গানের মধ্য দিয়ে বিদায়: ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংযোগ

◾ফারদিন ফেরদৌস

রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সন্‌জীদা খাতুনকে তাঁর অনুরাগী ও শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্র সংগীতের মাধ্যমেই শেষ বিদায় জানিয়েছেন। জাতীয় সংগীত গেয়েছেন। এটি যেমন একজন শিল্পীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অনন্য দৃষ্টান্ত, তেমনই একটি উদার সাংস্কৃতিক চর্চার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই ঘটনাকে ঘিরে কিছু মানুষের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এটি কি কোনো ধর্মীয় রীতি? অথচ বিষয়টি অত্যন্ত সহজবোধ্য—সংস্কৃতি কেবল ধর্মের সীমানায় আবদ্ধ নয়, বরং ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সম্মিলনে গড়ে ওঠে। এমন ঘটনা নতুন নয়; বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং মুসলিমপ্রধান অনেক দেশেও গানের মাধ্যমে শোক প্রকাশের নজির আছে।

এখন দেখা যাক, মুসলিম প্রধান কোন কোন দেশে ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শোকগীত ও সংগীতের মাধ্যমে মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর রীতি প্রচলিত আছে।

১. মিশর:
মিশরে শোক প্রকাশের জন্য “মার্সিয়া” (Marsiya) বা “নউহা” (Nauha) নামে শোকগীতি গাওয়ার প্রচলন আছে। এটি সাধারণত আরবি ভাষায় হয়ে থাকে এবং মৃত ব্যক্তির স্মরণে বা শোক প্রকাশের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি বিশেষত শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত, তবে কিছু সুন্নি গোষ্ঠীর মধ্যেও ঐতিহ্যগতভাবে শোকসংগীত গাওয়ার রীতি রয়েছে।

২. ইরান:
ইরানে কারবালার স্মরণে “মার্সিয়া” ও “নউহা” গাওয়া হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শোকের অংশ। এছাড়াও, সুফি ঐতিহ্যে “মাওলানা রুমির” কবিতার মাধ্যমে শোক ও আত্মার শান্তির জন্য সংগীত পরিবেশিত হয়।

৩. তুরস্ক:
তুরস্কে সুফি সম্প্রদায়ের মধ্যে শোক ও বিদায়ের সময় “ইলাহি” (Ilahi) নামক ধর্মীয় সংগীত গাওয়ার প্রচলন আছে। এটি মূলত আল্লাহর প্রতি প্রার্থনা এবং মৃত ব্যক্তির আত্মার মাগফিরাত কামনার জন্য পরিবেশিত হয়।

৪. ইন্দোনেশিয়া:
ইন্দোনেশিয়ায় মৃত ব্যক্তির বিদায়ের সময় ধর্মীয় ও স্থানীয় ভাষার শোকগীতি গাওয়া হয়। “তালকিন” (Talqin) পাঠের পাশাপাশি স্থানীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী শোকসংগীত গাওয়ার চল রয়েছে, যা একদিকে ধর্মীয়, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক রীতি।

৫. মালয়েশিয়া:
এই দেশে ইসলাম ও স্থানীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণে ‘সালাওয়াত’ বা ‘নাশিদ’ ধরনের শোকসংগীত পরিবেশন করা হয়, যা প্রয়াতদের স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়।

৬. সেনেগাল:
সেনেগালের মুরিদিয়া সুফি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ ইসলামিক গানের মাধ্যমে মৃতদের স্মরণ করার রেওয়াজ আছে।

৭. কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান:
এই অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী ‘কুই’ বা ‘মার্সিয়ে’ ধরনের শোকসংগীত প্রয়াতদের স্মরণে পরিবেশিত হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই ঐতিহ্যগত তুর্কি ও ইসলামি সংস্কৃতির মিশ্রণ।

আমাদের পূর্বদেশ ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও শোকপ্রকাশে সংগীতের ব্যবহার বেশ প্রচলিত।

১. পাঞ্জাবি
শিয়া পাঞ্জাবিদের মধ্যে কারবালার স্মরণে “মার্সিয়া” ও “নউহা” গাওয়ার ঐতিহ্য আছে। এটি মূলত আরবি, উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায় পরিবেশিত হয়।

২. সিন্ধি
সিন্ধি সুফি ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। সিন্ধি দরগাহগুলোতে সুফি সাধকদের স্মরণে “কাওয়ালি” (Qawwali) গাওয়া হয়। শিয়া সিন্ধিদের মধ্যে মহররমের সময় শোকসংগীত গাওয়ার প্রচলনও রয়েছে।

৩. বেলুচ
বেলুচ সম্প্রদায়ের মধ্যে শোকপ্রকাশের জন্য “মাতাম” (Matam) নামে শোকসংগীত গাওয়া হয়। শিয়া বেলুচদের মধ্যে “নউহা” ও “মার্সিয়া” গাওয়ার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করা হয়।

৪. পশতুন
পশতুন ঐতিহ্যের মধ্যে শোকসংগীতের চেয়ে কবিতা বেশি জনপ্রিয়। শোক ও বেদনা প্রকাশের জন্য তারা “ল্যান্ডাই” (Landay) নামে ছোট ছন্দবদ্ধ কবিতা আবৃত্তি করে থাকে।

৫. হাজারা
হাজারারা শিয়া সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ায় কারবালার স্মরণে “মার্সিয়া” ও “নউহা” গেয়ে থাকেন।

৬. মাকরানি (আফ্রো-পাকিস্তানি সম্প্রদায়)
করাচির লিয়ারিতে বসবাসকারী মাকরানি সম্প্রদায়ের মধ্যে শোকসংগীত গাওয়ার প্রথা রয়েছে, যা আফ্রিকান সংস্কৃতির প্রভাব বহন করে। তারা ইসলামিক রীতির পাশাপাশি নিজেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী শোকগীতি পালন করে।

৭. কাশ্মিরি
শিয়া কাশ্মিরিদের মধ্যে কারবালার স্মরণে “নউহা” ও “মার্সিয়া” গাওয়ার প্রচলন আছে।

উপরোক্ত উদাহরণগুলো থেকে পরিষ্কার যে, মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতেও সংগীত ও শোকগীতি মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর স্বীকৃত উপায়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকে রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমেই বিদায় জানানো হলে আপত্তি কেন?

গান, কবিতা ও সাহিত্য কেবল ধর্মীয় সীমানায় আবদ্ধ নয়। এটি মানুষের অভিব্যক্তির অংশ, যা শোক, আনন্দ, প্রতিবাদ এবং ভালোবাসার মাধ্যম হতে পারে।
তাহলে এই বিদায়ের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের কি পাকিস্তানের কাওয়ালি কিংবা সুফি দরগাহের গানের আয়োজন নিয়েও আপত্তি থাকবে? সংস্কৃতি ও ধর্মকে এক করে দেখার প্রবণতা পরিহার করে উদারতার চর্চা করাই উচিত। একজন শিল্পী তাঁর শিল্পের মধ্য দিয়েই অমর হন। তাঁকে সম্মান জানাতে সেই শিল্পকেই মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত ও সংস্কৃতিগতভাবে স্বাভাবিক।

Funeral ritual discourse প্রত্যেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠি ভেদে ভিন্নতর হতে পারে। অপরদিকে গান এবং সংগীত মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিতে সংগীতের মাধ্যমে শোকপ্রকাশের রীতি প্রচলিত। রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীকে রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে বিদায় জানানো কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং এটি একজন শিল্পীর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতিফলন। সাংস্কৃতিক ঔদার্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তাই এ নিয়ে আলাদা বিতর্ক তৈরির কোনো কারণ থাকে না। রীতি, রেওয়াজ ও দেশজ বিধির অনুকূলে থেকে কারা কীভাবে শোক প্রকাশ করবে সেটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত অধিকার। অন্যের অধিকারকে আমরা যেন বারিত না করি।

লেখক: সাংবাদিক

শেয়ার করুন: