লুতফুল হোসেন: জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী যে হয়েছে, সে প্রাপ্তবয়স্ক । আর যে হয়নি সে অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ সরল সংজ্ঞাটি সকল প্রাণীকূলের জন্য প্রযোজ্য । যদি মানুষের ক্ষেত্রে এটিকে বিবেচনা করতে চাই তাহলে আরো দুটি প্রেক্ষিতকে বিবেচনার বৃত্তে সম্পৃক্ত করতে হবে । তা হলো সামাজিক এবং আইনগত প্রেক্ষিত ।
আইনগত প্রেক্ষিত বলতে সহজ ভাষায় প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়া মানে হলো চুক্তি সম্পাদনের আইনগত অধিকার অর্জন করা । যতদিন পর্যন্ত এ অধিকার কারো পিতা-মাতা বা অভিভাবকের উপর বর্তাবে ততোদিন সে থাকবে অপ্রাপ্তবয়স্ক । ব্যাংক একাউন্ট খোলা, জমি-জমা কেনা-বেচার দলিল সম্পাদন করা, বাড়ী ভাড়া বা এমন যে কোনো চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করবার যোগ্যতা এর পরিচায়ক বা মাপকাঠির দর্পণ বলা যায় ।
সামাজিক প্রেক্ষিত মানে ধরা যায় তার বিয়ে করার আইনগত অধিকার, অস্ত্র কেনার বা ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহণের অধিকার । সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ভোটের অধিকার অর্জন করা । বিয়ে বিষয়ে ১৯৬২ সালে “কনভেনশন অন কনসেন্ট টু ম্যারেজ” এর মাধ্যমে বাল্য বিবাহ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক বিয়ে রোধ করবার উদ্দেশ্যে বিয়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক বিবেচিত হবার বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম বয়স নির্ধারিত হয় ১৮ বছর ।

তবে পাশাপাশি আরো বলা হয় যে, প্রতিটি ভূখণ্ডের নিজস্ব নিয়ম বা আইন এর জন্য চূড়ান্ত প্রযোজ্য মানদণ্ড বিবেচিত হবে । ফলত এক অদ্ভুত বিপ্রতীপ চিত্র আমরা দেখতে পাই দেশে দেশে । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উন্নত ও নারী-পুরুষ মেলামেশায় উদার মানসিকতা সম্পন্ন সব দেশে বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরের নীচে বিবেচনা করা হয় না । অথচ নারী-পুরুষ মেলামেশায় কট্টরপন্থী এবং অনুন্নত কয়েকটি এশীয় মধ্যপ্রাচ্যের এবং আফ্রিকান দেশে আর সেই সাথে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা কয়েকটি ল্যাটিন দেশে ১৮ এর নীচে বিয়ে আইন সম্মত বলে বিবেচিত হচ্ছে । সবচেয়ে কম বয়স, মাত্র ১৩ বছরে বিয়ে অনুমোদোন দিয়েছে একমাত্র দেশ ইরান । ১৪ বছর মানছে ল্যাটিন দুটা দেশ । ১৫ বছর মানছে একটা ল্যাটিন, দুটা আফ্রিকান এবং তিনটা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ; মোট মিলিয়ে ছ’টা দেশ ।
অবাক হবার মতোন একটা বিষয় এই যে বাংলাদেশে ছেলেদের ২১ এবং মেয়েদের ১৮ ন্যূনতম বিয়ের আইনসিদ্ধ বয়স নির্ধারিত থাকার পরও বাল্য বিবাহের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে । তার মানে আইন থাকলেও তার প্রয়োগে যথার্থ শিথিলতা রয়েছে । তা না হলে আইনগত সীমানায় অনেক নিরাপদ সীমানায় থেকেও অপ্রাপ্তবয়স্ক বিয়ে বা বাল্য বিবাহে এমন এগিয়ে থাকার অন্য কোনো কারণ নিশ্চয়ই নেই । কম বয়সে মাতৃত্ব সংক্রান্ত মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যু হ্রাস ও রোধে যেখানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এদেশে কয়েক দশক ধরে । পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও কাজ করছে অনেক সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠান । প্রেক্ষাপট যেখানে বিদ্যমান আইনকে প্রয়োগে জোরদার করবার দাবীকেই স্পষ্ট করে সেখানে বিয়ের আইনগত বয়স সীমা কমিয়ে (ছেলেদের জন্য ১৮ এবং মেয়েদের জন্য ১৬) আনার চিন্তা নিঃসন্দেহে প্রবল বাস্তবতা বিরোধী ভাবাবেগ ছাড়া আর কিছু না। ।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেই বিখ্যাত উক্তি “Let France have good mothers, and she will have good sons.” যার সূত্র ধরে শাশ্বত প্রবাদ চালু হয়ে আছে পৃথিবী জুড়ে ‘Give me good mothers and I will give you a good nation’ “আমাকে ভাল মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভাল জাতি উপহার দেবো”। এই ভালো মা টি কে ?
এই ভালো মা মানে, সুস্থ একজন মা । যে একটি সুস্থ সন্তান উপহার দেবে । সচেতন একজন মা যে তার সন্তানকে যথার্থ যত্নে বড় করবে । শিক্ষিত একজন মা যে তার সন্তানকে সত্য ও আলোর পথে এগোবার দীক্ষা ও অনুপ্রেরণা দিবে । তার মানে কি এই নয় যে, অন্যান্য প্রাণীর মতোন কেবলমাত্র প্রজনন ক্ষমতাই মানুষের জন্য প্রাপ্তবয়ষ্ক বলে পরিগণিত হবার মাপকাঠি নয় । আর মেয়ে বাদ দিয়ে ছেলের কথা যদি আমরা বিবেচনা করি, তবে প্রাপ্তবয়স্ক মানে শুধু প্রজনন ক্ষমতার বাইরে অবশ্যই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে সন্তানের যথাযথ বেড়ে উঠবার সকল রসদের প্রকৃত যোগানদার হয়ে তৈরী হয়ে ওঠাকে বোঝাবে ।
মেধা ও মননের বিকাশ যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় অহরহ বাধাগ্রস্ত । মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর মতোন দুঃখজনক বিষয়কে যেখানে আমরা এখনো বশে আনতে পারিনি । অথচ এসবের বিপরীতে সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং শিল্প-কারখানার পরিবর্তন-বিবর্তন যেখানে নারী শ্রমকে কল-কারখানা ও অফিস-আদালতে আরো বৃহত্তর বলয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে হাঁটছে । এমন একটা পরিস্থিতিতে বিয়ের বয়স কমিয়ে আনাটা হয়তো ভিন্ন কোনো এজেন্ডার ইংগিত হয়ে দেখা দিবে মানুষের মনে । হতে পারে তা নারীর কর্মজীবী পরিচয়কে নিরুৎসাহিত করবার উদ্যোগ কিংবা ভোটাধিকার বা এমন অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তনের আগাম আভাস । আর তা যদি না হয় তবে তা নিশ্চিতভাবে একটি ভুল, পশ্চাদপদ এবং অ-সময়োপযোগী পদক্ষেপের কালো মেঘ । বাষ্প ভারী হবার আগে কিংবা জল হয়ে ঝরে পড়বার আগেই তাকে জোর বাতাসে সীমানা ছাড়া করা খুব জরুরী ।