‘আমি পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের শিকার নই, আমি সুজেট জর্ডন’

Suzette Jordan
সুজেট জর্ডন

উইমেন চ্যাপ্টার: ‘আমি পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের শিকার নই, আমি সুজেট জর্ডন’–শুক্রবার তাঁর চলে যাওয়ার পর এই কথাটিই কানে বাজছে বার বার। যে সাহসী নারী পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই কাল যাত্রা শুরু করেছে অনন্তকালের পথে। কলকাতার একটি হাসপাতালে মেনিনগো-এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪০ বছর বয়সী জর্ডন।

সুজেট জর্ডনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হরিশ আয়ার নামের একজন লিখেছেন, ২০১২ সালে আলোড়ন তোলা পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলাকে ঘিরে আলোচনায় এসেছিলেন সুজেট। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তিনি তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করেছিলেন বিশ্বের সবার সামনে। ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে আরও ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় তিনি প্রতিবাদী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। তখন তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,

“আমি কেন আমার পরিচয় লুকিয়ে রাখবো, যখন এটা আমার কোন অন্যায় ছিল না? আমি কেন লজ্জাবোধ করবো কোনকিছুর জন্য, যা আমি করিইনি? আমি নৃশংসতার শিকার হয়েছিলাম, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম, ধর্ষণের শিকার হয়েছিলাম। আমি লড়াই করছি এবং তা চালিয়ে যাবো”।

হরিশ আয়ার লিখেছেন, ‘ধর্ষণ বিষয়ে থিংক কনফারেন্সের একটি প্যানেলে এক বছর আগে সুজেট ক্যাটরিনা জর্ডনের সাথে আমার পরিচয়। তাকে তখন বেশ আতংকিত মনে হচ্ছিল।  তিনি তখন টিভির সাথে কথা বলেন, কিন্তু এতো এতো মানুষ আর উচ্চপর্যায়ের লোকজনের সামনে এর আগে তিনি কখনও কথা বলেননি, তাও জানান জর্ডন। আমি তখন তার কাছে যাই এবং নিজেকে একজন সমকামি বলে পরিচয় দেই, বলি যে, তুমি চাইলে আমাকে ‘হাগ’ করতে পারো। জর্ডন তখন হেসেছিলেন, এবং বললেন, তিনি কিছুটা ভীত। আমি তখন বলি, কাকে তুমি ভয় করছো। তুমি একজন নির্যাতনের শিকার, আমিও তাই, হলভর্তি লোকজনও তাই। একথা শুনে জর্ডন একটা ধাক্কা পেলেন মনে, কিন্তু পরক্ষণেই হেসে উঠে বিষয়টা হালকা করে দিলেন।

সেদিন থেকে সুজেট বন্ধু হয়ে গেলেন আমাদের, আনুজা, রানাদীপ এবং ইয়ুধাজিতের। আমরা আমাদের জীবনের গল্প শেয়ার করলাম। নিজেদের কষ্টই আমাদেরকে এক করে দিল, এমনকি এই কষ্টগুলো নিয়ে একপর্যায়ে আমরা হাসাহাসিও করলাম। খুবই কঠিন সেইসময়।

আমাদের দেশে ধর্ষণ এবং শিশু যৌন নির্যাতনের কাহিনী বলা, নৃশংস হাস্য রসাত্মকের পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু আমরা এতে পরাজিত হইনি, বরং এটা আমাদের একত্রিত হতে সাহায্য করেছে। অতীত যেন কোনভাবেই আমাদের ওপর প্রভাব না ফেলে, সেই চেষ্টাই করে গেছি প্রতিনিয়ত। আবার আমরা পুরুষের বিপক্ষেও যাইনি। দিনশেষে আমরা পুরুষদের নিয়ে বিভিন্ন রসিকতা করেছি, যেমনটি করে কলেজপড়ুয়া যে কেউ।

সেদিনের কনফারেন্স শেষ হওয়ার পরও আমাদের যোগাযোগ ছিল, ফোনে কথা হতো। যখন তেহেলকা ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটলো, আমরা দুজনই তখন নির্যাতিতের কাছে পৌঁছেছিলাম। সুজেট তখন আমায় ফোন করে বললো, ‘তার সাথে যা ঘটতে যাচ্ছে তাহলো সে লজ্জিত হতে যাচ্ছে’। ওই মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে সুজেটের মধ্যে ধর্ষণ সম্পর্কে আতংক আবার দেখা দেয়। নির্ভয়া ধর্ষণের ঘটনায় সুজেটকে বাক্সবন্দী অবস্থা থেকে বের করে আনে, তখনই সে বলতে শেখে, ‘আমি পাকর্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের শিকার নই, আমি সুজেট জর্ডন’। তেহেলকা মামলা তাকে আবারও সব মনে করিয়ে দেয়।

সুজেট খুব ভালবাসতো তার মেয়েদের। সে চেয়েছিল মেয়েদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে, যদিও জানতো, এটা সহজ ছিল না। যখন সে অভিনেতা আমির খানের সত্যমেভ জয়তে  অনুষ্ঠানের শুটিংয়ের জন্য এসেছিল, তখন আমাদের আবার দেখা হওয়ার সুযোগ থাকলেও হয়নি। এজন্য সে আমাকে অভিশাপও দিয়েছিল। কারণ আমরা ছিলাম লাভ বার্ডের মতোন, কিছু সমুদ্র যা আমাদের আলাদা করে রেখেছিল।

আমাদের জীবনে অনেক ট্র্যাজেডিও ছিল। সুজেটকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত করে তার প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়েছে, তাই সে খুবই কষ্ট পেত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি খোদ তাকে রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ভাবমূর্তি ধ্বংস করতেই সুজেট এই মিথ্যা ধর্ষণের কাহিনী ফেঁদেছে। তাকে পতিতা বলা হয়েছিল, যার সাথে তার ছয় খদ্দের খারাপভাবে যৌনকর্ম করে চলে গেছে, এভাবেই বর্ণিত হয়েছিল ধর্ষণের ঘটনাটি। এখানেই থেমে থাকেনি। আদালতেও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন আইনজীবীরা, এমনকি নারী বিচারকও। তাকে ধর্ষণের বর্ণনা দিয়ে যেতে হয়েছে দিনের পর দিন। তাকে হয়তো গুলি করে মারা হতে পারে বা ধর্ষণ করা হবে ভেবেও সুজেট সংকল্পবদ্ধ ছিল লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।

সুজেট ছিল সত্যিকারের লড়িয়ে মেয়ে। কিন্তু লোকজন তার শক্তিকে পুঁজি করেছে। তারা ভুলে গিয়েছিল, সুজেট একজন মানুষ এবং তার কান্নার অধিকার আছে। সবসময় সে সাহসী থাকতে চায়নি। সে সবসময় সবার চালিকাশক্তি হতে চায়নি। সে ছিল সাধারণ একজন মানুষ। সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল যে ঘটনাটি তাহলো, ধর্ষণের সময় যে পোশাকে সে ছিল, এমনকি তার নিচের পোশাকও যখন সবার সামনে প্রদর্শন করা হয়। এবং তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যখন তাকে ‘তথাকথিত ধর্ষণ’ করা হয়েছিল, তখন এগুলো তিনি পরেছিলেন কিনা! এই কথায় প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েছিল সুজেট, নারী বিচারকের হস্তক্ষেপ চেয়েও তার নিষ্কৃতি মেলেনি সেদিন।

সুজেট বলতো, ‘আমি একবার গণধর্ষণের শিকার হয়েছি, আর আদালত আমাকে ধর্ষণ করেছে বার বার’। সুজেট আমাকে ধরে কাঁদতে চাইতো। কিন্তু আমি বার বারই হাসি দিয়ে তার কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছি। একবার তার আইনজীবী নিয়ে যখন সে খুবই বিমর্ষ, আমি তাকে হাসানোর জন্য বলি, ‘তোমার আইনজীবী কি হট’? তাকে স্বাভাবিক করতে প্রায়ই তাকে বলতাম, ‘হ্যালো, আমি কি একজন রেপ ভিক্টিমের সাথে কথা বলতে পারি?’ এভাবেই আমরা কথা শুরু করতাম হাসি দিয়ে, শেষ হতো কান্নায়।

সুজেটকে ধর্ষণ করেছিল কিছু বিকৃত মানসিকতার লোক। তাকে ধর্ষণ করেছিল এই দেশ। এই দেশের আইনী প্রক্রিয়া। যারাই তার ঘটনা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে, তারাই তাকে ধর্ষণ করেছে। অ্যাট জিঞ্জার নামে একটি রেস্টুরেন্টে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি ধর্ষণের শিকার বলে। এ নিয়ে তখন টুইটার-ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই রেস্টুরেন্টের কর্মীরা ছিল এই দেশের মানুষের মনোভাবের দর্পণ মাত্র। আমাদের জন্য ধর্ষণ একটা কারণ, আর এর শিকার একটা গল্প। ধর্ষণ এমন একটা বিষয় যা টিভিতে কারও সাথে হয়, অথবা তার সাথে ঘটে যার কথা নিউজে লেখা হয়। ধর্ষণ আমাদের বাড়িতে হয় না। আমরা এমনই একটা সমাজে-বিশ্বে বসবাস করি।

সুজেট মারা যায় শুক্রবার ভোররাত তিনটায়। বলা বাহুল্য, ভারত আসলে খুন করেছে সুজেটকে, নারী এবং ধর্ষণের শিকার কোনো নারীর প্রতি তাদের মনোভাব এবং মানসিকতা দিয়ে।

তার মৃত্যু হয় মেনিনজাইটিসে। এটাও আমরা জানি যে, যখন কাউকে হতাশায় পেয়ে বসে, তখন নানান অসুখও ঘর বাঁধে তার ভিতর। সবশেষে সে আমাকে শুনেছিল। আমি প্রায়ই বলতাম, কখনও কখনও নিজেকে দুর্বল ভাবাই যায়। লড়াইও থামানো যায়, আর নিজেকে ভালবাসা যায় নিজের মতো করেই। নিজের মতো থাকো।

সুজেট নিজের মধ্যেই থাকতে চেয়েছিল। তার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে, হৃৎপিণ্ডের কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। সে চলে গেছে।

সুজেট যদি সত্যিই ক্ষমতায়িত থাকতো, লোকজন যদি বিচার করা শুরু না করতো, আইনজীবীরা যদি আদালতে তার সাথে খারাপ ব্যবহার না করতো, নারী বিচারক যদি তার প্রতি সংবেদনশীল থাকতো, রেস্টুরেন্ট যদি তাকে বের করে না দিতো, তাহলে হয়তো সে বেঁচে যেত, অথবা মৃত্যুটা সুখের হতে পারতো।

ভারত সুজেটকে হত্যা করেছে, তুমি তাকে হত্যা করেছো। অনেককিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আমি চাই বিচার বিভাগের সংস্কার। কোন নারীই যাতে সুজেটের মতোন আদালতে হয়রানির শিকার না হয়, কেউ না।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.