সম্পর্কগুলো কেন নিঃশর্ততার প্রাচীর ছাড়িয়ে যায়!

সারা বুশরা দ্যুতি:

অনেকগুলো বছর ধরে দেশের বাইরে থাকার একটি বড়ো সুবিধা হলো, যখনই দেশে যাই, খুব সহজেই দেশের অনেক নতুন ধরনের (ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটোই) পরিবর্তন চোখে পড়ে …প্রতিবারই কোনো না কোনো আনকোরা উপলব্ধি নিয়ে ফিরি।

এর মধ্যে একটি জিনিস প্রতিবারই খুব বিষন্নতার সাথে লক্ষ্য করি সেটি হলো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের চিত্র আজ থেকে ২০ বছর আগে যা ছিল, এখনও সেরকমই আছে…. উন্নয়নশীল দেশে থেকেও আমাদের এই সমাজে বসবাসকারী মানুষগুলোর মানসিকতা পরিবর্তিত হলো না। কাছের ও দূরের আত্মীস্বজনদের কাছে কত রকমের গল্পই শুনি, সবগুলো গল্পই কেন যেন সেই গঁৎবাধা মানসিকতার মধ্যে আটকা পড়ে আছে… এগুলো কি কোনোদিন বদলাবে না?

যুগ পাল্টেছে, তবু কথায় কথায় সন্তানদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করাটা মা-বাবারা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। সারাজীবন ছেলেমেয়েকে এতো কষ্ট করে পেলেছি, যাতে বৃদ্ধকালে তারা আমাদের সকল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, এই ধরনের কথা বলে সন্তানদের উপর একটি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা আদতে সঠিক কিনা ভেবে দেখার সময় কি এখনো আসেনি? সন্তানরা মা-বাবার অবদান ও ভালোবাসা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে যেন সময়মতো নিজেরাই তাদের করণীয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে যায় এবং যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করতে পারে, সেই ব্যাপারটি পরিশীলিতভাবে বেশিরভাগ মা-বাবাই এখনও নিশ্চিত করতে পারেন না…সন্তানরা যেন মা-বাবার প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে তাঁদের ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারে, সে ব্যাপারটা খেয়াল রাখা কি জরুরি নয়?

জোর করে, মানসিক চাপে ফেলে, অন্যের সন্তানদের সাথে তুলনা করে নিজের সন্তানের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করা কি সত্যিই প্রত্যেক মা-বাবার অধিকার? এতে যে তিক্ততা তৈরি হয়, সেটা কিন্তু কারো জন্যই সুখকর নয়…. ছেলেমেয়ে কোনো বিজনেস এর ইনভেস্টমেন্ট নয় যে, আমি আজ পালছি, পরবর্তীতে আমাকে দ্বিগুণ করে ফেরত দেবে এটি ভাবা জায়েজ। এটি অত্যন্ত অন্যায় একটি মনোভাব। তোর জন্য এতো টাকা খরচ করছি, মনে রাখিস তোকে এর বিনিময়ে এটা হতে হবে, ওটা আমাদের দিতে হবে, এসব বলে ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব ভারী একটা দায়ের মধ্যে তাদের ঠেলে দেয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত?

আমার মতে, সন্তানদের এমনভাবে বড়ো করা উচিত, যাতে মা-বাবা বা পরিবারের প্রতি খুশি মনে কিছু করার আগ্রহ জন্মায় তাদের মধ্যে। সন্তান যখন উপার্জনক্ষম হয়, এবং পরবর্তীতে তার নিজের সংসার হয়, তখন যেসকল মা-বাবা বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী, তারা তাদের অযাচিত এক্সপেকটেশন কমিয়ে আনেন, আর সেটাই উচিত। কারণ তারা জানেন, এতে তারাই দুঃখ কম পাবেন।

সবচেয়ে ক্ষতিকারক হলো, অন্যের সাথে তুলনা। অমুকের ছেলে তাদের মা বাবাকে পাঁচটা জমি কিনে দিয়েছে, তমুকের মেয়ে তাদের মা-বাবাকে দুইটা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে, তোরা কি করলি আমাদের জন্য, এই ধরনের অভিযোগগুলো বার বার করে সন্তানদের মনটা নষ্ট করে দেয়া সবচেয়ে বেশি পীড়াদায়ক… এতে হিতে বিপরীত হয়… সন্তানদের কিছু করার যে সদিচ্ছা থাকে, এসব শুনলে সেটাও ম্লান হয়ে যায়….ছেলেমেয়ের মনে এক রকমের বিরূপ মনোভাব তৈরি হয় এটা ভেবে যে, যতোই করি আর যাই করি না কেন, মা-বাবাকে তো সন্তুষ্ট করতে পারবো না, মন থেকে খুশি করতে পারবো না…. তাহলে করে কী লাভ?

এসবের আগের ধাপ হচ্ছে পড়াশুনা ও ক্যারিয়ার নির্বাচনে মা-বাবার ভূমিকা। মা-বাবারা রেজাল্ট নিয়ে বাচ্চাদের যে ধরনের মানসিক অত্যাচারের মধ্যে রাখেন, সেটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই…এটার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। তারপরও তারা যুক্তি দেন, চাপ না দিলে এই কম্পিটিশন এর যুগে টিকে থাকবে কী করে? ভালো রেজাল্ট না করলে ভবিষ্যৎ কী? ছেলেমেয়ে তো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর চাপের মুখে পড়াশুনা করে তারা কতটা আলোর পথে অগ্রগামী হচ্ছে বা হতে পারবে? প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো স্পেশাল ক্ষমতা থাকে। সবাইকে যে একাডেমিক ফিল্ড এ শাইন করতেই হবে, এমন কোনো কথা কি সত্যি কোথাও লেখা আছে? খেলাধুলা থেকে শুরু করে ক্রিয়েটিভ ফিলড এ হাজার রকমের অপশনস আছে…যার রেজাল্ট আহামরি কিছু নয়, হয়তো দেখা যাবে সে অন্য কোনো একটা দিকে ভীষণ প্রতিভাবান।

একটা মানুষের মেরিট কেন শুধু তার পড়াশুনার রেজাল্ট দিয়ে বিচার করা হবে? অন্য কোনো ক্ষেত্রেও তো সে দারুণ দক্ষতার পরিচয় রাখতে পারে, কৃতি হতে পারে। তার সেই বিশেষ গুণটি খুঁজে বের করে সেটির যত্ন করা ও বিকাশ ঘটানোর সুযোগ করে দেয়া কি মা-বাবার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?

আমি স্বীকার করছি, পড়াশোনার ক্ষেত্রে ন্যুনতম একটি যোগ্যতা প্রয়োজন এবং সেটি অর্জন করতে আমরা সবাই বাধ্য। কিন্তু কেউ চেষ্টা করেও পারছে না, তবু তাকে শীলপাটায় পিষে ফেলার মতো করে তাকে দিয়ে মা-বাবার চরম কাঙ্খিত রেজাল্ট বের করে আনার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে বরং তার অন্য যে ট্যালেন্ট আছে, সেটিকে ঘষা মজা করার পিছনে শ্রম দেয়াটাই শ্রেয় বলে আমি বিশ্বাস করি…পড়াশুনা তো করবেই, কিন্তু আহামরি রেজাল্ট ছাড়াও যে দুনিয়াতে টিকে থাকা যায় অল্টারনেটিভ কোনো ক্যারিয়ার নিয়ে, এটা মা-বাবাদের বিশ্বাস করতে এতো কষ্ট কিসের সেটা আমার বোধগম্য হয় না। একটু চেষ্টা করে দেখুন না, অন্যভাবে ভাবতে পারেন কিনা।

