বাংলাদেশ: নারীর অধিকারের হালচিত্র

মহুয়া লেয়া ফলিয়া:

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স ২০২৪ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বৈশ্বিক র‍্যাংকিং এ ৯৯তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে প্রথম স্থানে আছে। পাশাপাশি দেশে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)’র প্রবৃদ্ধি রেখা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখিতে আছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত, অথচ রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির ভিড়ে এদেশের নারীদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এখন ভীষণভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে ২০২৫ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার ৪০১ জন, ২০২৫ জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার ৩৯ জন, এবং ২০২৫ ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার ৪৮ জন। ধর্ষণ আর যৌন সন্ত্রাসের সংবাদে আমাদের কান, আমাদের মন প্রতিদিন ভারী হয়ে উঠছে। পত্রিকার খবর সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের প্রতিদিনকার খবরে এটা সুস্পষ্ট – ছোট এই ভূখণ্ডটি এখন ধর্ষণের চারণভূমি, যেখানে নারীরা ও শিশুরা পথে, ঘরে ও বাইরে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ।

রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলা একচ্ছত্র ক্ষমতার বদল হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আসছে, এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত তরুণদের সমন্বয়ে নুতন রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে, তাঁরা অনেক স্বপ্নের কথা, সম্ভাবনার কথা, সংস্কারের কথা শোনাচ্ছেন আমাদের, দেশের নাগরিকগণও বৈষম্যহীন এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে।

কিন্তু আমাদের দিন কি সত্যি সত্যি বদলেছে, যেমনটি বদল হবার কথা, অন্তত যৌনসন্ত্রাস, নারীর প্রতি নিপীড়ন বন্ধের প্রশ্নে? আমরা কি বলতে পারবো নারী বিদ্বেষ, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের সামাজিক ও আইনগত দৃশ্যপট বা পরিস্থিতি পাল্টেছে ইতিবাচকভাবে? বাংলাদেশের নারীদের নিরাপত্তাবোধ, মুক্তমানুষ হয়ে চলাফেরার স্বাধীনতা কি বিস্তৃত হয়েছে নাকি আরও সংকুচিত হয়েছে?

আসুন প্রশ্ন করি কেন ধর্ষণ, নারী বিদ্বেষ ও নারী নির্যাতনের উৎসব শুরু হলো?

এই দায় শুধুমাত্র ধর্ষকদের নয়। এই দায় সমগ্র রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন সহ প্রশানিক সকল প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিকভাবে আমাদের সকলের। আর তাই আশংকাজনকভাবে বাড়তে থাকা ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মুলে যেসকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্ত্বাত্তিক কারণ আছে সেগুলো বিশ্লেষণ করা এখন সময়ের দাবি। বিগত সকল রাজনৈতিক সরকারের মত অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিলেই হবে না, বরং যে বা যারাই নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াবে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি এই সরকারের জন্য, কারণ এই সরকার গঠনের পিছনের মুল প্রণোদনাই ছিল সামগ্রিক সংস্কার। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে আমরা দেখতে পাই – নারীর প্রতি নেতিবাচক ও অসম্মানজনক বিভিন্ন রিলস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোরাঘুরি করে, এটা কি শুধুই ভিউ বাড়ানোর জন্য, নাকি আমাদের সমাজের মানসিক গঠনটাই এমন?

শুধু তাই নয়, কোন কোন ওয়াজে অসম্ভব আপত্তিজনক শব্দ ও রগরগে যৌন উত্তেজক শব্দাবলী ব্যবহার করে নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়-তাতে কিশোর, যুব পুরুষদের কাছে কী বার্তা পৌঁছায় সেটা ভেবে দেখার বিষয়, এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রশাসন কাজ করছে বলে এই মুহূর্তে দাবি করতে পারছি না। একটা দেশের সকল স্তরে এমন উগ্র নারী বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ায় সেই সমাজে ধর্ষণ, নির্যাতন, যৌন নিগ্রহ, সম্মিলিতভাবে নারী ও কিশোরীদের অপদস্থ করার মতোন আচরণ ও চর্চাগুলো নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, ফলে এটা কোন অপরাধ নয় এমন একটি সামগ্রিক বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে নাগরিকের কাছে, আর এর সুফল ভোগ করছে পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ ও এই আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান (সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়), ও পরিবার। এমতাবস্থায় কিশোর, যুবসহ সব শ্রেণি, পেশা, ও বয়সের আমজনতা কোন মনস্তত্ত্ব নিয়ে দেশের উন্নয়নের অংশীদার হবে, সেটা ভেবে দেখা ভীষণ দরকার। এদেশের অর্ধেক নাগরিক নারী, তাদের সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র আরও যত্নশীল হবে বলে আমাদের চাওয়া ও এতদসংক্রান্ত সুপারিশ হল

১) রাষ্ট্র শুধু প্রতিশ্রুতি বা কর্তা ব্যক্তিদের বক্তব্যে নয়, বরং প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে, ধর্ষণসহ সকল ধরনের যৌন সন্ত্রাস কঠোর হাতে দমনের জন্য তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে আইনে উল্লিখিত সময়ের আগেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ধর্ষণের বিচার নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করা।

২) শুধু তাই নয়, যারা রাষ্ট্র পরিচালনায়, প্রশাসনে, বা আইনের রক্ষাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, প্রত্যাশা করি তাঁরা তাদের বক্তব্যে আরও দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল হবেন। গত ১৫ মার্চ ২০২৫ তারিখের প্রায় সকল পত্রিকায় আমরা দেখেছি ডিএমপি কমিশনার সাহেব একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ করেছেন ‘ধর্ষণ’ শব্দটি না বলে বরং ‘নারী নিপীড়ন’ বলার জন্য । কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাস্য, ধর্ষণের মত জঘন্য একটি অপরাধ কেন বিকল্প শব্দ ব্যবহার করে উচ্চারণ করতে হবে? দয়া করে শব্দের রাজনীতি দিয়ে অপরাধের ভয়াবহতা কমিয়ে দেবেন না, কারণ ধর্ষণ একটি ফৌজদারি অপরাধ। তাই ধর্ষণ এর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকা বাঞ্ছনীয়।

৩) আহবান জানাই পরিবারের সদস্যদের, পরিবারের মধ্যে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করুন যেখানে একটি শিশু নির্দ্বিধায় তার আপনজনকে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারবে। সন্তানদের সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে হবে। তারা যদি না–ই জানে বিকৃত যৌনাচার কী, তাদের ঝুঁকি কী, কীভাবে তারা এর শিকার হতে পারে, তাহলে তারা নিজেদের রক্ষা করবে কীভাবে? প্রয়োজন সমন্বিত সামাজিক সচেতনতামুলক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে শিশুদের যৌন নির্যাতন বিষয়ে জানান খুব জরুরি, অনেকে বলতে পারেন শিশুদের কেন আমরা যৌনতা সম্পর্কে জানাবো বা পড়াবো? উত্তর সহজ, মাগুরার ঘটনায় ধর্ষক কিন্তু ভেবে দেখেনি সে একজন শিশু, তাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই এই শিশুদের অন্ধকারে রেখে করা সম্ভব নয়।

৪) ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন এমন একটি ব্যাধি, যেটি শুধু আদালত কিংবা পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন, বহুমুখী উদ্যোগ, যেমন আইনের সংস্কার ও যথাযথ প্রয়োগ, সংবেদনশীল দায়িত্বপ্রাপ্ত মানব সম্পদ, অপরাধীদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী সাজার ব্যবস্থা, নারী নির্যাতনকারীদের প্রতি শুন্য সহনশীলতাসহ যূথবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন এবং সামাজিক গণ সচেতনতা।

৫) জরুরি হলো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি, নারীর অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে আদর্শিক দৃষ্টিকোণ প্রমাণ করতে হবে স্ব-স্ব রাজনৈতিক দলের, এবং দলগুলো বিভিন্ন নারীর মানবাধিকারের সনদ অনুযায়ী লিঙ্গসমতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে কী উদ্যোগ নেবে এবং কীভাবে আইনের শাসন কায়েম করবে তা পরিস্কার করা।

আমরা জানি নষ্ট রাজনীতির যাঁতাকলে পরে এই দেশের আজকের এই বেহাল অবস্থা, তথাপি দেশের অর্ধেক নাগরিক যেখানে নারী তাদের অনিরাপদ রেখে রাষ্ট্রের কোন সংস্কারই কাজে আসবে না, বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে হয়তো বাংলাদেশের নাম আসবে, প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কিন্তু সেই উন্নয়ন কতখানি টেকসই হবে?

বিশ্বাস করতে চাই- রাষ্ট্র নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধে ঘটা সকল ধরনের যৌন সহিংসতাসহ অন্যান্য সহিংসতা রোধে প্রয়োজনীয় আইন, কানুন, নীতি যা এখনও নারীর অধিকার চর্চায় বাধাস্বরূপ সেগুলো সংস্কারের জন্য কাজ শুরু করবে। বিত্তের বিচারে নয়, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি, গোষ্ঠী বা পেশার বিচারে নয়, সাংবিধানিক দায় হিসেবে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবে।

লেখক: মহুয়া লেয়া ফলিয়া, মানবাধিকার কর্মী

শেয়ার করুন: