হাত বাড়িয়ে দেখি, কেউ নেই-৩

শুচি সঞ্জীবিতা:

কথাটা মাথায় ঘুরছে গত দুদিন ধরেই। কিছুতেই নামাতে পারছি না।এক নারী সহকর্মীর শ্বশুর মারা গেছেন। যে সময়টাতে তিনি মারা যান, সহকর্মীটি তখন কাজে ছিলেন। অফিসের দু’একজন বিষয়টি জানতে পারলেও আমরা অনেকেই জানিনি। জানলাম তখন, যখন প্রায় দেড় ঘন্টা পর সহকর্মীটি অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।

সারাদিন যে কাজটা সে করছিল, তা শেষ না করেই চলে যেতে হলো। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাও মাথায় এলো যে, মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পরও দেড় ঘন্টা তো সে অফিসে ছিল। আমাদের সাথে হাসি-ঠা্ট্টায় যোগও দিয়েছিল। ওইদিনের মতো বিষয়টি এখানেই শেষ হয়।

পরদিন অবাক হয়ে দেখি, সেই সহকর্মী যথারীতি সাজ-সজ্জা করেই অফিসে এসেছে। হাসিঠাট্টাও করছিল, আমাদের মতোনই বাইরে থেকে খাবার এনে খেলেন।

আমার মনের মধ্যে তখন শুরু হয় অন্য যুদ্ধ, এ কী করে সম্ভব! এটা কী করে সম্ভবপর! শ্বশুর তো বাবা, হয়তো নিজের জন্মদাতা পিতা নন, স্বামীর পিতা তো! আমি কাজ করতে পারি না। নানান প্রশ্ন এসে মাথাটায় চক্কর দেয়। তাহলে কি একেই আধুনিকতা বলে! মানুষে মানুষে সম্পর্ক কি তাহলে এরকমই হয়ে গেল শেষপর্যন্ত। অফিসের দু’একজনকে জিজ্ঞাসা করি কৌতূহল রাখতে না পেরে।

কেউ বলে, উনি ‘হাইলি প্রফেশনাল’, এখানে সম্পর্ক কিছু না। হবে হয়তো। খুব হতাশ চোখে নিজের ভিতরটা একবার দেখে নিই। এই উত্তরে মনে সান্ত্বনা মেলে না। আগের দিন যার শ্বশুর অর্থাৎ স্বামীর বাবা মারা গেছেন, সেই স্বামী বা পার্টনার যাই বলি না কেন আধুনিক ভাষায়, তার মানসিক অবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও অন্তত পাশে থাকা উচিত ছিল আজকের দিনে। অন্তত আমার এই মত। নইলে সামাজিকতা কেন, পারস্পরিক সম্পর্ক কেন?

তবে মত ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আরেক সহকর্মীর কাছে কথাটা পাড়লে তিনি বললেন, ‘হয়তো সম্পর্কটা তেমন কাছের ছিল না, হয়তো অনেক সমস্যা ছিল, হয়তো তাকে কোনদিন মেনে নেয়নি তার শ্বশুর’।  এই কথাটা অনেকটা মন:পুত হয় আমার। আসলেই তো, আমরা কতটুকু পড়তে পারি একটা মানুষকে? কতটুকু তার ভিতর জানতে পারি বাইরের আবরণ/আভরণ দেখে? কিছুই পারি না। অনুমাননির্ভর জীবনে কষ্টকে অবলম্বন করে কাটিয়ে দিই গোটা একটা জীবন।

হয়তো এইসবকিছুর পিছনে একটা গল্প আছে! হয়তো যে ব্যক্তিটি মারা গেছেন, তিনি শেষ জীবনে ছেলেদের ভালবাসা না পেয়েই চলে গেছেন। তাহলে আর বৌদের দোষ দিয়ে কি হবে! হয়তো সেই জাপান ফেরত কূটনীতিকের মতোন নিজ বাসাতেই উচ্ছিষ্ট ছিলেন ভদ্রলোক! হয়তো সেই কাস্টমস কর্মকর্তার মতোন নিভৃতে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। ছেলেরা কেউ ঘরে নেয়নি। হয়তো শেষজীবনে তাঁর একটিবার ইচ্ছে করেছিল, বড়খোকা এসে বাবা বলে জড়িয়ে ধরুক, কিন্তু ধরেনি।

মনে পড়ে গেল, অনেক আগে বিদেশে পড়ার সময় একদিন বাজার করে হোস্টেলে ফেরার পথে এক বৃদ্ধাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। শীত ছিল প্রচণ্ড। ভারী ওভারকোট গায়ে ওই বৃদ্ধার, সাথের লাঠিটা তখন অদূরে পড়ে আছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, বৃদ্ধা আর নেই। মনটা আমার প্রচণ্ড কষ্টে মুষড়ে পড়েছিল। এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামে বৃদ্ধার পাশে। এক জোয়ান যুবক নেমে আসে তার ভিতর থেকে। আমি আগ্রহের সাথে যুবককে লক্ষ্য করি। এতোটুকু বিকার নেই চোখে-মুখে। বৃদ্ধাকে স্পর্শ করার ইচ্ছা আছে বলেও মনে হলো না।

আমরা এশিয়ান। সাধারণত আমরা এমন সময়ে লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি, কাঁদি। তার কিছুই নেই এখানে। জিজ্ঞাসা করি, কি হয় আপনার? নির্বিকার উত্তর: ‘মা’। কথাটা কানের ভিতর দিয়ে ঢুকে আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়। সাথে সাথেই আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। কখনও আটপোড়ে, কখনও বিপ্লবী মা আমার। জীবনযুদ্ধে অনবরত লড়ে যাওয়া মা আমার আদর্শ। হার না মানা চরিত্র আমি তার কাছ থেকেই পেয়েছি। কিন্তু বিদেশি এই যুবকটিও কি পায়নি কিছুই মায়ের কাছ থেকে? সেকি মায়ের দুধ খায়নি কখনও? কিন্তু আজ অবেলায় মায়ের প্রতি এমন নিষ্ঠুর কেন সে? মেলে না, কিছুতেই মেলে না সমীকরণ।

যেমন মেলে না এই দেশে বসেও আমার সহকর্মীর আচরণ! মনে মনে ভাবি, আজ যদি তার বাবা মারা যেতেন! আজ যদি তার স্বামী এমন আচরণ করতেন শ্বশুরের মৃত্যুতে! ঘটনা কি দুটোই একরকম হতো? হতো না, আমি নিশ্চিত। এতো এতো কেস স্টাডি পড়ে, এতো এতো মানুষের সাথে মেলামেশার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মানুষে মানুষে ভিন্নতাও হয়, শ্বশুরের জন্য জানপাত করতেও কম দেখি না।

খুব দূরে যেতে হয় না আরও প্রমাণ খুঁজতে। এক মা অসুস্থ হয়েছিলেন দীর্ঘদিন। শরীরের ভারের কারণে তাকে টানাটানি করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। কিছুদিন বড় ছেলের কাছে রাখা হয়েছিল, একদিন না করে দেয় ছেলের বউ। জায়গা হয় বড় মেয়ের বাসায়। মেয়ের বড় ছেলের বউ আসবে বাসায়, তাই বৃদ্ধা মাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় গ্রামে একেবারে নির্বান্ধব পরিবেশে। দেখার বলতে পুরনো সহকারি দুজন, একেবারে আনকোরা। তবুও ভালবাসা ছিল ওদের মনে। গ্রামের মাটির ঘরে পর্দা টাঙিয়ে চেয়ার দিয়ে টয়লেটের ব্যবস্থা হয়। একই ঘরে থাকা-খাওয়া-টয়লেট। বৃদ্ধা মায়ের পায়ে ঘা ছড়িয়ে যেতে যেতে বিশাল আকার নেয়। ছেলেমেয়েরা দূর থেকে দেখে আর অপেক্ষা করে মায়ের মৃত্যুর। যেন এই বয়সে আর তাকেঁ বাঁচিয়ে রাখার কোনই প্রয়োজন নেই।

এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। উনার ছেলেমেয়েদের বলি, তোমরা কি মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা করবে? চিকিৎসা করাবে না? কারও কোন জবাব মেলে না। একদিন রাতে ঘুমিয়ে যান সেই মা, আর উঠেন না।

 

শেয়ার করুন: