লাভলী ইয়াসমিন জেবা: মানুষ ভয় পায়। বিভিন্ন কারণে মানুষ ভয় পায়। একেকজনের ভয় পাওয়ার কারণ বা ধরন একেক রকম। বয়সভেদেও ভয় ভিন্ন হতে পারে। একটি ছোট্ট তেলাপোকা হঠাৎ কারো গায়ে এসে পড়া থেকে রাতের অন্ধকারে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া- এমন অনেককিছুতেই আমাদের ভয়।
সাপের ফণা তোলা, বাঘের গর্জন, ভাদ্রমাসের কুকুরের তাড়া, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, রাত্রির অমানিশা এমনকি এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও আমরা ভূতের ভয় পাই। ভয় পাওয়ার এই অনুভূতি এবং কারণ নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই প্রায় একরকম হয় বা হয়ে থাকে।
কিন্তু এতোকিছুর পরও নারী আরো কিছু বিষয়ে কঠিন ভয় পায় যা তার সম্পূর্ণ সত্তাকে সঙ্কুচিত, কুণ্ঠিত, দ্বিধাগ্রস্ত করে রাখে। নারী ভয় পায় আমাদের সমাজের প্রচলিত বিধি-নিষেধ, প্রথা, কুসংস্কার, সনাতনী মূল্যবোধ আর সর্বোপরি তারই মতো মানুষের আরেক সত্তা পুরুষকে। কিন্তু কেন?
২০১৪ সালে বাংলাদেশের নারীর প্রতি সহিংসতার একটি চিত্র থেকে দেখা যায় যে, স্বামীর নির্যাতনের শিকার ৩৬ জন নারী এবং হত্যা ২৬২ জন। স্বামীর পরিবারের হাতে সহিংসতার শিকার ৯ জন এবং হত্যা ৭৯ জন। যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১২১ জন নারী, হত্যা ১৬৩ জন এবং একই কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। পারিবারিক কলহের কারণে ৮ জন, যৌতুকের কারণে ৫ জন নারী এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। যৌন সম্পর্কে প্রত্যাখ্যান, কন্যাসন্তান জন্মদান, ধর্ষণের চেষ্টায় বাধা প্রধান ছাড়াও নিত্যদিন ঘটে যাওয়া জানা অজানা আরো অনেক কারণে এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২২ জন নারী (সূত্র : আইন ও সালিশ কেন্দ্র, প্রথম আলো, যুগান্তর, ডেইলি স্টার, জনকণ্ঠ, সমকাল)।
পরিবারের কর্তা হিসেবে, সমাজের একজন ক্ষমতাবান মানুষ হিসেবে কোনো একজনকে ভাবতে গেলে আজো আমাদের বেশিরভাগের চোখে যেমন একজন পুরুষের ছবি ভেসে ওঠে, তেমনি উল্লিখিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে নির্যাতনকারী, হত্যাকারী হিসেবে যার ছবিটি প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তিনিও কোনো না কোনো পুরুষ- যাকে নারী ভয় পায়, বিশ্বাস করে না।
বিশ্বাস করেছিল ইয়াসমিন, সাহস দেখিয়েছিল দামিনি। কিন্তু তার মূল্য কেউ দেয়নি। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, ধর্ষিত হয়ে অতঃপর দুজনকেই প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো। এ ধরনের ঘটনায় কত ইয়াসমিন, সীমা, দামিনি, তৃষা প্রাণ দিয়েছে এবং দিচ্ছে আমরা তার হিসাবও জানি না।
তবু থেমে নেই নারীর পথচলা। শত অপমান, অবরোধ, নির্যাতন, বিপত্তির মধ্যেও যুগে যুগে সাহসী নারী এগিয়ে এসেছেন যা শুধু নারীকে নয় আলোকিত করেছে গোটা সমাজকে।
বেগম রোকেয়া জ্বালিয়েছেন নারী শিক্ষার আলো, ইলা মিত্র, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, জাহানারা ইমাম প্রমাণ করেছেন দেশ ও জাতির জন্য নারীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কবি সুফিয়া কামাল শিখিয়েছেন নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রতিবাদের ভাষা। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম সুদীর্ঘ হয় বলেই আজ থেকে ১৫৮ বছর আগে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ, নিউইয়র্কের সুচ কারখানার শ্রমিক নারীরা কর্মক্ষেত্রে শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই প্রতিবাদের সুর আজো বহমান। কারণ আজো পরিবার থেকে রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে নারী বঞ্চনা আর নিপীড়নের শিকার; যা তার মৌলিক চাহিদা অর্জন এবং মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ন করে।
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামের এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। এই দিনে নারী সমঅধিকারের স্বীকৃতি ও সব প্রকার বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এ দিন সব নারী অধিকার সংগঠন এবং বৃহত্তর সমাজের মধ্যে সহযোগিতা এবং অংশীদারীত্বমূলক মনোভাব গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। মানবতার আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ সব নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং নারী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে সবাই একই স্লোগানে কণ্ঠ মিলায়।
বাঙালির সব অর্জনের পথে এ দেশের নারী সমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা সব সময় ছিল এবং আজো আছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্যমান অন্যায়, অবিচার, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ন্যায্য অধিকার ও সমতার জন্য নারীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে।
‘নারীর ক্ষমতায়নই হোক মানবাধিকারের ভিত্তি’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকারিভাবে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ প্রণয়ন, ‘নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বিশেষ উদ্যোগ’, ‘প্রজনন স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য মা ও শিশু এবং কিশোরীদের জন্য নিবিড় স্বাস্থ্যসেবা’, ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি’ এর এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের সচেতন নারী সমাজের দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জাতীয় জীবনের সকল স্তরে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করা, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাসহ নারীকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলাই যার প্রধান লক্ষ্য।
পুরুষশাসিত সমাজের তৈরি ক্ষমতা-বলয়ের বাইরে থাকার কারণে একজন নারী নিপীড়িত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সারাটি জীবন কাটিয়ে দেয়। ক্ষমতাহীন হিসেবে পরিচিত বলে ক্ষমতাবানদের দ্বারা অন্যায়ভাবে বিভিন্ন রকমের বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হয়।
এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। নারীকে বাদ দিয়ে সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয় জেনেও এক শ্রেণীর ক্ষমতালোভী মানুষ নারী উন্নয়নের স্রোতধারাকে বারবার প্রতিহত করার হীন চেষ্টায় মত্ত হয়। যা ধ্বংস করে দিচ্ছে জাতীয় উন্নয়নের সম্ভাবনাময় প্রচেষ্টাগুলোকে। ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে প্রসারিত হয় দুর্নীতির কালো থাবা, বাড়ে নারীর প্রতি অন্যায় ও অবিচার যা সচেতন নারী সমাজকে বারবার দাঁড় করিয়ে দেয় আন্দোলনের মুখোমুখি। লক্ষ্য শুধু একটাই, ‘মানবতার উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন’।
‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বুঝার জন্য কোন ব্যাকরণিক সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই। ‘আমার কথা আমি বলবো, নিজের মতো গড়ে উঠবো’- নারীর এই আত্মোপলব্ধিই তাকে পৌঁছে দেবে অনেকদূর। যেখানে ব্যক্তিগত, সামাজিক বা পেশাগত জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী সক্ষমতার পরিচয় দেবে। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয়, সংকোচ কাটিয়ে আত্মশক্তিতে বলিয়ান নারী ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই নীতিতে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যাবে উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিকে। সমমর্যদা, সমঅধিকার অর্জনের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা দেড়শ বছরের অধিক সময়ের আন্দোলন সফল করতে এবং বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি বিরাজমান সব প্রকার সহিংসতা দূর করতে আজকে নারী একসঙ্গে প্রতিশ্রুতির সুর তুলবে-
‘মুক্ত করো ভয়। আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী।