অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়, আমি পিরামিড এ চাপা পড়া মমি হয়ে গেলাম।
এই সকল কষ্টের কাহিনী বলার জন্য যখন প্রেমিক পুরুষ খুঁজতেছি। প্রবল আশা নিয়া ভাবতেছি, এইসব প্রতারণার খবর শুনে ফিল্মী হিরোর মতো সে বলবে, কারো দরকার নেই, আমিই তোমাকে শীত দেখাবো। খবর নিয়া দেখি, সেও বেড়াতে গেছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
শেয়ার করুন: