নি:শব্দতারও শব্দ আছে, কিন্তু নারীর?

Zana
ফারজানা শাম্মী

ফারজানা শাম্মী: দেশ থেকে ফিরেছি সপ্তাহ খানেক হলো। কানাডার হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা তাই যেন বড্ড বেশি  অসহনীয়।

আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি ” ভয়েসেস  অফ  সাইলেন্স” এর কাজে প্রতি বছর একবার বাংলাদেশে যাওয়া হয় আমার। সেই সুবাদে মা’র কাছে থেকে আসার সুযোগটাও পেয়ে যাই।

দেশে গেলেই বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি – দেখা না হলেও যেন অন্তত ফোনে কথা হয়। অপ্রত্যাশিতভাবেই আমার খুব কাছের এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হলো ২৫ বছর পর। মূহূর্তে যেন ফিরে গেলাম আমার কৈশোরে। কি ভীষণ প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা একেকটা মেয়ে আমরা তখন – দুচোখে পৃথিবীকে জয় করার স্বপ্ন। তখনও সমাজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি ” তুমি মেয়ে “। তখনও বুঝতে  শিখিনি, মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়াই মেয়েদের জীবন।

২৫ বছর পেরিয়ে আজ আমরা কেমন আছি ?- যখন দুই বন্ধু মেতে উঠেছি এই গল্পে – তখনও একটুও বুঝতে পারিনি এই প্রানবন্ত হাসির আড়ালে কি ভীষণ দুঃসহ জীবন আমার বন্ধুটির।  কানাডায় থাকি আমি, ফিল্মমেকার, নারী নির্যাতন নিয়ে ডকুমেন্টারী বানাচ্ছি জেনে হেসে বলল, “তোর ফিল্ম এ আমাকে নেয়া যায় না?”

আমি হাসতে হাসতেই উত্তর দিলাম, “নাহ রে! আমার ফিল্ম তো নির্যাতিত নারীদের কথা – তাদের না বলা গল্প।” হটাৎ করেই আমার বন্ধুটির হাসিটি যেন ম্লান হয়ে গেল, নাকি আমি ভুল বুঝলাম! বিদায় বেলায় শুধু বলল, “ফোন করিস কথা আছে।”

বাংলাদেশে আমার জন্ম। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজেই আমার বেড়ে উঠা। আমার বাবাকে কখনো আমি আমার মাকে অসম্মান করে কথা বলতে শুনিনি কিংবা মায়ের  সাথে এমন কোনো আচরণ করতে দেখিনি, যা অসম্মানজনক।  স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর নির্ভরতার, আমি এটাই জেনেছি – শিখেছি।

তাই স্কুলের বন্ধু রুমানা মনজুর এর ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীর নির্যাতন মেনে নিয়ে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় আমার বোধের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। আমার ভীষণ রাগ হয়… আমি দুঃসহ যন্ত্রণায় ছটফট করি – কেন মেনে নিলে রুমানা? কেনো কাউকে বলোনি? যে সমাজ আমাকে প্রতিবাদী হতে শিখিয়েছে – অধিকারের জন্য লড়াই করতে শিখিয়েছে, সে সমাজে রুমানা কেনো প্রতিবাদ করতে পারেনি – এই ভাবনা আমাকে দিনের পর দিন তাড়িত করে ফেরে। তাহলে কেমন আছে আমার অন্য সব বন্ধুরা?

সেই ভাবনা থেকেই “ভয়েসেস অফ সাইলেন্স” এর কাজ শুরু। আমার এই ডকুমেন্টারি হবে হাজারও রুমানা’র কন্ঠস্বর। সিদ্ধান্ত নেই এর মাধ্যমেই আমি সচেতনতা তৈরি করব।

আমাদের সমাজে সব দোষ মেয়েদের – ঘটনা যাই হোক না কেন ! রুমানা অন্ধ হয়েও রেহাই পায়নি অপবাদ থেকে। ও বলেছিল আমাকে, ওকে কি এই সমাজ ছেড়ে দিত যদি ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করত – ও যদি সমাজকে তুচ্ছ করে নিজের কথা ভেবে বের হয়ে আসত, তাহলে এই সমাজ কি ওকে মেনে নিত? অপবাদ -অপমানে জর্জরিত করতো না!!!

হায়রে সমাজ!!!

লেখার শুরুতে যে বন্ধুটির কথা বলেছিলাম তার কথায় ফিরে আসি। সামাজিক কারণেই তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ ছিল বন্ধুটির, তাই প্রকাশ করছি না। এক  মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে ১৫ বছরের সংসার – দুজনেই ডাক্তার।  তথাকথিত সুখী সংসার ! অন্তত ফেসবুক এর ছবি তাই বলে। সেই ডাক্তার স্বামী এবং তার বাবা-মা কি ভীষণ অসন্তুষ্টই না হয়েছিলেন যখন তাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হলো। ছেলে না হলে আরেকটা বিয়ে করবে বলে হুমকিও দিয়েছিলেন ডাক্তার সাহেব আমার বন্ধুটিকে। নানারকম মানসিক নির্যাতন- অপমান, অবহেলা চলত প্রতিনিয়ত। হয়ত ছেলে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে এই ভাবনায় আমার বন্ধুটি আবার মা হলো – ভাগ্যিস এ যাত্রা ছেলে ! কিন্তু ছেলের কারণে মায়ের কদর এতটুকুও বাড়েনি সেই সংসারে। বরং নির্যাতনের মাত্রা মানসিক থেকে শারীরিক এ পৌঁছেছে।

তবু কেন আছিস ? – অসহায় আর্তনাদে জানতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম আমার সাথে খুশি আপার (খুশি কবির) কাছে চল। রাজি হয়নি। সবাই ওকে দোষ দিবে – আঙ্গুল তুলে দেখাবে – অপবাদ দিবে – এসব সহ্য করতে পারবে না ও। এর চেয়ে এই ভালো, কেউ তো জানে না দিন শেষে ঘরে ফিরে ও কেমন আছে!

রুমানা কিংবা আমার এই বন্ধুটি শুধু নয়, ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।

যে ঘর হওয়ার কথা ভালবাসায় ঘেরা নিরাপদ আশ্রয় – সেই ঘরেই নারী লাঞ্ছিত হয়, অপমানিত হয়, সেই ঘরেই হয় নির্যাতিত। তবু লোক-লজ্জার ভয়ে সমাজের ভয়ে মুখ বুঁজে সে সংসার আগলে রাখে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে।  এই ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়ে কি শিখবে?

এ সমাজ আমাদের – সমাজ পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে নারী – পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সবাইকেই। অনেক পুরনো কথা, অনেকটা প্রবাদের মতোই শোনায়। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম #‎MAKEITHAPPEN । কিন্তু আমরা  কি প্রস্তুত নারীকে তার যথাযোগ্য মর্যাদা, স্বাধীনতা, সুস্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা দিতে?

ফারজানা শাম্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.