প্রফেশন চয়েস করার ব্যাপারে সন্তানদের দয়া করে পূর্ণ স্বাধীনতা দিন…এক্ষেত্রে প্লিজ ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সমাজের লোকের কাছে ছোট হবার ভয় দেখিয়ে সন্তানদের আটকে দেবেন না…একজন অভিভাবকের সাথে এটি নিয়ে কথা হচ্ছিলো, তিনি রাগান্বিত স্বরে আমাকে বলে বসলেন, “ছেলেমেয়ে যা চায় তাই করতে দেয়ার মতো এতো প্রগতিশীল হওয়ার আমার দরকার নেই…সন্তান যদি এখন পর্ন স্টার হতে চায়/অ্যাডাল্ট ফিল্ম এ কাজ করতে চায়, তাহলে আমি হাসি মুখে তাতে রাজি হয়ে যাবো নাকি? এইসব অত্যাধুনিক ও ধর্মের মাথায় বাড়ি মারা চিন্তা-ভাবনা নিজেদের কাছেই রাখুন।”
তাকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আপনি এক্সট্রিমটা কেন ভাবছেন? ওটি ছাড়া আরও হাজার রকমের কাজ আছে…আপনি তাদের মনোবাঞ্ছাটা অন্তত আপনার কাছে প্রাণ খুলে শেয়ার করতে দিন, তাদের যুক্তিগুলো ধৈর্য্য ধরে শুনুন। এটুকু করা কি খুব কঠিন অভিভাবকদের জন্য? একটি মেয়ে হয়তো নৃত্যশিল্পী হতে চায়, অথবা একটি ছেলে হয়তো ছবি বানাতে চায়…আপনি হয়তো জানেনও না তার সেই ব্যাপারটি ঘিরে কতখানি প্যাশন আছে…আপনি শুরুতেই বলে দিলেন, ওসব পাপ কাজের কথা ভুলেও উচ্চারণ করা যাবে না। এবং আপনার চোখে/আপনার বিচারে যে কাজে পাপ নেই, যেটি করলে আপনি যেই সমাজে বাস করেন, সেই সমাজের লোকের কাছে আপনার মাথা উঁচু হবে সেরকম একটু ক্যারিয়ার আপনি আপনার সন্তানকে বেছে দিলেন। আপনি একবার ভাবলেনও না, আপনি নিজ হাতে একটি প্রতিভা বিনষ্ট করলেন… এই সংকীর্ণতাগুলো থেকে বেরিয়ে আসা যায় না? দেখুন না পারেন কিনা?

একটা সময় ছিল, যখন মা-বাবারা মনে করতেন, মেয়ে পরের ঘরে চলে যাবে, কাজেই মেয়েকে বেশি টাকা খরচ করে পড়িয়ে কী লাভ? বরং তার বিয়ের জন্য টাকা জমাই, কাজে দেবে। তারা ছেলেকে টাকা খরচ করে পড়াতেন, আর মেয়ের ভাগের টাকাটা খরচ করতেন তার বিয়েতে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি, এই চিত্রটি এখনও খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। ছেলেমেয়ে সমান, এরকম কথা মুখে বললেও কার্যত আমরা এটা কমই করি…পিঠাপিঠি ভাইবোন থাকলে দেখা যায়, ছেলেটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, মেয়েটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, অথবা ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছে। ছেলেকে জমিজমা বেচে দেশের বাইরে পড়তে পাঠানো হচ্ছে, আর মেয়েকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এই ব্যাপারটি কবে পুরোপুরি বদলাবে? যদি সামর্থ্য না থাকে, তাহলে ছেলেমেয়ে দুজনকে ডেকে তাদের সাথে পরামর্শ করা যেতে পারে যে, কে কোনটা চায়…সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলে একটি সুষ্ঠু সিদ্ধান্তে আসা যায় … কিন্তু আমাদের মা-বাবারা ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস না করে নিজেরাই ঠিক করে ফেলেন, মেয়ে পরের বাড়িতে যাবে, তাই টাকাটা বিয়ের গয়না আর পাত্রের বাড়িতে পাঠানোর জন্য খাট-পালঙ্ক-আলমারি আর সোফা সেট কিনতে বেশি দরকার। আর ছেলে পাশ করে চাকরি করে আমাদের টাকা পাঠাবে, কাজেই তাকে টাকা খরচ করে পড়ানো বেশি দরকার।

এই বৈষম্যগুলো আপনারা করেন, পরে নিজেরাই আফসোস করেন, ছেলের জন্য এতো করলাম, ছেলে কিছু ফেরত দিলো না। যা আমাদের পাওয়ার কথা ছিল, সেটা পরের মেয়ে এসে সব দখল করে নিলো। তখন মেয়ের প্রতি আপনাদের হঠাৎ একটা গভীর ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতার জন্ম হয়…আপনারা মনে মনে ভাবতে বসেন, ইশ যদি শুরুতেই মেয়ের জন্য বেশি করতাম।…কেন ছেলের জন্য করতে গেলাম? দেখাশোনা তো মেয়েই বেশি করে, অন্য বাড়ির বৌ হয়েও। কখনো ভেবে দেখেছেন একদম শুরুর ভুল অঙ্কটা আপনারাই কষেছেন এবং অতীত ও বর্তমান দুটো আচরণ ও মনোভাব শুধুই আপনাদের স্বার্থপরতার পরিচয় দিচ্ছে। মা-বাবার ভালোবাসা, স্নেহ এগুলো তো নি:স্বার্থ হওয়ার কথা, হওয়া উচিত। কিন্তু বৃদ্ধ কালে এসে সেটা সুবিধাবাদী কেন হয়ে যেতে হয়?

মা-বাবাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, সন্তানদেরকে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সমানভাবে ট্রিট করুন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে … সারাজীবন একরকম করে বৃদ্ধকালে নিজেদের সুবিধা বুঝে দল ও মনোভাব পরিবর্তন করার মতো বোকামী করবেন না এবং কখনোই দায়িত্ব জিনিষটা জোর করে বোঝার মতো তাদের কাঁধে চাপাতে চেষ্টা করবেন না… তাদের স্বেচ্ছায় তাদের কর্তব্যটুকু করার সুযোগ দিন এবং যে যতোটুকু করতে পারে তাতেই সন্তুষ্ট হবার চেষ্টা করুন।

এতে করে ছেলে মেয়ে সবার সাথে সম্পর্ক ভালো থাকবে এবং মন থেকে তারা মা বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। দড়ি বেশি টানলে যেমন ছিঁড়ে যায়, ঠিক তেমনি অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগে এবং অনবরত অভিযোগ অনুযোগে সন্তানদের শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে যায়…সেটা নিশ্চয়ই কোনো মা-বাবা চান না…. প্রতিটি সন্তানের জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভরতার জায়গা হলো তার মা বাবা, তার সর্বশেষ মানসিক আশ্রয়ও তার মা বাবাই, সন্তান যত বড় আর স্বাবলম্বীই হয়ে যাক না কেন, মা-বাবার স্নেহশীতল ছায়ার অত্যাবশ্যকতা তার কখনোই ফুরোয় না… একজন স্বাবলম্বী সন্তান যখন বাইরের দুনিয়ায় টিকে থাকার জন্য অবিরত যুদ্ধ করতে করতে মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়, সে আশা করে পৃথিবীর আর কেউ তাকে বুঝুক বা না বুঝুক, তার মা-বাবা তাকে ঠিকই বুঝবে, নিজের সংসারে হাজারটা ঝামেলা থেকে সাময়িক মুক্তি খুঁজতে সে মা-বাবার কাছে ছুটে আসতে চায়, সেখানে তার ভালোবাসা, প্রশ্রয় ও প্রশান্তির জায়গাটা অক্ষুন্ন থাকবে ভেবেই সে কিছুটা আরাম বোধ করে।

তাই পরিশেষে এটাই বলবো, সন্তানদের ভরসা ও বিশ্বাসের জায়গাটা যেন কখনো নষ্ট না হয়, যেন কোনো সন্তান না ভাবে, পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত ভালোবাসা বলে কিছু নেই, মা-বাবার ভালোবাসাও না… এটি শুধু গল্পেই পাওয়া যায়, কঠিন বাস্তবে এর জায়গা নেই….এই মর্মান্তিক উপলব্ধি যেমন কোনো সন্তানের কাম্য নয়, ঠিক তেমনি, মা বাবাদের সারাজীবনের ত্যাগ, তিতীক্ষা ও কষ্ট একটা সময়ে এসে কুলষিত হোক, সেটাও কাম্য নয়। সেই বুঝেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চলা এবং প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি সমানভাবে সুবিচার করা বাঞ্ছণীয়।

বেডফোর্ডশায়ার, ইউনাইটেড কিংডম

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.